জিনেরা কি মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করে

প্রশ্ন: জিনেরা কি মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করে? এ থেকে বাঁচার উপায় কি?
উত্তর:
জিন হল, এক অদৃশ্য জগতের নাম। যাদের সম্পর্কে আমাদের সব কিছু বিস্তারিত জানা সম্ভব নয় আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহির মারফতে আমাদেরকে তাদের সম্পর্কে যতটুকু তথ্য প্রদান করেছেন তা ব্যতিরেকে।

যাহোক, জিন কর্তৃক মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করা প্রসঙ্গে আলেমগণ বলেন যে, তারা মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করতে পারে। কারণ তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ দু ধরণের জিন আছে। সুতরাং তাদের মধ্যে খারাপ জিন (শয়তান) গুলো মানুষের ক্ষয়ক্ষতি করার সর্বপ্রকার পন্থা অবলম্বন করে থাকে। জিন সম্পর্কে কুরআনে এসেছে,
وَأَنَّا مِنَّا الصَّالِحُونَ وَمِنَّا دُونَ ذَٰلِكَ ۖ كُنَّا طَرَائِقَ قِدَدًا ‎
“(জিনরা বলে) আমাদের কেউ কেউ সৎকর্ম পরায়ণ এবং কেউ কেউ এরূপ নয়। আমরা ছিলাম বিভিন্ন পথে বিভক্ত।” [সূরা জিন: ১১] অর্থাৎ তারা সৎকর্মশীল এবং পাপাচারী এ দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত।

❑ জিনেরা কেন মানুষের সম্পদ চুরি করে?

খারাপ জিন বা শয়তানরা মানুষকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং বিভিন্নভাবে তাদেরকে বিরক্ত করে। প্রকৃতপক্ষে তারা বনি আদমের ক্ষতি করার এমন কোনও পথ ও পদ্ধতি বাকি রাখে না যা তারা করে না। কারণ তারা তাদের পূর্ব ঘোষিত প্রকাশ্য শত্রু।

কখনো খারাপ জিনেরা জিন বশকারী যাদুকর নামক দাজ্জালদের নির্দেশে মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করে আবার কখনো মানুষের ক্ষতি সাধন বা তাদরকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যে এমনটি করে-এতে তাদের নিজেদের কোনও লাভ থাকুক বা না থাকুক। যেমন: ইবনে তায়মিয়া রাহ. বলেন,
إن للجن والشياطين لذة في الشر والفتن، يحبون ذلك وإن لم يكن فيه منفعة (الفُرقان بينَ الحقِّ والباطلِ)
“জিন-শয়তানরা অনিষ্ট সাধন এবং ফেতনা সৃষ্টি করে মজা পায়। তারা এটা করতে পছন্দ করে-যদিও এতে তাদের কোনও উপকার না থাকে।” [আল ফুরকানু বাইনাল হাক্বি ওয়াল বাতিল]

❑ জিনদের চুরি করার পক্ষে হাদিসের দলিল:

জিন কর্তৃক মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করার পক্ষে আলেমগণ আবু হুরায়রা রা. যখন যাকাতের খাদ্যদ্রব্য পাহারায় নিয়োজিত ছিলেন তখন শয়তান কর্তৃক তা চুরি করার লম্বা ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন-যা সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে।

[সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ৪০/ ওয়াকালাহ (প্রতিনিধিত্ব), পরিচ্ছেদ: ৪০/১০. যদি কেউ কোন লোককে প্রতিনিধি নিয়োগ করে এবং ঐ প্রতিনিধি কোন কিছু বাদ দেয় অতঃপর প্রতিনিধি নিয়োগকারী তা অনুমোদন করে তবে এটা বৈধ। আর প্রতিনিধি যদি নির্দিষ্ট মেয়াদে কাউকে ধার প্রদান করে তবে তা বৈধ।]

সহিহ বুখারির ভাষ্যকার ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. উক্ত হাদিস থেকে বেশ কিছু ফায়দা তুলে ধরেছেন। যেমন:
وَأَنَّ الْجِنّ يَأْكُلُونَ مِنْ طَعَام الْإِنْس , وَأَنَّهُمْ يَتَكَلَّمُونَ بِكَلَامِ الْإِنْس , وَأَنَّهُمْ يَسْرِقُونَ وَيَخْدَعُونَ , وَفِيهِ فَضْل آيَة الْكُرْسِيّ وَفَضْل آخَر سُورَة الْبَقَرَة , وَأَنَّ الْجِنّ يُصِيبُونَ مِنْ الطَّعَام الَّذِي لَا يُذْكَر اِسْم اللَّه عَلَيْهِ ” انتهى مختصرا .

