স্ত্রীর জন্য আইসক্রিম কিনে দেওয়া মসজিদে দান করার থেকেও উত্তম এ কথাটা কি সঠিক

“স্ত্রীর জন্য আইসক্রিম কিনে দেওয়া মসজিদে দান করার থেকেও উত্তম” এ কথাটা কি সঠিক? ইসলামে স্ত্রী-সন্তানদের জন্য অর্থ খরচের মর্যাদা কতটুকু?

প্রশ্ন: ফেসবুকে একটা কথা প্রায় চোখে পড়ে। তা হল: “স্ত্রীর জন্য আইসক্রিম কিনে দেওয়া মসজিদে দান করার থেকে ও উত্তম।” এ কথাটা কতটুকু সঠিক? আর ইসলামে স্ত্রী-সন্তানদের জন্য অর্থ খরচের মর্যাদা কতটুকু?

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: “স্ত্রীর জন্য আইসক্রিম কিনে দেওয়া মসজিদে দান করার থেকে ও উত্তম।” আমার দৃষ্টিতে এ কথাটি সঠিক নয়। কেননা স্ত্রীকে আইসক্রিম কিনে খাওয়ানো স্বামীর ভরণ-পোষণ তথা অত্যাবশ্যকীয় খরচের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে যদি স্ত্রী আইসক্রিম খেতে চায় তাহলে খাওয়ানোটা অবশ্যই উত্তম তাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে। এতেও স্বামীর জন্য সদকার সওয়াব রয়েছে। বরং সামর্থ্য থাকলে স্ত্রীর যে কোনও বৈধ আবদার পূরণ করলে স্বামী জন্য সওয়াব রয়েছে ইনশাআল্লাহ। কেননা হাদিসে স্ত্রী-সন্তানদের উদ্দেশ্যে অর্থ খরচ করাকে ‘সদকা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন:

✪ আবু মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِذَا أَنْفَقَ الرَّجُلُ عَلَى أَهْلِهِ يَحْتَسِبُهَا فَهُوَ لَهُ صَدَقَةٌ
“একজন পুরুষ যখন স্ত্রী-পরিবারের জন্য সওয়াবের নিয়তে অর্থ খরচ করে তখন তা হয় তার সদকা স্বরূপ।” [সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) অধ্যায়: ২/ ঈমান, পরিচ্ছেদ: ৪১/ আমল নিয়ত ও সওয়াব আশা অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের প্রাপ্য তার নিয়ত অনুযায়ী।]
✪ অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللَّهِ إِلَّا أُجِرْتَ عَلَيْهَا حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِي فَمِ امْرَأَتِكَ
“তুমি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশে যা-ই ব্যয় কর না কেন, তোমাকে তার প্রতিদান নিশ্চিতরূপে প্রদান করা হবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যা তুলে দাও তারও।” [সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), অধ্যায়: ২/ ঈমান, পরিচ্ছেদ: ২/৪১ আমলসমূহ সংকল্প ও পুণ্যের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যক্তির প্রাপ্য তাঁর সংকল্প অনুযায়ী]

পক্ষান্তরে মসজিদে দান করা সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

« إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ »

“মানুষ মৃত্যু বরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায় তবে তিনটি ছাড়া।(সেগুলো হলো) সদকায়ে জারিয়া, এমন ইলম (শরিয়ত বিষয়ক জ্ঞান) যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং এমন নেক সন্তান যে তার জন্য দু‘আ করে।” [সহিহ মুসলিম, হা/৪৩১০]
➧ ‘সদকায়ে জারিয়া’ কী?
সদকায়ে জারিয়া অর্থ: এমন দান যার সওয়াব মৃত্যুর পরও অব্যাহত ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে (বা যার সওয়াব মৃত্যুর পরও দানকারীর আমলনামায় জমা হতে থাকে।)
ইমাম নওবি বলেন, الصدقة الجارية هي الوقف “সদকায়ে জারিয়া হল, ওয়াকফ।” (জায়গা-জমি, ভবন ইত্যাদি ইসলাম ও মানবতার সেবায় দান করা)। [শারহে সহিহ মুসলিম]। সুতরাং মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, ইসলামের প্রয়োজন বা জনকল্যাণ মূলক কাজের উদ্দেশ্যে জায়গা-জমি ওয়াকফ, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণ, দুঃস্থ, অসহায় ও এতিমদের জন্য বাসস্থান নির্মাণ, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন, ইসলামি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা বা তাতে বই-পুস্তক কিনে দেওয়া ইত্যাদি সবই সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত।
এ সব সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব অনন্তকাল ধরে দান কারীর আমলনামায় জমা হতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। সুতরাং এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সাধারণ সদকার থেকে সদকায়ে জারিয়া অধিক উত্তম। অত:এব মসজিদে দানের সাথে স্ত্রীকে আইসক্রিম কিনে খাওয়ানোর জন্য টাকা খরচ করার তুলনা করা তো দূরের কথা কথা অধিক উত্তম বা অধিক সওয়াবের বলার সুযোগ নেই। আল্লাহু আলাম।

