টিনের চালে গরু, উট, মোরগ ইত্যাদির ছবি থাকলে করণীয়

প্রশ্ন: সহিহ বুখারির হাদিসে উল্লেখ আছে, “যে ঘরে ছবি, মূর্তি ও কুকুর থাকে সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না।” প্রশ্ন হল, আমাদের দেশের টিনের ঘরগুলোতে টিন কোম্পানির প্রতীক থাকে (গরু, ঘোড়া, মোরগ ইত্যাদি)। এ সমস্ত ছবি থাকার কারণে কি ঐ ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করবে? আর যে মসজিদে এমন টিন থাকে সে মসজিদে কি সালাত শুদ্ধ হবে?

উত্তর:
আমরা জানি যে, ইসলামের দৃষ্টিতে জীবজন্তুর ছবির ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত হাদিস রয়েছে। যেমন:

◈ আবু তালহা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لَا تَدْخُلُ الْمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيهِ كَلْبٌ، وَلَا صُورَةٌ
“ফেরেশতাগণ ঐ ঘরে প্রবেশ করে না, যে ঘরে কুকুর অথবা ছবি থাকে। (সুনানে আন-নাসায়ী হা/৫৩৪৭-সহিহ)

◈ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্ত্রী মাইমুনা রা. আমার নিকট বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আমার সাথে রাতে সাক্ষাত করার ওয়াদা করেছিলেন কিন্তু সাক্ষাত করেন নি।
অতঃপর তাঁর মনে পড়লো যে, আমাদের খাটের নীচে একটি কুকুর ছানা আছে। তিনি এটাকে বের করে দিতে আদেশ দিলে তা বের করা হল। অতঃপর তিনি নিজেই পানি দিয়ে সে স্থানটা ধুয়ে ফেলেন।
এরপর জিবরাঈল আ. তাঁর সাথে সাক্ষাতের সময় বললেন: “যে ঘরে কুকুর এবং ছবি থাকে সে ঘরে আমরা কখনো প্রবেশ করি না।”

সকাল বেলা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুকুর মারতে আদেশ দিলেন। এমনকি ছোট বাগান পাহারার কুকুর হত্যা করারও আদেশ দেন, বড় বাগানের পাহারাদার কুকুর ছাড়া। (সুনানে আবু দাউদ, অধ্যায়: পোশাক-পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ-৪৭ ছবি সম্পর্কে, হা/৪১৫৭-সহিহ)

◈ তিনি আরও বলেছেন,
أَنْ لاَ تَدَعَ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلاَّ سَوَّيْتَهُ وَلاَ تِمْثَالاً إِلاَّ طَمَسْتَهُ ‏
“কোন উঁচু কবরকে (মাটি) সমান করা ব্যতীত ছাড়বে না, আর কোন প্রতিকৃতি বিধ্বংস করা ব্যতীত ছাড়বে না।” (সহিহ মুসলিম, হা/৯৬৯ ও তিরমিজী হাদিস নম্বর: ১০৪৯ [আল মাদানি প্রকাশনী]) সহিহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় রয়েছে:
وَلاَ صُورَةً إِلاَّ طَمَسْتَهَا
“আর কোনও ছবি পেলে তা মুছে দিবে।” এ মর্মে বহু হাদিস বিদ্যমান রয়েছে।

➤ উল্লেখ্য যে, মুহাদ্দিসগণ বলেন, উল্লেখিত হাদিসগুলোতে যে সকল ফেরেশতা প্রবেশ করবে না বলা হয়েছে সেগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য হল, রহমত ও বরকতের ফেরেশতাগণ। অর্থাৎ কোনও ঘরে প্রাণীর ছবি, মূর্তি, প্রতিকৃতি ও কুকুর থাকলে ঐ সকল ফেশরতাগণ তাতে প্রবেশ করে না যারা রহমত ও বরকত নিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে আগমন করে থাকেন। কিন্তু বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাগণ তাদের দায়িত্ব পালনার্থে অবশ্যই প্রবেশ করে- ঘরে যতই ছবি, মূর্তি ও কুকুর থাকুক না কেন। যেমন: প্রাণ সংহারের দায়িত্বে নিয়োজিত মালাকুল মওত বা মৃত্যু দূত, তাঁর সঙ্গে আগত ফেরেশতা মণ্ডলী, মানুষের কার্যবিবরণী লেখার দায়িত্ব প্রাপ্ত কিরামান কাতিবীন বা সম্মানিত লেখক ফেরেশতাবৃন্দ ইত্যাদি।

