ক্ষুধার ফজিলতে বর্ণিত কয়েকটি বানোয়াট হাদিস সতর্ক হোন ও সতর্ক করুন

বিশিষ্ট মুসলিম দার্শনিক ও সুফি সাধক হিসেবে সুপরিচিত ইমাম আবু হামেদ আল গাজালি (ইমাম গাজালি) তার বিখ্যাত ‘এহিয়া উলুমিদ্দিন’ শীর্ষক গ্রন্থে ক্ষুধা বা উপবাস থাকার ফজিলতে বেশ কয়েকটি বানোয়াট হাদিস উল্লেখ করেছেন। সাধারণত: ভণ্ড সুফি-সাধক ও দরবেশ শ্রেণির মানুষেরা এ সকল ভিত্তিহীন হাদিসের আলোকে একটানা কয়েক দিন যাবত ইচ্ছাকৃতভাবে সর্বপ্রকার পানাহার পরিত্যাগ করে প্রচণ্ড ক্ষুধা ও পিপাসায় নিজেদের আত্মাকে কষ্ট দিয়ে আত্মশুদ্ধি বা আত্মার সাধন করার চেষ্টা করে থাকে! তারা বলে, “ক্ষুধার আজাবের পরে নফস আল্লাহর বশ্যতা স্বীকার করে।”
এটি নি:সন্দেহে ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি ও বিদআতি বিশ্বাস। তাই এসব ভিত্তিহীন হাদিস সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। আল্লাহ আমাদেরকে হেফজত করুন। আমিন।

নিম্নে ক্ষুধা বা উপবাসের ফজিলতে বর্ণিত কতিপয় বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হাদিস উল্লেখ পূর্বক সেগুলোর মান ও অবস্থা সম্পর্কে বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণের মতামত উপস্থাপন করা হল:

❑ ১ম:

جاهدوا أنفسَكم بالجوعِ والعطشِ ، فإن الأجرَ في ذلك كأجرِ المجاهدِ في
سبيلِ اللهِ ، وأنه ليس من عملٍ أحبَّ إلى اللهِ من جوعٍ وعطشٍ

“তোমরা ক্ষুধা ও পিপাসার মাধ্যমে নিজেদের নফসের সাথে মুজাহাদা করো। কারণ এতে আল্লাহর পথের মুজাহিদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে। আর আল্লাহর নিকট ক্ষুধা ও পিপাসার মত অধিক পছন্দনীয় আমল আর দ্বিতীয়টি নেই।” [এহিয়া উলুমুদ্দিন-আবু হামেদ আল গজালি, অধ্যায়: কু প্রবৃত্তিকে দমন]

◈ হাফেজ ইরাকি বলেন, لم أجد له أصلاً “এর কোনও ভিত্তি পাই নি।” [তাখরীজু আহাদিসি এহিয়া উলূমিদ্দীন, পৃষ্ঠা নং ১৫৯৫]
◈ ইবনুস সুবকি বলেন, لم أجد له إسناداً “এর কোনও সনদ পাই নি।” [তাবাকাতুল কুবরা ৩৩৩/৬]
◈ শাইখ আলবানি বলেন, باطل لا أصل له “এটি একটি ভিত্তিহীন বাতিল হাদিস।” [সিলসিলা যাঈফাহ/২৭৪]

❑ ২য়:

لا يدخل ملكوت السماوات من ملأ بطنه
“যে ব্যক্তি পেট ভরে (পানাহার করে) খায় সে আসমানের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না।” [ইমাম গাজালি-এহিয়া উলুমুদ্দিন]
◈ হাফেজ ইরাকী তার বলেন, لم أجد له أصلاً “এর কোনও ভিত্তি পাই নি।” [তাখরীজু আহাদিসি এহিয়া উলূমিদ্দীন ৩/৬৯]
◈ ইবনুস সুবকিও অনুরূপ কথা বলেছেন। [তাবাকাতুল কুবরা ৪/১৬২]
◈ শাইখ আলবানি রাহ. বলেন, لا أصل له “এর কোনও ভিত্তি নাই।” সিলসিলা যাঈফাহ, ৭২০]

তবে সহিহ হাদিসে পেট পূর্ণ করে খাবার গ্রহণের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন: মিকদাম ইবনে মাদিকারিব রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি,
مَا مَلأَ آدَمِيٌّ وِعَاءً شَرًّا مِنْ بَطْنٍ بِحَسْبِ ابْنِ آدَمَ أُكُلاَتٌ يُقِمْنَ صُلْبَهُ فَإِنْ كَانَ لاَ مَحَالَةَ فَثُلُثٌ لِطَعَامِهِ وَثُلُثٌ لِشَرَابِهِ وَثُلُثٌ لِنَفَسِهِ
“পেটের চেয়ে মন্দ কোন পাত্র মানুষ ভরাট করে না। মেরুদণ্ড সোজা রাখার মত কয়েক লোকমা খানাই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। আরও বেশি ছাড়া যদি তা সম্ভব না হয় তবে পেটের এক তৃতীয়াংশ খানার জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানির জন্য আরেক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।” [সহীহ, ইবনে মাজাহ ৩৩৪৯, তিরমিজি হা/ ২৩৮০]

❑ ৩য়:

سيد الأعمال الجوع، وذل النفس لباس الصوف
“আমল সমূহের সরদার হচ্ছে, ক্ষুধা এবং আত্মার অপমান হচ্ছে, পশমের পোশাক।”
[ইমাম গাজালি-এহিয়া উলুমুদ্দিন]

