টাকা বনাম খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায়ের ক্ষেত্রে ৮ টি পয়েন্টে একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

এ ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত এই আটটি পয়েন্ট হয়তো আপনাকে নতুন করে ভাবতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে ইনশাআল্লাহ।
নিম্নে সংক্ষেপে সেগুলো উপস্থাপন করা হলো:

✅ ১. প্রতিবছর রমজানের শেষে বহু মানুষ আলেম-উলামা ও মসজিদের ইমামদেরকে অস্থির হয়ে প্রশ্ন করতে থাকে, “হুজুর, এবারের ফিতরা কত টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে? শাইখ, এবারের ফিতরা কত টাকা? মাওলানা সাহেব, এখনো কি ঠিক হয়েছে এ বছর কত টাকা ফিতরা দিতে হবে? ইত্যাদি।
মানুষ এ বিষয়ে অনেক পেরেশান থাকে। তারা বিভিন্নভাবে তা জানার চেষ্টা করে। মনে হচ্ছে, আসলেই ইসলাম আগে থেকে এর কোন সমাধান দেয়নি। তাই সাধারণ মানুষ প্রতিবছর ইসলামি ফাউন্ডেশন, অমুক সংগঠন কিংবা অমুক মাদরাসার ফতোয়া বোর্ড কী সিদ্ধান্ত দেয় সেটা জানার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে! অথচ ইসলাম মানুষকে এই অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিয়েছে ১৪০০ বছর পূর্বেই। অর্থাৎ ফিতরার পরিমাণ আগে থেকেই নির্ধারিত। তা হলো, এক সা পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য। (যা বর্তমানে আড়াই বা তিন কেজি দেশের প্রধান খাদ্যদ্রব্য। (যেমন: আমাদের দেশে, চাল)। যা কখনো পরিবর্তনযোগ্য নয়।
সাধারণ মানুষকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে এই অস্থিরতার মধ্যে ফেলে রাখার পেছনে দায়ী কারা? মূলত আমাদের সমাজের এক শ্রেণির আলেম-ওলামা এবং মসজিদের ইমামগণই এ জন্য দায়ী। কারণ তারা সর্বসাধারণের মাঝে এই খাদ্যদ্রব্য দানের বিষয়টি প্রচার করলে মানুষ এমন অস্থিরতা, দ্বিধা-সংশয়‌ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে হাবুডুবু খেত না।

✅ দুই. বর্তমানে একদল মানুষকে এই যুক্তি দিতে দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহর রাসুলের যুগে খাদ্যদ্রব্যকে কারেন্সি বা নগদ অর্থের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যার দলিল হিসেবে তারা, হিজামা কারীকে খাদ্যদ্রব্য দ্বারা পারিশ্রমিক দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে থাকেন। হ্যাঁ, এ বিষয়টি আমরা অস্বীকার করি না। তৎকালীন সময়ে দিনার-দিরহাম, দানেক, কিরাত নামক বিভিন্ন ক্যাটাগরির মুদ্রার প্রচলন থাকলেও কখনো কখনো খাদ্যদ্রব্য দ্বারাও পারিশ্রমিক দেওয়া হতো।‌
কিন্তু ফিতরার আদায়ের ক্ষেত্রে নির্ধারিত এক সা পরিমাণ যেসব খাদ্যদ্রব্যের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো কোনভাবেই নগদ মূল্যের বিকল্প নয়। কেননা লক্ষ্য করুন, হাদিসে বর্ণিত খাদ্যদ্রব্য গুলোর মূল্যমান এক সমান নয়।
এক সা জব অথবা গম কি কখনো এক সা কিসমিস অথবা পনিরের সমান হতে পারে? খেজুর আর গম বা জবের বাজার মূল্য কি সমান? কখনোই নয়। আগেও ছিল না। এখনও নেই। এখান থেকে প্রতিমান হয় যে, খেজুর জব, গম, পনির, কিসমিস ইত্যাদি সমমূল্যের না হওয়ার পরেও সবকিছুই ‘এক সা’ পরিমাণ নির্ধারণের বিষয়টি নিছক একটি ইবাদত‌।
অতএব ভুয়া যুক্তি খাটিয়ে এগুলোকে কারেন্সি বানানোর পাঁয়তারা একদমই অগ্রহণযোগ্য।

✅ তিন. বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক এবারের (২০২৩) ঘোষিত ফিতরার পরিমাণ সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬৪০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা নির্ধারণ নিতান্তই অযৌক্তিক এবং ইসলামি শরিয়তের একটি বিধানকে নিজেদের মতো অপব্যাখ্যা করার শামিল। একই বিধানের ক্ষেত্রে কেউ দিবে মাত্র ১১৫ টাকা আর কেউ দিবে ২৬৪০ টাকা-এমন অদ্ভুত নীতি ইসলাম সম্মত হতে পারে না। বরং সঠিক হল, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ফিতরার পরিমাণ এক ও অভিন্ন হওয়া। যেমনটি মানত ভঙ্গের কাফফারা, কসম ভঙ্গের কাফফারা, দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাসের কাফফারা, রোজা রাখতে অক্ষম ব্যক্তির ফিদিয়া, হজের ক্ষেত্রে ফিদিয়া ও দম, রক্তপন
ইত্যাদি ক্ষেত্রে সকলের জন্য ইসলামের বিধান এক ও অভিন্ন। এক্ষেত্রে ধনী-গরিবের মাঝে কোনো তারতম্য নেই। সুতরাং রোজার ফিতরার ক্ষেত্রেও সর্ব শ্রেণির মুসলিমের বিধান এক হবে-এটাই যৌক্তিক‌। আর বাস্তবে ইসলামে তাই বলা হয়েছে।

