চোখের পাতা লাফানো শারীরিক সমস্যা নাকি শুভ-অশুভের আলামত এবং প্রতিকার কী

মাঝেমধ্যেই আমাদের চোখের পাতা লাফায় বা চোখ নাচে। এ ক্ষেত্রে কেউ মনে করে, চোখের পাতা লাফানো মানেই সর্বনাশ আবার কেউ মনে করে ভালো কিছুর পূর্বাভাস। অনেকের মতে, বাম চোখের পাতা লাফালে কোনও না কোনও বিপদ আসন্ন। এমনটা হলে বাড়ির লোকজন যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় থাকেন। আবার কেউ মনে করে, চোখ কাঁপলে তার শুভ-অশুভ ইঙ্গিত নির্ভর করে ব্যক্তির উপর। যদি মহিলাদের ডান চোখ কাঁপে, তবে তা অশুভ বলে ধরা হয় আর পুরুষদের ক্ষেত্রে ডান চোখ কাঁপার অর্থ তার মনের ইচ্ছে পূরণ হওয়ার সময় এসেছে। চোখের পাতা লাফানো নিয়ে এ রকম নানা বিশ্বাস সমাজৈ প্রচলিত আছে। এ সব বিশ্বাসের কারণ হল, জ্যোতিষ শাস্ত্রে এ জাতীয় ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।

এখন আমরা জানব, এই চোখের পাতা লাফানো কি কোনও শারীরিক সমস্যা নাকি শুভ-অশুভের আলামত?

প্রকৃত বিচারে, চোখের পাতা লাফানোকে অশুভ বা শুভ আলামত মনে করা একটি ভ্রান্ত কুসংস্কার ছাড়া অন্য কিছু নয়। ডান কিংবা বাঁ কোনও চোখ লাফানোর সঙ্গেই শুভ-অশুভ বা কল্যাণ-অকল্যাণের কোনও সম্পর্ক নেই।
এটি ইসলামের দৃষ্টিতে যেমন ভ্রান্ত বিশ্বাস তেমনি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার আলোকেও ভিত্তিহীন।

❂ চোখের পাতা কেন লাফায়?

বিশেষজ্ঞদের মতে, মাঝেমধ্যে মানুষের চোখের পাতা লাফায়। এটা কিছু কারণে ঘটে থাকে। যেমন: চোখের উপর অতিরিক্ত চাপ, (একটানা দীর্ঘক্ষণ মোবাইল, টিভি বা কম্পিউটারের দিকে গভীর মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে থাকা ইত্যাদি কারণে) ঘুম কম হওয়া,‌ অ্যালার্জি ইত্যাদি। বাতাসের ধুলাবালি, ময়লা, রাসায়নিক পদার্থ প্রভৃতির সংস্পর্শে আসার কারণে চোখ লাফাতে পারে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহনুর শারমিন বলেন, “চোখের কোনও পেশির হঠাৎ নড়ে ওঠাকেই আমরা চোখ লাফানো বলে থাকি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ কিছু শারীরবৃত্তীয় কারণেই চোখ লাফানোর মতো অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে। চোখের কিছু সাধারণ রোগবালাইয়েও চোখ লাফাতে পারে। কিছু স্নায়বিক সমস্যাতেও চোখ লাফাতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রে রোগের অন্যান্য উপসর্গও দেখা দেয়। আদতে ডান কিংবা বাঁ কোনও চোখ লাফানোর সঙ্গেই শুভ-অশুভ বা কল্যাণ-অকল্যাণের কোনও সম্পর্ক নেই।” [প্রথম আলো]

এটিকে কল্যাণ-অকল্যাণ বা শুভ-অশুভর ইঙ্গিত বাহী হিসেবে মনে করা হিন্দুদের মধ্যে বেশি প্রচলিত। কোনও মুসলিমের জন্য এমন কুসংস্কারে বিশ্বাস করা জায়েজ নয়।কেননা:

❑ কুলক্ষণে বিশ্বাস করার বিধান:

◈ ইসলামের দৃষ্টিতে কল্যাণ-অকল্যাণ একমাত্র আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন:

মহান আল্লাহ বলেন,

إِن يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ ۖ وَإِن يُرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلَا رَادَّ لِفَضْلِهِ ۚ يُصِيبُ بِهِ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ

“আর আল্লাহ যদি তোমার উপর কোন কষ্ট আরোপ করেন তাহলে কেউ নেই তা খণ্ডাবার মত তাঁকে ছাড়া। পক্ষান্তরে যদি তিনি কিছু কল্যাণ দান করেন, তবে তার অনুগ্রহকে প্রতিহত করার মতও কেউ নেই। তিনি যার প্রতি অনুগ্রহ দান করতে চান স্বীয় বান্দাদের মধ্যে তাকেই দান করেন।” [সূরা ইউনুস: ১০৭]

◈ ইসলামে কুলক্ষণের বিশ্বাস করা শিরক:

– আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لا عَدْوَى وَلا طِيَرَةَ وَلا هَامَةَ وَلا صَفَرَ

“রোগ সংক্রমণ, কুলক্ষণ, পেঁচা এবং সফর মাস বলতে কিছু নাই।” [সহীহু বুখারী, হা/৫৭০৭]

– আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ ثَلاَثًا وَمَا مِنَّا إِلاَّ وَلَكِنَّ اللهَ يُذْهِبُهُ بِالتَّوَكُّلِ

“কোনও কিছুকে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করা শিরক। কোনও কিছুকে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করা শিরক। এ কথা তিনি তিন বার বললেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার মনে কু ধারণা জন্মে না। তবে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা তা (আমাদের মন থেকে) দূর করে দেন।” [আহমদ, ১/৩৮৯, ৪৪০, আবু দাউদ ৩৯১২, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান, হাকেম প্রমুখ। সনদ সহিহ-সিলসিলাহ সহীহাহ, ৪৩০]

