বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শিক্ষা

বিশুদ্ধ ভাষণ ও সুস্পষ্ট উচ্চারণ মানুষের ব্যক্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। ইসলাম মাতৃভাষাকে শুদ্ধভাবে চর্চা করার শিক্ষা প্রদান করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা চর্চা বা বিশুদ্ধভাবে কথা বলা রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অন্যতম শিক্ষা।

শিশু মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্মের পর বিশুদ্ধ ভাষা ও শুদ্ধ উচ্চারণ শেখার লক্ষ্যে বিশুদ্ধ ভাষাভাষী বানু সাআদ গোত্রের হালিমা সাদিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।

ঐতিহাসিকদের মতে, ‘আরবের সম্ভ্রান্ত লোকদের মধ্যে এ প্রথা প্রচলিত ছিল যে তারা তাদের সন্তানদের বেদুঈন কোনো গোত্রে প্রতিপালনের জন্য পাঠাতেন। কেননা বেদুঈনরা বিশুদ্ধ ভাষাভাষী ছিল, ফলে বেদুঈনদের সঙ্গে মিশে তাদের শিশুরাও বিশুদ্ধ ভাষা শিখতে পারবে।’ [সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা ১৬২]।
সুতরাং এ বক্তব্যে মাতৃভাষার গুরুত্বকেই স্বীকার করা হয়েছে।

– মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশুদ্ধা ভাষায় কথা বলতেন: রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুদ্ধ ভাষায় স্পষ্টভাবে কথা বলতেন।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আমি আরবদের মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধ ভাষাভাষী।” হাদিস হিসেবে বাক্যটির সূত্রে দুর্বলতা থাকলেও বহু মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক তা বর্ণনা করেছেন।

– রাসুলুলাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাষার বিশুদ্ধতা ও উপযুক্ত শব্দচয়ন ইত্যাদির প্রতি তাগিদ প্রদান করেছেন। একবার কোনো এক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে সালাম দিয়ে বললেন, ‘আ-আলিজু?’ আরবি ভাষায় এ শব্দের ব্যবহার ‘প্রবেশ’ অর্থে প্রচলিত থাকলেও অনুমতি প্রার্থনার ক্ষেত্রে তা প্রমিত শব্দ নয়।

প্রমিত শব্দ হচ্ছে, ‘আ-আদখুলু?’ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি ‘আ-আদখুলু?’ বলো। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “তোমরা এশার নামাজকে আতামা বলবে না, এশা বলবে।” “আঙুরকে কারাম বলবে না, ইনাব বলবে।” এভাবে তিনি মুসলিম সমাজের ভাষাগত সংশোধনে সঠিক শব্দ প্রয়োগের নির্দেশনা দিয়েছেন। [সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫১৭৭]

❑ শব্দচয়নে সতর্কতা:

সহিহ মুসলিমে ‘কিতাবুল আলফাজ’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে বিভিন্ন হাদিসে রাসুলল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথাবার্তায় যেসব শব্দের প্রায়োগিক সংশোধন করেছেন তা বর্ণিত হয়েছে।

ইবনে আবি শায়বার ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে ‘কিতাবুল আদব’-এর একটি শিরোনাম হলো, ‘মান কানা ইউয়ালিমুহুম ওয়াদরিবুহুম আলাল লাহনি’ অর্থাৎ সন্তানকে ভাষা শিক্ষা দেওয়া এবং ভুল হলে শাসন করা প্রসঙ্গ।

এ পরিচ্ছেদে সহিহ সনদে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে ‘কথাবার্তায় লাহন বা ভাষাগত ভুল হলে তিনি সন্তানদের শাসন করতেন।’

এ থেকে বোঝা যায় যে দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেক ব্যক্তির ভাষা বিশুদ্ধ ও শালীন হতে হবে। এটা দ্বিনি ভাষার প্রসঙ্গ নয়; বরং মাতৃভাষার প্রসঙ্গ। অতএব মাতৃভাষার বিশুদ্ধতা ইসলামের নির্দেশ।

❑ চার উপায়ে মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন:

মানুষকে তার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য কোনো বিশেষ ভাষায় কথা বলার দক্ষতা অর্জন করতে হয়। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জনের মৌলিক চারটি মাধ্যম শোনা, বলা, পড়া ও লেখার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করেছেন।