✅ চার. সুন্নাহ অনুসরণের মধ্যে দেশ ও দেশের মানুষের জন্যই কল্যাণকর।কীভাবে? আমাদের বাংলাদেশে প্রায় ১৫ কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠীর জনপ্রতি আড়াই বা তিন কেজি পরিমাণ চাল দেওয়ার বিধান বাস্তবায়িত হলে বাজারে এত বিশাল পরিমাণ চালের যোগান দেওয়ার জন্য দেশে কী পরিমাণ চাষাবাদ করার প্রয়োজন হতো? কী পরিমাণ আবাদি জমির ব্যবহার হতো? কী পরিমাণ শ্রমিক কাজ পেতো? কত মানুষকে এর পেছনে শ্রম ব্যয় করতে‌ হতো? একটু হিসাব করে দেখুন। এর মাধ্যমে মূলত আমাদের কৃষক, শ্রমিক এবং চাষাবাদ, উৎপাদন, পরিবহন ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট সর্বশ্রেণির ব্যবসায়ী উপকৃত হতো। সমৃদ্ধ হতো দেশের অর্থনীতি এবং আরো বেশি সচল হতো অর্থনীতির চাকা। পক্ষান্তরে টাকা দ্বারা ফিতরা দেওয়ার ফলে কেবলমাত্র জন থেকে জনে অর্থ হাত বদল হয়। ফলে দেশের সাধারণ মানুষ এবং দেশের অর্থনীতি উৎপাদনমুখী বিরাট সুফল থেকে বঞ্চিত হয়।

✅ পাঁচ. টাকা দ্বারা ফিতরা আদায়ের ফলে ফিতরা গ্রহণকারী ব্যক্তি টাকা হাতে পেয়ে বিড়ি, সিগারেট,‌ মদ-গাজা বা হারাম বস্তু ক্রয়ের সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি নিজে গুনাহগার হওয়ার পাশাপাশি তার পরিবারের অন্য সদস্যগণ এর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পক্ষান্তরে খাদ্যদ্রব্যে এই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। সাধারণত খাদ্যদ্রব্য দ্বারা পরিবারের সকলেই উপকৃত হয়। অবশ্যই আল্লাহর প্রত্যেকটি বিধানের মধ্যেই হেকমত রয়েছে এবং সেগুলোতে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে যদি তারা তা বুঝতো।

✅ ছয়. ফিতরার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, গরিব-অসহায় মানুষের খাদ্য সংস্থান-যেমনটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ গরিব-অসহায় মানুষ যেন ঈদের দিন অভ্যুক্ত না থেকে যায়। মুসলিমদের জাতীয় উৎসবের দিনে তার বাড়িতে যেন কমপক্ষে কিছু খাবার মজুদ থাকে। সেই খাবার খেয়ে হলেও যেন ঈদের মাঠে যেতে পারে। ‌আমরা জানি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন খেজুর খেয়ে তারপরে ঈদের মাঠে গেছেন। অতএব ওই গরিব মানুষটিও যেন ফিতরার মাধ্যমে প্রাপ্ত খাবার খেয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম-এর এই সুন্নাহটি পালনের সুযোগ পায়। এটি খাদ্য দ্রব্য দ্বারা ফিতরার অন্যতম একটি উপকারিতা।

✅ সাত. ইসলামের বিধি-বিধানগুলো বৈচিত্র্যময়। এই ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যময়তার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন উপকারিতা এবং স্বাদ রয়েছে। তাই‌ দেখা যায়, ইসলাম সম্পদের জাকাতের জন্য অর্থ দেওয়াকে আবশ্যক করেছে। অর্থ ছাড়া অন্য কিছু দেওয়া জায়েজ নেই। যেন মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী তা খরচ করতে পারে। পক্ষান্তরে রমজান শেষে মানুষের গুনাহ মোচন এবং গরিব-অসহায় মানুষের খাবার হিসেবে খাদ্যদ্রব্য নির্ধারণ করেছে। এটি ইবাদত গত বৈচিত্রের একটি উদাহরণ। সুতরাং যাকাতের ক্ষেত্রে যেমন খাদ্যদ্রব্য বা অন্য কিছু ক্রয় করে দেওয়া জায়েজ নেই তেমনি ফিতরার ক্ষেত্রে খাদ্যদ্রব্য ছাড়া অন্য কিছু দেওয়া জায়েজ নেই (বিশেষ প্রয়োজন হলে ভিন্ন কথা)।

✅ আট. এক দুঃখজনক নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম-ওলামাগণ টাকা দ্বারা ফিতরা দেওয়ার ফতোয়া প্রচারের ফলে খাদ্যদ্রব্য দ্বারা যে ফিতরা দেওয়া সুন্নত (যে বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই) সাধারণ মানুষ সেটাই ভুলতে বসেছে। যার কারণে বহু মানুষ আদৌ জানে না যে, খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফিতরা দেওয়া যায়। এবং যারা ফিতরা গ্রহণ করে তারাও অধিকাংশই টাকা ছাড়া অন্য কিছু নিতে নারাজ। এভাবেই আমাদের সমাজে জায়েজের ফতোয়া দিয়ে সুন্নতকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এইসব বিবেক প্রসূত ফতোয়ার মাধ্যমে-যা খুবই দুঃখজনক। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন।

পরিশেষে বলবো, নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রত্যেকটি বিধানে‌ রয়েছে গভীর হেকমত ও প্রজ্ঞা যে সম্পর্কে মানুষ খুব সামান্যই জ্ঞান রাখে।
অতএব মানুষের তৈরি করা নানা যুক্তি মতবাদের পিছনে না ছুটে আমরা আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করি। এতেই ইনশাআল্লাহ আমরা দুনিয়া ও আখেরাতে অবারিত কল্যাণের অধিকারী হবো।
আল্লাহ সকলকে তৌফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।