দুআ কবুল হওয়ার উদ্দেশ্যে সুরা ইয়াসিন খতম করার আমল কি হাদিস সম্মত

দুআ কবুল বা মনের ইচ্ছা পূরণের উদ্দেশ্যে সূরা ইয়াসিন খতম করার বিধান এবং সূরা ইয়াসিনের ফজিলতে বর্ণিত হাদিসগুলোর অবস্থা
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
প্রশ্ন: দুআ কবুল হওয়ার উদ্দেশ্যে সুরা ইয়াসিন খতম করার আমল কি হাদিস সম্মত?
আরও জানতে চাই, হাদিসের আলোকে সূরা ইয়াসিনের ফজিলত কতটুকু?
উত্তর:
প্রচলিত আছে যে, “সূরাটি ৪১ বার পাঠ করার পর দুআ করার পূর্বে ১১ বার দরুদে ইবরাহিম পাঠ করতে হয়। তারপর দুআ করলে আল্লাহ দুআ কবুল করেন।” কিন্তু এটা দলিল বহির্ভূত ও বানোয়াট কথা। এটি বিদআতিদের তৈরি করা ওজিফা।

প্রকৃতপক্ষে দুআ কবুল বা মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য সূরা ইয়াসিন খতম করার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোনও হাদিস নেই। কোনও সাহাবি থেকেও তা প্রমাণিত হয় নি। তাই তো বিশ্ববিখ্যাত আলেমে দীন সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. বলেন,
أن قراءة سورة يس لقضاء الأعمال بدعة
“কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে সূরা ইয়াসিন পাঠ করা বিদআত।”

❑ বানোয়াট হাদিস দ্বারা দলিল পেশ!

ইচ্ছা পূরণ, জীবনের নানা সঙ্কট নিরসন বা উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন সহজ করণের ক্ষেত্রে সূরা ইয়াসিন খতম করার ব্যাপারে নিম্নোক্ত হাদিসটি পেশ করা হয়:
يس لما قرئت له
“যে উদ্দেশ্যে সূরা ইয়াসিন পাঠ করা হবে তা পূরণ করা হয়।” বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে মিথ্যাচার। এটি আদতে কোনও হাদিস নয়।

✪ ইমাম সাখাবি বলেন, لا أصل له بهذا اللفظ “এই শব্দে বর্ণিত হাদিসটির কোনও ভিত্তি নেই।” [আল মাকাসিদুল হাসানা, হা/৭৪১]-
✪ কাজি যাকারিয়া বায়যাবির হাশিয়াতে বলেন, “এটি বানোয়াট।” [যেমনটি রয়েছে কাশফুল খাফা গ্রন্থে ২/২২১৫]
✪ মোল্লা আলি কারি হানাফি রহ বলেন, قيل لا أصل له أو بأصله موضوع “বলা হয়েছে, এর কোনও ভিত্তি নাই বা মূলত: এটি বানোয়াট।” [আল আসরুল মারফুআহ, ৩৭৭]
✪ শাইখ আলবানি বলেন, এটি বানোয়াট হাদিস। [যাইফুত তারগীব, ৮৮৫]

◯ ইবনে কাসির রাহ. বলেন, কতিপয় আহলে ইলম বলেছেন,
” أنَّ مِن خصائص هذه السورة أنها لا تُقرَأ عند أمر عسير إلا يسره الله تعالى
এই সূরা (সূরা ইয়াসিন) এর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল, যে কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে এটি পাঠ করা হবে আল্লাহ তা সহজ করে দিবেন।” [তাফসিরে ইবনে কাসির, ৩/৭৪২] কিন্তু এ কথার পক্ষেও কোনও হাদিস বা সাহাবিদের বক্তব্য কিংবা আমল নেই। এভাবে যদি দীনের বিষয়ে দলিল ছাড়া মানুষের মতামত, ফতোয়া, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি গ্রহণ করা হয় তাহলে ইসলামের প্রকৃত রূপ পরিবর্তিত হয়ে যাবে। (আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমিন।)

❑ সূরা ইয়াসিন এর ফজিলতে বর্ণিত কোনও হাদিসই সহিহ নয়:

প্রকৃতপক্ষে সূরা ইয়াসিনের ফজিলতে যে সব হাদিস বর্ণিত হয়েছে বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে সেগুলো একটিও সহিহ নয়।

এ বিষয়ে যে সকল হাদিস আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত আছে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ:
১. إن لكل شيء قلبا ، وقلب القرآن يس
“প্রতিটি বস্তুর অন্তর আছে। আর কুরআনের অন্তর হল সূরা ইয়াসিন।”
২. من قرأها فكأنما قرأ القرآن عشر مرات
“যে সূরা ইয়াসিন একবার পাঠ করল সে যেন সমস্ত কুরআন দশবার পাঠ করল।”
৩. من قرأ سورة ( يس ) في ليلة أصبح مغفورا له
“যে ব্যক্তি রাতে সূরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করবে সে ভোরে উঠবে ক্ষমা প্রাপ্ত অবস্থায়।”
৪. من داوم على قراءتها كل ليلة ثم مات مات شهيدا
“যে ব্যক্তি প্রতিনিয়ত সূরা ইয়াসিন পাঠ করবে অতপর মৃত্যু বরণ করবে যাবে সে শহিদ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে ।”
৫. من دخل المقابر فقرأ سورة ( يس ) ، خفف عنهم يومئذ ، وكان له بعدد من فيها حسنات
“যে ব্যক্তি গোরস্তানে প্রবেশ করে সূরা ইয়াসিন পাঠ করবে সে দিন কবর বাসীদের শাস্তি লাঘব করা হবে এবং পাঠকারীর জন্য কবরে যত লাশ আছে তাদের সমপরিমাণ সওয়াব লেখা হবে।”
বিজ্ঞ হাদিস বিশারদগণের দৃষ্টিতে এ হাদিসগুলো একটিও সহিহ নয়।
[দ্রষ্টব্য: ইবনুল জাওযী রচিত বিখ্যাত বানোয়াট হাদিস সংকলন আল মাউযুআত ২/৩১৩, শাওকানি রচিত আল ফাওয়ায়েদুল মাজমূআহ, হা/ ৯৭৯, ৯৪২]

মনে রাখতে হবে, যদি এ সূরা খতম করে দুআ করলে তা কবুলের নিশ্চয়তা থাকতো তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে এই মর্যাদা পূর্ণ এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আমলটি থেকে বঞ্চিত করতেন না।

সুতরাং আমাদেরকে এ সব বানোয়াট ও বিদআতি
আমল থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলা তৌফিক দান করুন। আমিন।

❑ দুআ কবুলের জন্য বিশুদ্ধ হাদিস সম্মত আমল:

আপনি কুরআনের যেখান থেকে সুবিধা হয় পাঠ করে অথবা নফল নামাজ, রোজা, দান-সদকা ইত্যাদি নেক আমল করার পর এসকল নেক আমলের ওসিলা ধরে আল্লাহর কাছে দুআ করতে পারেন। নেক আমলের ওসিলায় দুআ করলে তা কবুলের সম্ভাবনা থাকে। যেমন: এভাবে বলা, হে আল্লাহ আমার কুরআন খতম, কুরআন তিলাওয়াত, নামাজ, রোজা ও দান-সদকার ওসিলায় আমার দুআ কবুল করো, আমার সমস্যা দূর করে দাও, আমাকে সুস্থতা দান করো, আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করো ইত্যাদি।

এছাড়াও দুআর শর্তাবলি ঠিক রেখে দুআ কবুলের অধিক সম্ভাবনাময় সময় ও ক্ষেত্রগুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে দুআ করবেন। যেমন: ভোর রাতে, যে কোনও সালাতে সেজদা অবস্থায়, রোজা অবস্থায়, ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে, সফর অবস্থায়, আজান ও একামতের মাঝামাঝি সময়, জুমার দিন আসরের পর থেকে মাগরিবের মাঝামাঝি সময় ইত্যাদি। অনুরূপভাবে পিতামাতা ও নেককার-পরহেজগার ব্যক্তিদের দুআ নেওয়ার চেষ্টা করবেন। তাহলে আশা করা যায়, আল্লাহর রাব্বুল আলামিন দুআ কবুল করবেন ইনশাআল্লাহ
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।।