– ইমরান বিন হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَطَيَّرَ، أَوْ تُطُيِّرَ لَهُ أَوْ تَكَهَّنَ، أَوْ تُكُهِّنَ لَهُ أَوْ سَحَرَ، أَوْ سُحِرَ لَهُ

“যে ব্যক্তি নিজে কুলক্ষণে বিশ্বাস করে ও যার কারণে অন্যের মাঝে কুলক্ষণের প্রতি বিশ্বাসের প্রবণতা সৃষ্টি হয় এবং যে ব্যক্তি ভাগ্য গণনা করে ও যার জন্য ভাগ্য গণনা করা হয় (বর্ণনাকারী মনে করেন যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সম্পর্কেও বলেছিলেন) এবং যে জাদু করে ও যার কারণে জাদু করা হয় সেই ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়।” [তাবারানী, সিলসিলা সহীহাহ, হা/২১৯৫।]

– আব্দুল্লাহ বিন আমর বর্ণিত হাদিসে এসেছে। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা বললেন, কুলক্ষণ যে ব্যক্তিকে কোন কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে, নিশ্চয়ই সে শিরক করে। সহাবিগণ আরজ করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ, উহার কাফফারা কী হবে?

তিনি বললেন, ঐ ব্যক্তি বলবে,

اَللَّهُمَّ لاَ خَيْرَ إِلاَّ خَيْرُكَ وَلاَ طَيْرَ إِلاَّ طَيْرُكَ وَلاَ إِلَهَ غَيْرُكَ

উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা লা খায়রা ইল্লা খায়রুকা ওয়ালা ত্বায়রা ইল্লা ত্বায়রুকা ওয়ালা ইলা-হা গায়রুকা।

“হে আল্লাহ! আপনার কল্যাণ ছাড়া কোন কল্যাণ নেই। আপনার সৃষ্ট কুলক্ষণ ছাড়া কোন কুলক্ষণ নেই। আর আপনি ছাড়া কোন (হক) মাবুদও নেই।” [আহমদ, হা/৭০৪৫; সিলসিলা সহীহাহ হা/১০৬৫]

– ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مِنْ أُمَّتِي سَبْعُونَ أَلْفًا بِغَيْرِ حِسَابٍ هُمْ الَّذِينَ لاَ يَسْتَرْقُونَ وَلاَ يَتَطَيَّرُونَ وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ

“আমার উম্মতের সত্তর হাজার লোক বিনা হিসেবেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারা হবে এমন লোক, যারা শরিয়তে নিষিদ্ধ ঝাড়ফুঁকের আশ্রয় নেয় না, কোনও বস্তুর শুভ-অশুভ মানে না। একমাত্র প্রতিপালকের ওপরই ভরসা রাখে।” [বুখারি, অধ্যায়: ৮১/ সদয় হওয়া, পরিচ্ছেদ: ৮১/২১. “যে কেউ আল্লাহর উপর ভরসা করে তবে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।” [সূরা তালাক ৬৫/৩]

◈ প্রতিকার:

চোখের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়লে কমানোর ব্যবস্থা করুন। মুঠোফোন, টেলিভিশন এবং অন্যান্য ডিজিটাল পর্দায় সময় কম ব্যয় করুন। কম আলোতে চোখের কাজ করবেন না। মানসিক চাপ কমাতে চেষ্টা করুন। চা-কফির পরিমাণও কমিয়ে দিন। দূষিত বাতাসের কারণে সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হলে রোদ-চশমা ব্যবহার করতে পারেন। ঘুম কম হলে পর্যাপ্ত ঘুমান। চোখকে বিশ্রাম দিন।
চোখের পাতা লাফালে প্রাথমিকভাবে বাড়িয়ে দিন পানি খাওয়ার পরিমাণ। নিশ্চিত করুন ৮ ঘণ্টার গভীর ঘুমের। ম্যাগনেসিয়াম ও ভিটামিনের ঘাটতি ও চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে খেতে পারেন ডাব, দুধ, ডিম, বাদাম ও মৌসুমি ফলমূল।

◈ কখন যাবেন চিকিৎসকের কাছে:

ডাক্তারি পরিভাষায় চোখের পাতা লাফানোকে ‘মায়োকেমিয়া’ (Myokemia) বলা হয়। চিকিৎসকদের মতে, দিনে দু বার ঘটা স্বাভাবিক। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত হলে চিকিৎসা করানো দরকার। চোখ ছাড়া শরীরের অন্য কোনও অংশের পেশি লাফাচ্ছে মনে হলে কিংবা কোনও অংশ দুর্বল হয়ে পড়ছে মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। চোখ লাফানো ছাড়া চোখে ব্যথা, লাল হয়ে যাওয়া, চুলকানি বা চোখের অন্য কোনও উপসর্গ দেখা দিলে চক্ষু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন।
তা ছাড়া জেনে রাখা ভালো যে, পুষ্টির ভারসাম্যের অভাবে চোখ কাঁপা শুরু করলে চিকিৎসকরা ধরে নেন, শরীরে ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি রয়েছে। যে কারণে সঠিক ডায়েট প্ল্যান আর ওষুধ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা একজন চিকিৎসক ছাড়া মোটেও সম্ভব নয়।

যদি অ্যালার্জির কারণে চোখ কাঁপা সমস্যার শুরু হয় তবে আপনার চোখের পানির সঙ্গে হিস্টামিন নির্গত হচ্ছে বলে ধরে নেয়া হয়, যা সঠিক সময়ে রোগী চিকিৎসা না নিলে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। [প্রথম আলো, সময় নিউজ ইত্যাদি]

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।