◈ হাফেজ ইরাকি তার ইহইয়া কিতাবের তাখরিজ গ্রন্থে (৯/৩) এবং তাজুস ইবনুস সুবকী “তাবাকাতুল কুবরা” গ্রন্থে (৪/১৬২) বলেন, لم أجد له أصلا “এর কোনও ভিত্তি পাই নি।”
◈ শাইখ আলবানি বলেন, لا أصل له “এর কোন ভিত্তি নেই।” [সিলসিলা, হা/৭২০ ও ২৪৮]

❑ ৪র্থ:

أفضلكم عند الله منزلة يوم القيامة أطولكم جوعا وتفكيرا في الله سبحانه، وأبغضكم عند الله عز وجل يوم القيامة كل نؤوم أكول شروب

“কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ মর্যাদাবান বলে গণ্য হবে যে ব্যক্তি সুদীর্ঘ সময় ক্ষুধার্ত এবং আল্লাহর ব্যাপারে দীর্ঘ চিন্তামগ্ন অবস্থায় থাকে। আর কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট ঘৃণিত তারাই যারা অধিক ঘুমায়, অধিক পরিমাণে পানাহার করে।”
[ইমাম গাজালি-এহিয়া উলুমুদ্দিন]

◈ হাদিসটির কোন ভিত্তি নেই। যদিও এটিকে গাজালি তার ‘আল-ইহইয়া’ গ্রন্থে (৩/৯৬) হাসান বাসরীর হাদিস হতে মুরসাল সূত্রে মারফু (তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম-এর হাদিস) হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
◈ হাফেজ ইরাকী তাখরীজুল ইহইয়া গ্রন্থে (৩/৯৬) এবং তাজুস সুবকী “তাবাকাতুল কুবরা” গ্রন্থে (৪/১৬২) বলেছেন, لم أجد له أصلا “এর কোন ভিত্তি পাইনি।”

তা ছাড়া উক্ত হাদিসটি নিম্নোক্ত সহিহ হাদিস পরিপন্থী:

عَنْ أبى هريرة رضي الله عنه أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْجُوعِ فَإِنَّهُ بِئْسَ الضَّجِيعُ وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخِيَانَةِ فَإِنَّهَا بِئْسَتِ الْبِطَانَةُ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ وَابْن مَاجَه
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,
“হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে ক্ষুধা হতে আশ্রয় চাই। কেননা তা মানুষের কতই না খারাপ শয্যাসঙ্গী এবং তোমার কাছে আশ্রয় চাই বিশ্বাস ঘাতকতা হতে। কেননা তা কতই না মন্দ অদৃশ্য স্বভাব।” [হাসান : আবু দাউদ ১৫৪৭, নাসায়ী ৫৪৬৮, ইবনে মাজাহ ৩৩৫৪, সহিহ ইবনে হিববান ১০২৯, সহিহ আল জামি ১২৮৩।)]

◍ ব্যাখ্যা:

উক্ত হাদিসে ক্ষুধা থেকে আশ্রয় চাওয়া অর্থ হল, পেটে খাবার না থাকলে মানুষ যে ক্লান্তি ও কষ্ট অনুভব করে তা থেকে আশ্রয় চাওয়া। এর থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে এ জন্যে যে, পেটে ক্ষুধা থাকলে মানুষের দেহ ও মনে তার খারাপ প্রভাব দেখা যায়। খাবার গ্রহণের ফলে শারীরে শক্তি সঞ্চারিত হয় এবং মন প্রফুল্ল থাকে। পক্ষান্তরে পেটে ক্ষুধা থাকলে দেহ-মন উভয়টি দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ফলে না আল্লাহর আনুগত্য করা যায়, না দুনিয়ার কোনও কাজ করা সম্ভব হয়। ক্ষুধার্ত মানুষের মনে নানা বিভ্রান্তি মূলক, ভ্রান্ত ও বাজে চিন্তার উদ্রেক হয় এবং সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।।

এখানে ক্ষুধাকে بِئْسَ الضَّجِيعُ বা ‘খারাপ শয্যা সঙ্গী’ বলা হয়েছে এজন্য যে, ক্ষুধার ফলে মানুষ শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে, তা মানুষের ঘুম কেড়ে নেয় ফলে সে বিছানায় পড়ে অসহ্য কষ্টে ছটফট করতে থাকে।

মোটকথা, ইসলামের বিধানের বাইরে ইচ্ছাকৃত ভাবে দীর্ঘ সময় ক্ষুধা ও উপবাসের মাধ্যমে আত্মাকে কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জনের কোনও ভিত্তি নাই। এটি কথিত সুফি-সাধকদের ভ্রান্ত নীতি-যার ভিত্তি হল, বিভিন্ন বানোয়াট হাদিস। এর পরিবর্তে আমরা ইসলামের সঠিক নিয়ম অনুসরণ করে সিয়ামের মাধ্যমে ক্ষুধা ও পিপাসার কষ্ট অনুভব করতে পারি। এতে একদিকে আমাদের আত্মার পরিশুদ্ধতা অর্জিত হবে অন্য দিকে লাভ করতে পারব সিয়ামের সীমাহীন ফজিলত। আল্লাহ আমাদেরকে সুপথে পরিচালিত করুন এবং ভ্রান্ত নীতি থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: ইমাম গাজলি প্রথম পর্যায়ে দর্শন চর্চা ঝ সুফিবাদে মগ্ন ছিলেন। তিনি এগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তিনি সালাফদের নীতিতে ফিরে এসেছেন বলে গবেষক আলেমগণ মন্তব্য করেছেন।
আল্লাহ তাকে তার ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করে তাকে জান্নাতবাসী করুন। আমীন।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।