ক. মানুষ যেসব মাধ্যম ব্যবহার করে জ্ঞান অর্জন করে থাকে পড়া তার অন্যতম। আল্লাহ সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন, ‘পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ [সুরা আলাক, আয়াত: ১]

কেননা পড়া ছাড়া জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে যে ভাষায় পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা তাঁর মাতৃভাষা।

খ. জ্ঞান অর্জন করার দ্বিতীয় মাধ্যম শোনা। আল্লাহ বলেন, ‘যখন কোরআন পড়া হয়, তখন তোমরা তা মনোযোগসহ শুনবে এবং নিশ্চুপ হয়ে থাকবে, যাতে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়।’ [সুরা আরাফ, আয়াত: ২০৪]

বস্তুত রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে যে ভাষায় আল্লাহ তাআলা তাঁর আয়াত শোনার নির্দেশ দেন তা হলো মাতৃভাষা। মানবশিশু প্রথমে তার মায়ের কাছ থেকে শুনে শুনে জ্ঞান অর্জন করে থাকে। এটা যে ভাষায় ঘটে থাকে তা-ই ব্যক্তির মাতৃভাষা।

গ. বলা: আল্লাহ তাআলা বলেন, “তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তাকে বায়ান তথা ভাবপ্রকাশ শিক্ষা দিয়েছেন।” [সুরা আর-রহমান, আয়াত: ৩-৪)

এখানে ‘বায়ান’ শব্দের অর্থ বলা। শিশু প্রথমে তার মাতৃভাষাতেই কথা বলতে শুরু করে। পরে সে অন্য ভাষা আয়ত্ত করে।

গ. মানুষকে তার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য লেখায়ও দক্ষতা অর্জন করতে হয়। আর এটি মনের ভাব প্রকাশের আরেকটি মাধ্যম। আল্লাহ বলেন, “যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন।” [সুরা আলাক, আয়াত: ৪]

কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার অর্থ তিনি লিখে পাঠ করে শিক্ষা লাভের নির্দেশ দিয়েছেন। একবার রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কয়েকজন লোককে শিক্ষা দিচ্ছিলেন। শিক্ষার্থীদের একজন বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি আপনার কাছ থেকে হাদিস শুনি কিন্তু ভুলে যাই। তখন হাতে লেখার প্রতি ইংগিত দিয়ে রাসুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি তোমার ডান হাতের সাহায্য গ্রহণ কোরো তথা লিখে রাখো।’ [সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৬৬৬]

লক্ষ্য করা যায়, বাংলা অঞ্চলে আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, তুরস্ক, মিসর প্রভৃতি দেশ থেকে ইসলাম প্রচারকরা আগমন করেছেন। তারা এখানে এসে এ অঞ্চলের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করেছেন এবং এ অঞ্চলের মানুষের ভাষাতেই ইসলাম প্রচার করেছেন। মানুষ অতি সহজেই তাদের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। ফলে মুসলিমদের আগমনের ফলে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয় এবং মর্যাদার আসন লাভ করে। বাংলার সুলতান ও শাসকগণের পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বপ্রথম বাংলায় রামায়ণ-মহাভারত অনূদিত হয় এবং বাংলা রাজদরবারে প্রবেশাধিকার পায়। তা ছাড়া ইসলাম বিভিন্ন ইবাদত ও দোয়ার ক্ষেত্রেও মাতৃভাষার চর্চাকে স্বীকৃতি দিয়েছে; বরং যারা আরবি ভাষায় পারদর্শী নন তাদের জন্য মাতৃভাষায় দোয়া করাই উত্তম। মাতৃভাষার মাধ্যমে মনের অভিব্যক্তি যেভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হয় অন্য কোনো ভাষায় তা সম্ভব হয় না। মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষ তার মনের সব আকুতি প্রকাশ করতে পারে এবং তাঁর রহমতের ও ক্ষমার আশায় প্রশান্তি লাভ করে।

উল্লেখ্য যে, ইসলামে বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহার ও সঠিক উচ্চারণের অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে যা উক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত। তবে ক্ষেত্রে বিশেষ আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা দোষণীয় নয় যদি বিশুদ্ধ ভাষা বুঝতে সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য হয়। (সম্পাদক)

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সম্পাদনা ও পরিমার্জনে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
[উৎস: kalerkantho]