বর্তমান যুগে পায়ে হেঁটে হজে গমন যে ৮টি কারণে তা উচিৎ নয়

প্রশ্ন: পায়ে হেঁটে হজ করা কি জায়েজ? গত বছর ভারত থেকে এক যুবক পায়ে হেঁটে হজ করেছেন এবং এ বছর বাংলাদেশ থেকে আরেক যুবক হজের নিয়তে সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিকোণে এ কাজটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: নিম্নে পায়ে হেঁটে হজ করার বিধান, শর্তাবলী এবং বর্তমান আধুনিক যুগে যে ৮টি কারণে তা উচিৎ নয় সে বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল:

❑ পায়ে হেঁটে হজ করা কি জায়েজ?

ইসলামের দৃষ্টিতে শর্ত সাপেক্ষে পায়ে হেঁটে হজ করা জায়েজ। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَذِّن فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَىٰ كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ

“এবং মানুষের মধ্যে হজের জন্যে ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে।” [সূরা হজ: ২৭]

তবে এ জন্য বিজ্ঞ আলেমগণ কতিপয় শর্ত উল্লেখ করেছেন। যেমন:

◆ ১. পায়ে হেঁটে সফর করার মত পর্যাপ্ত শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য, শক্তিশালী মনোভাব ও দৃঢ় সংকল্প থাকা। যেন যাত্রাপথে খুব বেশি কষ্ট অনুভূত না হয় এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে না পড়ে।
◆ ২. যানবাহনের সুব্যবস্থা না থাকা।
◆ ৩. দীর্ঘ যাত্রাপথের জন্য প্রয়োজনীয় পাথেয় ও অর্থকড়ি সাথে থাকা যেন পথিমধ্যে অর্থ সঙ্কটে পড়ে ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় গ্রহণ করতে না হয়।
◆ ৪. পথের নিরাপত্তা থাকা। যদি রাস্তা অনিরাপদ হয় এবং এতে জানমালের ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাহলে পায়ে হাঁটা বৈধ হবে না।
◆ ৫. বিভিন্ন দেশ অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজনীয় ভিসা বা অনুমতিপত্র ও কাগজপত্র সঙ্গে থাকা। যেন পথিমধ্যে যাত্রা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা না থাকে।
◆ ৬. কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত থাকা। মানুষের প্রশংসা ও খ্যাতি লাভের নিয়ত থাকলে তা হারাম বরং তা শিরকে আসগর (ছোট শিরক) বলে গণ্য হবে।
◆ ৭. এটিকে সুন্নত বা মুস্তাহাব মনে না করা। কারণ পায়ে হেঁটে সফর করা রসুলুল্লাহ-এর সুন্নত কিংবা মুস্তাহাব নয়। তা সুন্নত বা মুস্তহাব হলে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তা করতেন বা সাহাবিদেরকে তাতে উৎসাহিত করতেন।

❑ পায়ে হেঁটে হজ করা উত্তম নাকি যানবাহনের মাধ্যমে করা উত্তম?

আলেমগণ দ্বিমত করেছেন যে, পায়ে হেঁটে নাকি যানবাহনে আরোহণ করে হজ করা উত্তম। এ ব্যাপারে ইমাম ইবনে কাসির রাহ. বলেন,
قد يستدل بهذه الآية من ذهب من العلماء إلى أن الحج ماشيا ، لمن قدر عليه أفضل من الحج راكبا; لأنه قدمهم في الذكر ، فدل على الاهتمام بهم وقوة هممهم وشدة عزمهم ، والذي عليه الأكثرون أن الحج راكبا أفضل; اقتداء برسول الله صلى الله عليه وسلم ، فإنه حج راكبا مع كمال قوته ، عليه السلام
“যে সব আলেম সামর্থ্যবানদের জন্য যানবাহনে আরোহণের চেয়ে পায়ে হেঁটে হজ করা অধিক উত্তম হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন তারা এই আয়াত (সূরা হজ: ২৭) দ্বারা দলিল পেশ করেছেন। কারণ আল্লাহ তাআলা পায়ে হাঁটার বিষয়টি আগে উল্লেখ করেছেন। এটি তাদের আগ্রহ, শক্তিশালী মনোভাব ও সুদৃঢ় সংকল্পের তীব্রতা নির্দেশ করে। তবে অধিকাংশ আলেম যে মত পোষণ করেন তা হল, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণে যানবাহনে আরোহণ করে হজ করা উত্তম। কারণ তিনি শারীরিক পূর্ণ শক্তি থাকা সত্ত্বেও যানবাহনে আরোহণ করে হজ করেছেন।” [তাফসিরে ইবনে কাসির]

উল্লেখ্য যে, কারও যদি যাতায়াত করার মত যানবাহন না থাকে বা যানবাহনের খরচ বহন করার মত পর্যাপ্ত অর্থ-কড়ি না থাকে তাহলে তার উপর হজ ফরজ নয়।

❑ দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে হজ সফরে যাওয়া কতটা যৌক্তিক?

