রাত্রিবেলা রাস্তাঘাট, দোকানপাট, মসজিদ ও বাড়িঘরে বাতি জ্বালিয়ে রাখার ব্যাপারে ইসলামি নির্দেশনা

রাত্রিবেলা রাস্তাঘাট, দোকানপাট, মসজিদ ও বাড়িঘরে বাতি জ্বালিয়ে রাখার ব্যাপারে ইসলামি নির্দেশনা
▬▬▬◈◉◈▬▬▬
নি:সন্দেহে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানবতার সবচেয়ে বিশ্বস্ত, অন্তরঙ্গ ও কল্যাণকামী মানুষ। তিনি আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণকর সব বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দান করেছেন এবং ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর সব কিছু থেকে সাবধান করেছেন।
স্বভাবতই রাতে ঘুমানোর মত জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয়েও মানুষের নিরাপত্তা এবং উপকারী বিষয়েও দিয়েছেন মূল্যবান ও বিজ্ঞান সম্মত দিক নির্দেশনা।

নিম্নে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশনার আলোকে এ সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা পেশ করা হল,
و بالله التوفيق
রাতে ঘুমানোর পূর্বে ঘরে আগুন নিভিয়ে ফেলার ব্যাপারে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন:

عَنْ سَالِمٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «لَا تَتْرُكُوا النَّارَ فِي بُيُوتِكُمْ حِينَ تَنَامُونَ»
সালেম রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা ঘুমানোর পূর্বে তোমাদের ঘরে আগুন জ্বালিয়ে রেখো না।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

◈ আরেক হাদিসে এসেছে:
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، سَمِعَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «لَا تَتْرُكُوا النَّارَ فِي بُيُوتِكُمْ، فَإِنَّهَا عَدُوٌّ»
ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, “তোমাদের ঘরসমূহে আগুন জ্বলিয়ে রেখে দিও না। কেননা তা দুশমন।” [আল আদাবুল মুফরাদ, হা/ ১২৩৮-সহিহ]

◈ অন্য হাদিসে এসেছে:
عَنْ أَبِي مُوسَى قَالَ: احْتَرَقَ بِالْمَدِينَةِ بَيْتٌ عَلَى أَهْلِهِ مِنَ اللَّيْلِ، فَحُدِّثَ بِذَلِكَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: «إِنَّ هَذِهِ النَّارَ عَدُوٌّ لَكُمْ، فَإِذَا نِمْتُمْ فَأَطْفِئُوهَا عَنْكُمْ»
আবু মুসা রা. থেকে বর্ণিত, মদিনার এক পরিবারের ঘরে রাতের বেলা আগুন লেগে তা পুড়ে গেলো। তাদের এই ঘটনা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট বর্ণনা করা হলে তিনি বললেন, “নিশ্চয় আগুন তোমাদের শত্রু। অতএব তোমরা যখন ঘুমাতে যাবে তখন তা নিভিয়ে দিবে।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

◈ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নাক্ত হাদিসে ঘুমের পূর্বে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন।
জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِذَا اسْتَجْنَحَ ‏{‏اللَّيْلُ‏}‏ ـ أَوْ كَانَ جُنْحُ اللَّيْلِ ـ فَكُفُّوا صِبْيَانَكُمْ، فَإِنَّ الشَّيَاطِينَ تَنْتَشِرُ حِينَئِذٍ، فَإِذَا ذَهَبَ سَاعَةٌ مِنَ الْعِشَاءِ فَحُلُّوهُمْ وَأَغْلِقْ بَابَكَ، وَاذْكُرِ اسْمَ اللَّهِ، وَأَطْفِئْ مِصْبَاحَكَ، وَاذْكُرِ اسْمَ اللَّهِ، وَأَوْكِ سِقَاءَكَ، وَاذْكُرِ اسْمَ اللَّهِ، وَخَمِّرْ إِنَاءَكَ، وَاذْكُرِ اسْمَ اللَّهِ، وَلَوْ تَعْرُضُ عَلَيْهِ شَيْئًا
“সূর্যাস্তের পরপরই যখন রাত শুরু হয় অথবা বলেছেন, যখন রাতের অন্ধকার নেমে আসে তখন
– তোমরা তোমাদের শিশুদেরকে ঘরে আটকে রাখবে। কারণ এ সময় শয়তানেরা ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর যখন রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হবে তখন তাদের ছেড়ে দিতে পার
– আর তুমি তোমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দাও এবং আল্লাহর নাম স্মরণ কর।
– তোমার ঘরের বাতি নিভিয়ে দাও এবং আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ কর।
– তোমার পানি রাখার পাত্রের মুখ ঢেকে রাখ এবং আল্লাহর নাম স্মরণ কর।
– তোমার বাসনপত্র ঢেকে রাখ এবং আল্লাহর নাম স্মরণ কর। সামান্য কিছু হলেও তার ওপর দিয়ে রেখে দাও।” (সহীহুল বুখারী হা/৩২৮০)

