ফকির-মিসকিনকে খাওয়ালে বা দান করলে আসলেই কি জান্নাত কিনে নেওয়া যায়

প্রশ্ন: আমাদের এক শাইখ সূরা তওবার ১১১ নাম্বার আয়াতের রেফারেন্স উল্লেখ করে বলেছেন যে, সালাত, সিয়াম, হজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার ইত্যাদি দ্বারা জান্নাত পাওয়া যায়; কেনা যায় না। কিন্তু ফকির-মিসকিনকে খাওয়ালে বা অসহায় মানুষকে দান করলে জান্নাত কেনা যায়। আর আল্লাহ বলেছেন যে, তোমাদের কাছে বিক্রি করার জন্যই আমি জান্নাত বানিয়েছি। টাকা দাও (দান করো) আর কিনে নাও-এ কথাগুলো কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কতটুকু সঠিক?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: এ বক্তব্য সঠিক নয়। এ সব কথাবার্তা কুরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা। মূলত: কুরআন-হাদিসে কোথাও এমন কথা বলা হয়নি।

নিম্নে এ ব্যাপারে বিশ্লেষণ পেশ করা হল:

❑ কোন আমলের বিনিময়েই জান্নাত লাভ করা সম্ভব সম্ভব নয়:

প্রকৃতপক্ষে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, জিহাদ এমনকি দান-সদকা ইত্যাদি কোন কিছুর বিনিময়েই জান্নাত লাভ করা সম্ভব নয়।
জান্নাত লাভ করার জন্য শিরক মুক্ত ইমান এবং বিদআত মুক্ত আমল করা অপরিহার্য কিন্তু এসব ইমান-আমল জান্নাতের মূল্য নয়। বান্দা যদি জান্নাতে প্রবেশ করে তাহলে তা হবে শুধুমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ; এটা তার কোনও আমলের বিনিময় নয়। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لَنْ يُدْخِلَ الْجَنَّةَ أَحَدًا عَمَلُهُ ‏”‏ ‏.‏ قَالُوا وَلاَ أَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ ‏”‏ وَلاَ أَنَا إِلاَّ أَنْ يَتَغَمَّدَنِيَ اللَّهُ مِنْهُ بِرَحْمَةٍ

“কারো আমলই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। তারা বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনিও কি নন? তিনি বললেন, আমিও নই। তবে যদি আল্লাহ তাআলা আমাকে তার রহমত দ্বারা ঢেকে নেন।” [সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৫৩/ কিয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নামের বিবরণ, পরিচ্ছেদ: ১৭. কোন ব্যক্তিই তার আমলের বিনিময়ে জান্নাতে যাবে না, বরং জান্নাতে যাবে আল্লাহর রহমতের মাধ্যমে]

❑ জান্নাতের মূল্য কত যে তা কিছু টাকা দান করেই তা কিনে নেওয়া সম্ভব?

জান্নাতের মূল্য কি এত কম যে, কিছু টাকা দান করলেই তার মূল্য পরিশোধ হয়ে যাবে বা তার বিনিময়ে তা ক্রয় করে নেওয়া যাবে? একশত, দুশ, এক হাজার, পাঁচ হাজার, পঞ্চাশ হাজার, পঞ্চাশ লক্ষ, একশ কোটি, হাজার কোটি, হাজার মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ইত্যাদি পরিমাণ টাকা আল্লাহর পথে দান করে কি জান্নাত কি কিনে নেওয়া সম্ভব? সারা দুনিয়ার সকল ধন-সম্পদ দ্বারাও কি জান্নাতের ক্ষুদ্রতম অংশ কেনা সম্ভব? কস্মিনকালেও তা কখনো সম্ভব নয়। কেননা জান্নাতের মূল্য কোন কিছু দ্বারা পরিশোধ যোগ্য নয়। সাহল ইবনে সাদ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি,

مَوْضِعُ سَوْطٍ فِي الْجَنَّةِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا، وَلَغَدْوَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوْ رَوْحَةٌ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا

“জান্নাতের মধ্যে একটা চাবুক পরিমাণ জায়গা দুনিয়া এবং তার মধ্যে যা কিছু আছে তার চাইতে উত্তম।” [সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৬৮/ কোমল হওয়া, পরিচ্ছেদ: ২৬৮৪. আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তাআলার বাণী: তোমরা জেনে রেখো, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া কৌতুক … ছলনাময়য় ভোগ, ৫৭: ২০]

– যদি টাকা দান করে জান্নাত ক্রয়ে করে নেওয়া সম্ভব হত তাহলে ধনীরা টাকার বিনিময়ে জান্নাত ক্রয় করে নিত। তাদের এত বেশি নেকির কাজ করার প্রয়োজন হতো না।

❑ সূরা তওবার ১১১ নাম্বার আয়াতে কী বলা হয়েছে?

মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ ٱللَّهَ ٱشۡتَرَىٰ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ أَنفُسَهُمۡ وَأَمۡوَٰلَهُم بِأَنَّ لَهُمُ ٱلۡجَنَّةَۚ يُقَٰتِلُونَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَيُقْتَلُونَ

“নিশ্চয় আল্লাহ্‌ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন (এর বিনিময়ে) যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে যু/দ্ধ করে, অতঃপর তারা হ/ত্যা করে এবং নি/হ/ত হয়” [সূরা তওবা: ১১১ ]

অর্থাৎ যে সব ইমানদার ব্যক্তিগণ আল্লাহর দ্বীনকে বুলন্দ করার উদ্দেশ্যে জিহাদের ময়দানে তাদের ধন-সম্পদ সব কিছু বিলীন করে নিজেদের জীবনটাকে পর্যন্ত বিলিয়ে দেয় তাদেরকে তিনি তাদের এই জান ও মালের প্রতিদান হিসেবে তাকে জান্নাত প্রদান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও এই জান-মাল আল্লাহর এবং জান্নাতও আল্লাহর। কিন্তু এর বিনিময়ে জান্নাত প্রদান করাও তাঁর অনুগ্রহ; এটি তার মূল্য নয়। মূলত: পুরস্কার ঘোষণার মাধ্যমে তিনি মুমিনদেরকে জিহাদে জান-মাল কুরবানি করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন।

❂ তাফসিরে ইবনে কাসিরে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,

خبر تعالى أنه عاوض عباده المؤمنين عن أنفسهم وأموالهم إذ بذلوها في سبيله بالجنة ، وهذا من فضله وكرمه وإحسانه ، فإنه قبل العوض عما يملكه بما تفضل به على عباده المطيعين له
“আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, মুমিন বান্দাগণ যখন তাদের জান ও মাল আল্লাহর পথে ব্যয় করবেন তখন তিনি এর বিনিময়ে তাদেরকে জান্নাত দিবেন। এটা তাঁর অনুগ্রহ, বদান্যতা এবং দানশীলতা।” [তাফসিরে ইবনে কাসির]

❂ আল মুখতাসার ফিত তাফসিরে বলা হয়েছে,

إن الله سبحانه اشترى من المؤمنين أنفسهم – مع أنهم ملكه؛ تفضُّلًا منه – بثمن غال هو الجنة، حيث يقاتلون الكفار لتكون كلمة الله هى العليا

“নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের নিকট উচ্চ মূল্যে তথা জান্নাতের বিনিময়ে তাদের জীবন ক্রয়ে করে নিয়েছেন-যদিও এর মালিকানা তাঁরই। কিন্তু এটি তাঁর অনুগ্রহ। কারণ তারা আল্লাহর বাণীকে উচ্চকিত করার উদ্দেশ্যে কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করে। ফলে তারা কাফেরদেরকে হ/ত্যা করে আর কাফেররাও তাদেরকে হ/ত্যা করে।”

মোটকথা, জান্নাত হল, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। আল্লাহ যে বান্দার উপর রাজি-খুশি হবেন তিনি তাকে দয়া করে তাতে প্রবেশ করার সুযোগ দিবেন। কিন্তু বান্দা কখনো কোন আমলের বিনিময়ে জান্নাত ক্রয় করে নিতে পারে না। তা সম্ভব নয়। অতএব “গরিব-মিসকিনকে খাওয়ালে বা দান-সদকা করলে জান্নাত কিনে নেওয়া যায়, আর আল্লাহ বলেছেন যে, তোমাদের কাছে বিক্রি করার জন্যই আমি জান্নাত বানিয়েছি, টাকা দাও আর কিনে নাও”-এসব কথাবার্তা কুরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা শামিল।

আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।