❑ স্ত্রীর জন্য প্রয়োজনীয় ভরণ-পোষণের জন্য অর্থ খরচ করা নফল দান-সদকার থেকে উত্তম:

ইসলামের দৃষ্টিতে স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ-পোষণ তথা তাদের পোশাক-আশাক, খাবার ও জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে অর্থ খরচ করা স্বামীর জন্য মসজিদ-মাদরাসা বা অন্যান্য যে কোনও জনকল্যাণ খাতে দান করার চেয়ে উত্তম এবং অধিক সওয়াবের। কারণ মসজিদ-মাদরাসা বা জনকল্যাণ খাতে দান করা নফল ইবাদত। কিন্তু স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা স্বামীর জন্য ফরজ।

✪ আল্লাহ তাআলা বলেন,
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَبِمَا أَنفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ
“পুরুষেরা নারীদের উপর কৃর্তত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে।” [সূরা নিসা: ৩৪]
✪ অপর একটি হাদিসে এসেছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
دِينَارٌ أَنْفَقْتَهُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَدِينَارٌ أَنْفَقْتَهُ فِي رَقَبَةٍ وَدِينَارٌ تَصَدَّقْتَ بِهِ عَلَى مِسْكِينٍ وَدِينَارٌ أَنْفَقْتَهُ عَلَى أَهْلِكَ أَعْظَمُهَا أَجْرًا الَّذِي أَنْفَقْتَهُ عَلَى أَهْلِكَ
“একটি দিনার (স্বর্ণ মুদ্রা) যা তুমি ফি সাবিলিল্লাহ (জি/হ/দের জন্য) ব্যয় করেছ, একটি দিনার যা তুমি দাস মুক্তির জন্য ব্যয় করেছ, একটি দিনার যা তুমি গরিব-অসহায় মানুষের উদ্দেশ্য ব্যয় করেছ এবং একটি দিনার তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করেছ। এগুলোর মধ্যে সাওয়াবের দিক সর্বোত্তম হল, যা তুমি তোমার পরিবারের জন্য খরচ করেছ।” [সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) অধ্যায়: ১৩/ যাকাত, পরিচ্ছেদ: ৭. পরিবার-পরিজন ও দাস-দাসীদের প্রতি ব্যয় করার ফজিলত এবং তাদের হক নষ্ট কারী ব্যক্তির পাপ]

সুতরাং সামর্থ্য থাকার পরও ইচ্ছাকৃত ভাবে স্ত্রীর ভরণ-পোষণ না দিলে তাকে গুনাহগার হতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে সে যত টাকা খরচ করবে সওয়াবে নিয়ত থাকলে আল্লাহ তাআলা তার আমলনামায় তার বিনিময়ে সদকার সওয়াব দান করবেন ইনশাআল্লাহ।

মোটকথা, স্ত্রী পরিবারের জন্য ভরণ-পোষণ ও অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে অর্থ খরচ করা ইসলামের বিভিন্ন প্রয়োজনে নফল দানের থেকে উত্তম। কিন্তু সদকায়ে জারিয়া মূলক বিভিন্ন খাতে অর্থ খরচ করা অধিক উত্তম স্ত্রীকে আইসক্রিম খাওয়ানো বা আবশ্যকীয় নয় এমন ক্ষেত্রে খরচ করার থেকে। তবে এ ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় করলেও স্বামী সদকার সওয়াব পাবে ইনশাআল্লাহ। সুতরাং একজন আদর্শ স্বামীর কর্তব্য, আল্লাহ যদি তাকে পর্যাপ্ত অর্থ-সম্পদ দান করেন তাহলে স্ত্রী ও সন্তানদের বিভিন্ন বৈধ প্রয়োজনে উদার হাতে অর্থ খরচ করবে। পাশাপাশি মাদরাসা, মসজিদ, এতিমখানা ও বিভিন্ন জনকল্যাণ খাতেও প্রয়োজনীয় দান-সদকা করবে। অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন করবে। কিন্তু সামর্থ্য থাকার পরও যদি ইচ্ছাকৃতভাবে স্ত্রী-পরিবারের প্রয়োজনে অর্থ খরচ থেকে বিরত থাকে, ফলে যদি তারা কষ্ট পায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে এ কারণে সে গুনাহগার হবে এবং কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাঠগড়ায় তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সুপথে পরিচালিত করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।