❑ টিনের চালে গরু, উট, হাতি, মোরগ ইত্যাদির ছবি:

ঢেউ টিন কোম্পানির ট্রেডমার্ক হিসেবে ব্যবহৃত গরু, ষাঁড়, উট, অ্যারাবিয়ান হর্স, হাতি মোরগ, মুরগি ইত্যাদি ছবিগুলোর মুখাবয়ব সাধারণত অস্পষ্ট হয় অর্থাৎ এগুলোর চোখ, মুখ, নাক, কান ইত্যাদি স্পষ্ট হয় না। এমন হলে তাতে কোন সমস্যা নেই। এ জাতীয় ছবিগুলো হাদিসে নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত হবে না। কেননা হাদিসে এসেছে,
مُر برأسِ التِّمْثَالِ يَقْطَعُ فَيَصِيْرُ عَلي هَيئَةِ الشَّجَرَةِ
“আপনি মূর্তির মাথা কেটে দিতে বলেন, ফলে উহা গাছের আকৃতি হয়ে যাবে।” (আবু দাউদ-সহিহ, শাইখ আলবানি )

ইবনুল কুদামা রহঃ বলেন,
فإن قَطَعَ رأسَ الصورة ذهبت الكراهة . قال ابن عباس : الصورة الرأس ، فإذا قطع الرأس فليس بصورة . وحكي ذلك عن عكرمة ” انتهى
“যদি ছবির মাথা কেটে নেয়া হয় তাহলে আর অ পছন্দনীয় হওয়ার বিষয়টি থাকবে না। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, “মাথাই হল, ছবি। যদি মাথা কেটে নেয়া হয় তাহলে আর ছবি থাকলো না।” এমন কথা ইকরিমা রহঃ থেকেও বর্ণিত হয়েছে।” [আল মুগনি ৮/১১১]
সুতরাং যদি ঘরের টিনে থাকা কোন প্রাণীর ছবির মাথার অংশ বা মুখাবয়ব তথা চোখ, মুখ, নাক, কান ইত্যাদি পরিষ্কার বুঝা যায় তাহলে কেবল মাথা বা মুখমণ্ডলের অংশটা কোন কিছু দ্বারা ঘুষে মুছে ফেলতে হবে অথবা কালি লাগিয়ে ঢেকে দিতে হবে-যেন তা আর দেখা না যায়। তাহলে আর কোনও সমস্যা থাকবে না ইনশাআল্লাহ।

❑ ঘরে প্রাণীর ছবি থাকলে তাতে সালাত আদায়ের বিধান কি?

ঘরে জীব-জন্তুর ছবি ও মূর্তি থাকলে সেগুলো ঘর থেকে বের করতে হবে অথবা টিনের চাল, খাট-পালঙ্ক, আলমারি, প্লেট, মগ, গ্লাস ও আসবাব-পত্রে যদি স্পষ্ট জীবজন্তুর বা কার্টুনের ছবি থাকে তাহলে কমপক্ষে সেগুলোর মাথা ও মুখমণ্ডল কালি বা অন্য কিছু দিয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করতে হবে যেন মুখাবয়বের চিহ্ন অবশিষ্ট না থাকে অথবা সেগুলো কস্টেপ কিংবা চাদর, কাপড় ইত্যাদি দ্বারা ঢেকে রাখার চেষ্টা করতে হবে।

তা সম্ভব না হলে অন্য ঘরে ঘরে সালাত আদায় করার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু তাও সম্ভব না হলে ঐ ঘরেই সালাত আদায় করা জায়েজ। অর্থাৎ ঘরে ছবি-মূর্তি থাকা অবস্থায়ও সালাতের সঠিক নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করে সালাত আদায় করা হলে তা সহিহ হবে ইনশাআল্লাহ। এ ক্ষেত্রে এমনভাবে দাঁড়াতে হবে যে, এগুলো যেন কিবলার দিকে বা সরাসরি নামাজির সম্মুখে না থাকে।

শাইখ বিন বায রহঃ বলেন,
وتكره الصلاة في غرفة فيها صور معلقة أو منصوبة، خصوصا إذا كانت في قبلة المصلي، والصلاة صحيحة.
“যে ঘর ছবি ঝুলিয়ে বা স্থাপন করে রাখা আছে সে ঘরে সালাত আদায় করা মাকরুহ (অ পছন্দনীয়)। বিশেষ করে যদি তা নামাজির সম্মুখে থাকে। অবশ্য (এ অবস্থায়ও) সালাত সহিহ হবে।”
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬◈◍◈▬▬▬▬
আল্লাহু আলাম।
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।