– জিন মানুষের কিছু খাবারও খায়,
– মানুষের কথার মতও কথা বলে,
– তারা চুরি ও প্রতারণা করে।
– এ হাদিসে আয়াতুল কুরসি ও সূরা বাকারার শেষাংশের ফযিলত রয়েছে।
– যে খাবারে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় না তাতে শয়তান সংক্রমণ করে। [ফাতহুল বারি-সংক্ষেপায়িত]

❑ জিনের চুরি থেকে বাঁচার উপায়:

জিনের চুরি ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় হল,

– আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা (তথা আউযুবিল্লাহি মিনাশ শয়তানির রাজীম পাঠ করা) এবং জিন-শয়তান থেকে আত্মরক্ষার মাসনুন আমল সমূহ করা। যেমন:

– যখন বাড়িতে প্রবেশ করবেন তখন বাড়িতে প্রবেশের দুআ পাঠ করবেন। তাহলে শয়তান বাড়িতে প্রবেশ করতে পারবে না আর বিসমিল্লাহ বলে আপনার মূল্যবান মালামাল সিন্দুক বা সংরক্ষিত কোনও স্থানে রেখে তার মুখ বন্ধ করবেন। তাহলে শয়তান বন্ধ মুখ খুলে তা চুরি করতে পারবে না। যেমন; হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

◍ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِذَا دَخَلَ الرَّجُلُ بَيْتَهُ، فَذَكَرَ اللَّهَ عِنْدَ دُخُولِهِ وَعِنْدَ طَعَامِهِ، قالَ الشَّيْطَانُ: لا مَبِيتَ لَكُمْ، وَلَا عَشَاءَ
“যখন কোন ব্যক্তি তার গৃহে প্রবেশের সময় ও খাবারের সময় আল্লাহকে স্মরণ করে তখন শয়তান (নিজ সঙ্গীদেরকে) বলে, তোমাদের কোনো রাত কাটানোর জায়গা নেই, তোমাদের রাতের কোনও খাবার নেই।” [সহিহ মুসলিম, হা/২০১৮।]

◍ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,
غَطُّوا الإِنَاءَ وَأَوْكُوا السِّقَاءَ وَأَغْلِقُوا الْبَابَ وَأَطْفِئُوا السِّرَاجَ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ لاَ يَحُلُّ سِقَاءً وَلاَ يَفْتَحُ بَابًا وَلاَ يَكْشِفُ إِنَاءً فَإِنْ لَمْ يَجِدْ أَحَدُكُمْ إِلاَّ أَنْ يَعْرُضَ عَلَى إِنَائِهِ عُودًا وَيَذْكُرَ اسْمَ اللَّهِ فَلْيَفْعَلْ فَإِنَّ الْفُوَيْسِقَةَ تُضْرِمُ عَلَى أَهْلِ الْبَيْتِ بَيْتَهُمْ ‏”‏
“তোমরা (রাতের বেলা) পাত্রগুলো ঢেকে দাও, মশকগুলো (চামড়ার তৈরি পানি রাখার পাত্র বিশেষ) এর মুখ আটকিয়ে দাও, ঘরের দরজা বন্ধ করে দাও এবং চেরাগ নিভিয়ে দাও। কারণ, শয়তান মশকের বাঁধন খুলতে পারে না, দরজা খুলতে পারে না এবং পাত্রও উন্মুক্ত করতে পারে না। তবে তোমাদের কেউ পাত্র ঢাকার জন্য একটা কাঠি ছাড়া অন্য কিছু না পেলে যেন তাই রাখে এবং সাথে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে (বিসমিল্লাহ পাঠ করে)। কেননা ইঁদুর চেরাগের আগুন থেকে লোকজন সহ বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।”
[সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ৩৭/ পানীয় দ্রব্য, পরিচ্ছেদ: ১১. পাত্র আচ্ছাদিত করা বা ঢেকে রাখা, মশকের মুখ আঁটকে দেওয়া, দরজা বন্ধ করা ও এ সময়ে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা, ঘুমের সময় চেরাগের আগুন নিভিয়ে দেয়া এবং সন্ধ্যার পর শিশু ও গৃহপালিত জন্তুগুলোকে (বাড়িতে) আটকে রাখা উত্তম]

– সকাল-সন্ধ্যার দুআ ও জিকিরগুলো পাঠ করা,
– ঘরে সূরা বাকারা তিলাওয়াত করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الَّذِى تُقْرَأُ فِيهِ سُورَةُ الْبَقَرَةِ
“যে ঘরে সূরা বাকারা পাঠ করা হয় শয়তান সে ঘর থেকে পলায়ন করে।” [সহীহ মুসলিম। অনুচ্ছেদ: বাড়িতে নফল নামায পড়া মুস্তাহাব তবে মসজিদেও পড়া জায়েজ। হা/১৮৬০ আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত]
– সন্ধ্যার সময় আয়াতুল কুরসি পাঠ করা (যেমনটি শয়তান কর্তৃক যাকাতের খেজুর চুরির হাদিসে বর্ণিত হয়েছে) ইত্যাদি।
আল্লাহ আমাদেরকে জিন-শয়তানের সর্ব প্রকার অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।