আধুনিক উন্নত ও সহজলভ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকার পরেও পায়ে হেঁটে কষ্টসাধ্য এত দীর্ঘ পথ পড়ি দিয়ে হজ করতে আসা উচিত নয় কয়েকটি কারণে। নিম্নে সেগুলো উপস্থাপন করা হল:

✪ ১. নিজেকে সীমাহীন কষ্ট, ক্লান্তি এবং ঝুঁকির মধ্যে ফেলা:

ভারতের কেরালা রাজ্য থেকে সৌদি আরবের দূরত্ব প্রায় সাড়ে আট হাজার এবং বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার। এত দীর্ঘ বন্ধুর পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়ার ফলে জীবনকে প্রচণ্ড কষ্ট-ক্লেশ ও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
সুতরাং শুধু আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং জীবনকে সীমাহীন ক্লান্তি ও কষ্টের মধ্যে নিক্ষেপ করা কোনও সুস্থ বিবেক এবং বুদ্ধিমত্তার কাজ হতে পারে না।

একাধিক হাদিস থেকে প্রমাণিত যে, আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পায়ে হেঁটে হজ করার জন্য মানত কারীকে নিয়ত পরিবর্তন করে সওয়ারিতে আরোহণ করে সফর করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। যেমন: হাদিসে এসেছে, ইবনে আব্বাস রা. সূত্রে বর্ণিত,

أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا بَلَغَهُ أَنَّ أُخْتَ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ نَذَرَتْ أَنْ تَحُجَّ مَاشِيَةً، قَالَ: ‌إِنَّ ‌اللهَ ‌لَغَنِيٌّ عَنْ نَذْرِهَا، مُرْهَا فَلْتَرْكَبْ

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন জানতে পারলেন, উকবা ইবনে আমের রা. এর বোন পায়ে হেঁটে হজ করার মানত করেছেন। তখন তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তার এরূপ মানতের মুখাপেক্ষী নন। তাকে যানবাহনে চড়ে হজে আসার নির্দেশ দাও।” [সহিহ আবু দাউদ, হাদিস নাম্বার: ৩২৯৭, জামে তিরমিজি, হাদিস নাম্বার: ১৫৩৬]

আরেকটি হাদিস: আনাস রা. থেকে বর্ণিত,

أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم رَأَى شَيْخًا يُهَادَى بَيْنَ ابْنَيْهِ قَالَ ‏”‏ مَا بَالُ هَذَا ‏”‏‏.‏ قَالُوا نَذَرَ أَنْ يَمْشِيَ‏.‏ قَالَ ‏”‏ إِنَّ اللَّهَ عَنْ تَعْذِيبِ هَذَا نَفْسَهُ لَغَنِيٌّ ‏”‏‏.‏ وَأَمَرَهُ أَنْ يَرْكَبَ‏.‏
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে তার দুই ছেলের কাঁধে ভর করে হেঁটে যেতে দেখে বললেন, তার কী হয়েছে? তারা বললেন, তিনি পায়ে হেঁটে হজ করার মানত করেছেন। তখন আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, লোকটি নিজেকে কষ্ট দিক আল্লাহ তাআলার এর কোন দরকার নেই। অতঃপর তিনি তাকে আরোহীতে সওয়ার হয়ে চলার জন্য আদেশ করলেন।” [সহিহ বুখারী, হাদিস নাম্বার: ১৮৬৫]

➤ লক্ষণীয় বিষয় হল, মানতের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হল, একজন মানুষ যেভাবে মানত করবে তাকে তা সেভাবে পালন করতে হবে যদি তা বৈধ হয়। এটি ফরজ বা আবশ্য পালনীয়। কিন্তু কেউ যদি এমন মানত করে যা তার জন্য পালন করা কষ্টসাধ্য তাহলে উক্ত মানত সেভাবে পালন করা আবশ্যক নয় বরং তার পরিবর্তে যেভাবে তার জন্য সহজ হয় সেভাবে পালন করবে। সে কারণেই উপরোক্ত ব্যক্তিগণ তাদের মানত পালনার্থে যখন হেঁটে হজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলো তখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিষয়টি দেখতে পেয়ে পায়ে হাঁটার পরিবর্তে যানবাহনে চড়ে হজে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সুতরাং যদি উক্ত ব্যক্তি দ্বয় পায়ে হেঁটে হজ করার মানত করেও থাকে তারপরও তা পালন করা বৈধ নয়। কারণ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা নিষেধ করেছেন। আর যদি তা মানত না হয়ে থাকে তাহলে এমনটি করা কতটা সঙ্গত তা সহজে অনুমেয়।

