গরুর গোস্ত, দুধ ও দুগ্ধ জাতীয় খাবার, ডিমের কুসুম ইত্যাদিতে রোগ-ব্যাধি ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকলে সেগুলো গ্রহণের ব্যাপারে ইসলামের বিধান কি?

প্রশ্ন: ডাক্তাররা বর্তমানে অসংখ্য খাবারের অপকারী দিক তুলে ধরছে-যেমন: ডিমের কুসুম, দুধ ও দুধের সর, চর্বি জাতীয় খাবার ইত্যাদি। বলা হচ্ছে, এগুলোতে হার্ট এটাকের ঝুঁকি বা অন্যান্য রোগের ঝুঁকি আছে। কিন্তু আল্লাহ বলছেন, যা হালাল তা তোমরা খাও। এখন প্রশ্ন হল, উক্ত খাবারগুলো কোন পদ্ধতিতে খাওয়া উচিৎ বা কখন এগুলো থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়?

উত্তর:

হালাল প্রাণীর গোস্ত, চর্বি, হাড্ডি, দুধ ও দুধ থেকে তৈরি দই, দুধের সর, ঘি, মাখন সহ নানা উপাদেয় খাবার এবং হাস, মুরগি ও হালাল পাখির ডিম ইত্যাদি আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য হালাল করেছেন। এগুলো মানব দেহে পুষ্টি সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং উত্তম রিজিক।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
كُلُوا مِن طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ
“সেসব পবিত্র বস্তু তোমরা ভক্ষণ কর, যা আমি তোমাদেরকে রিজিক হিসেবে দান করেছি।” (সূরা বাকারা: ৫৭)

তিনি আরও বলেন,
وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ
“তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষণা করেন ও নিষিদ্ধ করেন নিকৃষ্ট বস্তুসমূহ।” (সূরা আরাফ: ১৫৭)

❑ ইসলামে কম পরিমাণে খাদ্য গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়েছে:

হালাল খাদ্যদ্রব্য যতই পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হোক না কেন তা পরিমাণ মত ও নিয়ম মাফিক গ্রহণ করতে হবে। সীমাতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত খাবার থেকে বিরত থাকা জরুরি। কেননা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক। বহু হাদিসে কম খাওয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এবং বেশি খাওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন:

মিকদাম ইবনে মাদিকারিব রা. থেকে মরফু হিসেবে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
مَا ملأَ آدمِيٌّ وِعَاءً شَرًّا مِنْ بَطنٍ، بِحَسْبِ ابنِ آدمَ أُكُلاتٌ يُقِمْنَ صُلْبَهُ، فإِنْ كَانَ لا مَحالَةَ فَثلُثٌ لطَعَامِهِ، وثُلُثٌ لِشرابِهِ، وَثُلُثٌ لِنَفَسِهِ رواه الترمذي وقال: حديثٌ حسنٌ.

“মানুষ পেট থেকে অধিক নিকৃষ্ট কোনও পাত্র পূর্ণ করে না। মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারে এমন কয়েক লোকমা খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হলে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।” (তিরমিযী, ইবনে মাজা, মুসনাদে আহমদ-সনদ সহিহ)

➧ ব্যাখ্যা:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে চিকিৎসা শাস্ত্রের একটি মূলনীতি জানাচ্ছেন, আর তা হল, একটি সংরক্ষণ পদ্ধতি, যার দ্বারা মানুষ তার স্বাস্থ্য সংরক্ষণ করে, তা হচ্ছে অল্প খাওয়া; বরং এ পরিমাণ ভক্ষণ করবে যা তার ক্ষুধা দূরীভূত করে এবং তাকে যাবতীয় কাজ করতে সহায়তা করে। যেসব পাত্র পূর্ণ করা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হল পেট; যেহেতু পূর্ণ পেট থেকে মৃত্যু ঘটানোর মত অনেক রোগ নগদে-বিলম্বে-প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সৃষ্টি হয় যা গণনা করে শেষ করা যাবে না।
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি মানুষকে তৃপ্তির সাথে খেতেই হয় তাহলে সে যেন পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখে যাতে. তার কোনও অসুবিধা না হয় বা দ্বীন ও দুনিয়ার কোনও ওয়াজিব পালনে অলসতা না আসে। (উৎস: hadeethenc ডট কম)
যাহোক, একজন মানুষ কম খেয়েও যদি সুস্থ ও সবল থাকে তাহলে তাই যথেষ্ট। কিন্তু বেশি খেয়ে শরীর মোটা করলেই তাকে সুস্থ বলা যায় না। বরং মোটা হওয়াটাই একটা সমস্যা। যা শরীরে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি সৃষ্টির কারণ বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ সতর্ক করেছেন।

❑ যে সব খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত তা সীমিত আকারে বা প্রয়োজনে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা কর্তব্য:

স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে যদি প্রমাণিত হয় যে, বিশেষ কোনও খাবার বিশেষ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর আর সে ব্যাপার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ডাক্তারগণ পরিপূর্ণভাবে পরিত্যাগ বা সীমিত আকারে গ্রহণের পরামর্শ দেন তাহলে তা অনুসরণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কেননা, এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, সকলের স্বাস্থ্যগত অবস্থা, খাদ্য চাহিদা, রুচি, হজমশক্তি, ধারণ ক্ষমতা এক রকম নয়। কোনও খাদ্য দ্রব্য কারও জন্য উপকারী হলে অন্যের জন্য ক্ষতিকারক হতেও পারে। সুতরাং যে খাবারে কারও ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে তার জন্য তা পরিহার করাই কর্তব্য।

মোটকথা, একজন মানুষ সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় এ সকল পুষ্টিকর খাদ্য পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করতে পারে। এতে কোনও আপত্তি নেই। তবে যদি বিশেষ কারণে কোন খাবার তার জন্য ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয় তাহলে তা হতে বিরত থাকবে। অর্থাৎ বিষয়টি দুনিয়াবি। এ ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ডাক্তারদের কথা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার দাবী রাখে।

কেউ যদি বিশেষ খাদ্যদ্রব্য তার জন্য মারাত্মক ক্ষতি ও স্বাস্থ্য হুমকি জেনেও তা গ্রহণ করে তাহলে সে প্রকারান্তরে নিজের নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিল। অথচ মহান আল্লাহ আমাদেরকে তা নিষেধ করেছেন। যেমন:
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ
“আর তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না।” (সূরা বাকারা: ১৯৫)
তাছাড়া হাদিসেও এসেছে,
لا ضررَ ولا ضِرارَ
“নিজের অথবা অন্যের কোনও ক্ষতি করা যাবে না।” (বায়হাকি। ইমাম নওবী রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান-বুস্তানুল আরেফিন/৩৫)

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর দেয়া হালাল, স্বাস্থ্যসম্মত ও পবিত্র রিজিক গ্রহণ করে তাঁর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায়ের তাওফিক দান করুন এবং সব ধরণের ক্ষয়-ক্ষতি ও অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬◈◍◈▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।