❏‌ স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের আলোকে রাতে আলো নিভিয়ে ঘুমালে শরীর ভাল থাকে। কারণ:

❖ ক. অন্ধকার ঘর ঘুমের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। আঁধার শরীরের থেকে ঘুমের সময় মেলোটোনিন হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি করে। যা শান্তির ঘুমের সহায়ক।
❖ খ. মোলাটোনিন মাথায় পিনেয়াল গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হওয়া এক বিশেষ ধরণের হরমোন, যা বুদ্ধি বাড়ায়। মাথার কাজ করার ক্ষমতাও বাড়াতে সাহায্য করে। তাই ঘুমের সময়টা অন্ধকার ঘর রাখা খুবই দরকার।
❖ গ. সকালবেলা শরীর থেকে‌ মেলোটোনিন ক্ষরণ কমে যায়। রাতে অন্ধকারেই সেটা বাড়ে। চিকিৎসকরা বলেছেন, এই জাতীয় হরমোন স্তন ক্যানসার, অ্যালজাইমার্স কমাতে সাহায্য করে।
❖ ঘ. ঠিকঠাক ঘুমের জন্য ঘরটা সঠিক ভাবে অন্ধকার করা হয়েছে কিনা দেখে নেয়া জরুরি। শুয়ে পড়ার পর নিজের হাতটা চোখের সামনে নিয়ে আসুন। দেখুন, হাতের আঙুল গোনা যাচ্ছে কিনা। যদি না দেখা যায়, তাহলে ঠিক আছে।
❖ ঙ. রাস্তার আলো থেকে ঘরের বাইরের আলো আটকাতে ঘরে মোটা পর্দা ব্যবহার করা জরুরি। ঘুমের মাঝে ঘরে যাতে রাস্তার আলো না আসে, সেটা দেখে নেয়া দরকার।
❖ চ. চার্জার, কম্পিউটারের সামান্য লাল আলো যাতে ঘরে না থাকে সেটা ঘুমাতে যাওয়ার আগে দেখে নেয়া দরকার। সব বন্ধ করে দিয়ে ঘুমাতে যান।
[সূত্র: ‌কালের কণ্ঠ ভায়া আজকাল]

কিন্তু যদি প্রয়োজনে বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয় তাতে কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। যেমন: রাস্তাঘাটে মানুষের যাতায়াত সুবিধা, চুরি-ডাকাতি ও ছিনতায় রোধ, নিরাপত্তা, দূর্ঘটনা এড়ানো ইত্যাদি কারণে অথবা ঘরের মধ্যে বাচ্চারা যেন রাতে উঠে অন্ধকারে ভয় না পায় অথবা অনেকেই অন্ধকারে ঘুমাতে ভয় পায় সে ভয় দূর করতে হালকা বাতি (ড্রিম লাইট) জ্বালায়, অথবা রাতে মহিলা ও শিশুদের টয়লেটে যাতায়াত সুবিধার জন্য বাতি প্রজ্জিলিত রাখার প্রয়োজন হয় তাহলে এ জাতীয় বিশেষ দরকারে বাড়িতে বাতি জ্বালিয়ে রাখায় কোনও আপত্তি নাই ইনশাআল্লাহ। তবে বিনা প্রয়োজনে বাতি জ্বালিয়ে রাখা অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত-যা ইসলামে হারাম।

যদিও আগুন এবং বর্তমান যুগের আধুনিক বৈদ্যুতিক বাতির মাঝে পার্থক্য আছে। বর্তমান যুগের বৈদ্যুতিক বাতি আগের যুগের চেরাগ, হারিকেন, মশাল প্রজ্জলন ইত্যাদি থেকে তুলনামূলক অনেক বেশি নিরাপদ আল হামদুলিল্লাহ। কিন্তু তারপরও দরকার না হলে শয়ন কক্ষে বাতি নিভিয়ে ঘুমানোই অধিক উত্তম। কারণ তা পুরোপুরি নিরাপদ নয়। ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা বেশি থাকে। (আল্লাহ হেফাজত করুন-আমিন) তাছাড়া বাতি নিভিয়ে ঘুমানো স্বাস্থের দিক থেকে অধিক উপকারী যেমনটি পূর্বোক্ত বৈজ্ঞানিক আলোচনা থেকে প্রতিভাত হয়েছে।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।