✪ ২. এতে রিয়া (ছোট শিরক) হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে:

এত দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি হওয়ার বিষয়টি ব্যতিক্রমী ঘটনা হওয়ার কারণে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে থাকে। মানুষ এ বিষয়ে প্রচুর আলোচনা-পর্যালোচনা করে।

সুতরাং এ অবস্থায় আল্লাহর ইবাদত করতে গিয়ে অন্তরে রিয়া প্রবেশ করার খুবই সম্ভাবনা রয়েছে। আর কেউ যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে মিডিয়ায় কভারেজ পাওয়া বা ভাইরাল হওয়ার ধান্দায় এমনটি করে তাহলে তা নি:সন্দেহে আরও গর্হিত কাজ। তখন তা শিরকে আসগর (ছোট শিরক) এ রূপান্তরিত হবে।
আর রিয়া এতটাই ভয়ানক বিষয় যে, এর মাধ্যমে একটি ইবাদত শিরকে আসগর বা ছোট শিরকে রূপান্তরিত হয় (নাউযুবিল্লাহ)। যেমন: মাহমুদ বিন লাবীদ রা. হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ قَالُوْا وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِيَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عَندَهُمْ جَزَاءً

“তোমাদের উপর আমার সবচেয়ে অধিক যে জিনিসের ভয় হয় তা হল ছোট শিরক। সাহাবিগণ প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রসূল, ছোট শিরক কী? উত্তরে তিনি বললেন, রিয়া (লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করা)। আল্লাহ তাআলা যখন (কিয়ামত‌ দিবসে) মানুষকে তাদের আমলের প্রতিদান দান করবেন তখন তাদের উদ্দেশ্যে বলবেন, “তোমরা দুনিয়ায় যাদেরকে দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করেছিলে তাদের নিকট গিয়ে দেখ, কোন প্রতিদান পাও কি না!” [মুসনাদে আহমদ, হা/২৩৬৩০, ইবনে আবিদ্দুনিয়া, বায়হাকির যুহুদ, সহীহ তারগীব, হা/২৯-সহিহ]।

✪ ৩. কৃত্রিমতা বা লৌকিকতা:

আধুনিক যানবাহন রেখে পায়ে হেঁটে এত সুদীর্ঘ কষ্টসাধ্য পথ পাড়ি দেওয়া কৃত্রিমতা তথা অপ্রয়োজনীয় কষ্ট ও পরিশ্রমের অন্তর্ভুক্ত। তাতে কোনও সন্দেহ নাই। এর উদাহরণ হল, শুষ্ক স্থান রেখে পানিতে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করার মত।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে কখনো তাকাল্লুফ বা লৌকিকতা প্রদর্শন করতেন না। অন্যদেরকেও তা করতে নিষেধ করেছেন। যেমন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا أَنَا مِنَ الْمُتَكَلِّفِينَ
“(হে নবী আপনি বলুন যে,) আর আমি কৃত্রিমতা কারীদের অন্তর্ভুক্ত নই।” [সূরা স্বাদ: ৮] আর উমর ইবনুল খাত্তাব রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
نُهينَا عنِ التَّكلُّفِ
“আমাদেরকে তাকাল্লুফ তথা কৃত্রিমতা করতে নিষেধ করা হয়েছে।” [সহিহ বুখারি]

– “উপকার হীন কথা বা কাজে কষ্ট-পরিশ্রম করাকে তাকাল্লুফ বা কৃত্রিমতা বলা হয়।” [রিয়াদুস সালেহিন]।

✪ ৪. রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নীতি ও আদর্শ পরিপন্থী কাজ:

আধুনিক যাতায়াত ব্যবস্থা ও সবধরনের সুযোগ-সুবিধা পরিত্যাগ করে পায়ে হেঁটে কণ্টকাকীর্ণ ও দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নীতি ও আদর্শ পরিপন্থী কাজ। কারণ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নীতি বা আদর্শ ছিল, কোনও কাজের ক্ষেত্রে যদি তাঁর সামনে দুটি সুযোগ থাকতো তাহলে সে ক্ষেত্রে তিনি যেটা অধিকতর সহজ সেটা গ্রহণ করতেন। যেমন: মা-জননী আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,

مَا خُيِّرَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بَيْنَ أَمْرَيْنِ إِلَّا أَخَذَ أَيْسَرَهُمَا مَا لَمْ يَكُنْ إِثْمًا فَإِنْ كَانَ إِثْمًا كَانَ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنْهُ

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যখনই দুটি জিনিসের একটি গ্রহণের এখতিয়ার দেওয়া হত তখন তিনি অধিকতর সহজটিই গ্রহণ করতেন যদি তাতে গুনাহ না থাকতো। গুনাহ থাকলে সেখান থেকে তিনি সবচেয়ে দূরে অবস্থান করতেন।” [সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), অধ্যায়: ৬১/ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য, পরিচ্ছেদ: ৬১/২৩. নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণনা]

✪ ৫.‌ স্ত্রী-পরিবারের হক নষ্ট:

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তথ্য মতে ভারতের কেরালা প্রদেশ থেকে আগত ভাইটির পায়ে হেঁটে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে মোট সময় লেগেছে, মোট ৩৭০ দিন। এত দীর্ঘ সময় নিশ্চিতভাবেই তার দ্বারা তার স্ত্রী-পরিবার ও পিতা-মাতার (যদি তারা বেঁচে থাকে) হক আদায় করা সম্ভব হয়নি। অথচ তা তার জন্য ফরজ ছিল। অপ্রয়োজনীয় কাজে এত দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার ফলে তার স্ত্রী-পরিবার তাদের হক থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অথচ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
وَلِنِسَائِكُمْ عَلَيْكُمْ حَقًّا
“তোমাদের উপর তোমাদের স্ত্রীদের হক আছে।” [সুনান ইবনে মাজাহ, অধ্যায়: ৯/ বিবাহ, পরিচ্ছেদ: ৯/৩. স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার। সহিহ]

✪ ৬. যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় অপচয়:

একজন ইমানদারের জীবনে সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই আল্লাহ তাআলা বান্দার জীবন ও যৌবনকাল সম্পর্কে আখিরাতে প্রশ্ন করবেন। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে যৌবনের এত দীর্ঘ সময় অপচয় করার কারণে আল্লাহর কাছে হয়তো পাকড়াও-এর শিকার হতে হবে। কারণ বর্তমান আধুনিক যুগে উড়োজাহাজ ও যানবাহনের মাধ্যমে অল্প সময়ে যে কাজটা করা সম্ভব ছিল সেটা ইচ্ছাকৃত ভাবে না করে পায়ে হেঁটে এত দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য পথ পাড়ি দেওয়া জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ সময় অপচয়ের মধ্যে গণ্য হবে।

✪ ৭. প্রচুর শক্তির অপচয়:

এত দীর্ঘ সময় (প্রায় এক বছর বা ততোধিক সময় কাল) পায়ে হাঁটার ফলে এ সময় ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্যান্য হালাল কর্মের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা সম্ভব নয়। এমনকি অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগিও সঠিকভাবে করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
সুতরাং হালাল উপার্জন ও ইবাদত-বন্দেগি ইত্যাদি ক্ষেত্রে আল্লাহর দেওয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত যৌবনের প্রচুর মূল্যবান শক্তির অপচয় বলে গণ্য হবে।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لاَ تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ

“পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামতের দিন রবের নিকট থেকে আদম সন্তানের পা সরবে না: জিজ্ঞাসা করা হবে তার বয়স সম্পর্কে, কী কাজে সে তা অতিবাহিত করেছে, তার যৌবন সম্পর্কে কী কাজে সে তা বিনাশ করেছে; তার সম্পদ সম্পর্কে, কোথা থেকে সে তা অর্জন করেছে আর কী কাজে সে তা ব্যয় করেছে এবং সে যা শিখেছিল সে তদনুযায়ী কী আমল করেছে?” [সুনান আত তিরমিজি (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৪০/ কিয়ামত, পরিচ্ছেদ: কিয়ামত প্রসঙ্গে]

✪ ৮. তাদের এই কাজ অন্যদেরকেও এই পথে পা বাড়াতে প্ররোচিত করবে:

বিষয়টি বিভিন্ন নিউজ কভারেজ পাওয়ায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার কারণে অন্যান্য মানুষও এর দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। (যেমনটি: ইতোমধ্যে ফেসবুকে এ বিষয়ে একাধিক মানুষের আগ্রহ দেখা গেছে)। ফলে যে বা যারা এহেন কাজ করেছে তারা এ ক্ষেত্রে পথ প্রদর্শক বলে গণ্য হবে।
সুতরাং উপরোক্ত ক্ষয়-ক্ষতি, অনাবশ্যক কাজে যৌবনের মূল্যবান সময় ও শক্তির অপচয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রধানত তারাই দায়ী।

মোটকথা, ভারতের কেরালা প্রদেশ থেকে যে এবার পায়ে হেঁটে হজ পালন করেছে বা সম্প্রতি বাংলাদেশের কুমিল্লা থেকে যে ব্যক্তি ইতোমধ্যে হজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে তাদের এ কাজকে উত্তম বলা যাবে না বা সমর্থন করা যাবে না। বরং এহেন কাজকে অনুৎসাহিত করা উচিত। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।