আবু বকর রা. অতঃপর উমর রা. কর্তৃক এক বুড়ির সেবা করা সংক্রান্ত কিচ্ছাটি বানোয়াট

সম্মানিত সাহাবি আবু বকর রা. অতঃপর উমর রা. কর্তৃক এক বুড়ির সেবা করা সংক্রান্ত কিচ্ছাটি বানোয়াট:

সোশ্যাল মিডিয়ায় নিম্নোক্ত লেখাটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত:

“তুমি আমার জন্য খেজুর এনেছো কিন্তু এগুলোর বীচি ফেলোনি ! ”
এটা একটি বিখ্যাত আরবি প্রবাদ।‌ কিন্তু এই প্রবাদটির উৎপত্তি কীভাবে হয়? আর কীভাবেই বা এটি বিখ্যাত হয়ে উঠে?
▪️এর পেছনে যে ঘটনাটা রয়েছে তা হল, নিম্নরূপ:
উমর ইবনুল খাত্তাব রা. কে কেউ একজন জানালো যে, আবু বকর রা. ফজরের সালাত শেষ করে মদিনার সীমানার দিকে যান, একটা ছোটো বাড়িতে বেশ কিছু সময় কাটান, তারপর নিজের ঘরে ফিরে আসেন।

আবু বকর রা. কী করতেন না করতেন তার সব খবরই উমর রা. রাখতেন; শুধুমাত্র এই বাড়িতে কী হতো তা তাঁর অগোচরে ছিলো।

দিন যায় কিন্তু খলিফা আবু বকর রা. এর ঐ বাড়িতে গমন বন্ধ হয় না। উমর. সিদ্ধান্ত নিলেন, ফজরের পর আবু বকর রা. ঐ বাড়িতে গিয়ে কী করেন, তা তিনি নিজের চোখে একবার দেখে আসবেন।
উমর রা. ঐ ঘরে গিয়ে দেখতে পেলেন, ওখানে একজন বৃদ্ধা বাস করেন। বৃদ্ধার কেউ নেই। তার উপর বৃদ্ধা অন্ধ।

উমর রা. অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হলেন। বৃদ্ধার সাথে আবু বকরের কী সম্পর্ক তা জানার জন্য তিনি আগ্রহী হয়ে উঠলেন।
উমর রা. বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“এই লোক আপনার বাড়িতে প্রতিদিন কী জন্য আসে?”
বৃদ্ধা জবাব দিলেন,
“আল্লাহর কসম, আমার জানা নেই। সে প্রতিদিন আসে, তারপর আমার ঘর ঝাড়ু দেয়, সব কিছু পরিষ্কার করে, তারপর আমার জন্য খাবার তৈরি করে, তারপর কোনো কথা না বলেই চলে যায়। ”
আবু বকর রা. এর মৃত্যুর পর আমিরুল মুমিনিন উমর রা.ও একইভাবে বৃদ্ধার সেবা করতে আরম্ভ করলেন।
বৃদ্ধা কিছু একটা টের পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার বন্ধু কি মারা গেছেন?”
উমর রা. অন্ধ বৃদ্ধার প্রশ্ন শুনে প্রচণ্ড অবাক হলেন। তিনি রা. বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কীভাবে বুঝলেন?”
বৃদ্ধা জবাব দিলেন,‌ “তুমি আমার জন্য খেজুর এনেছো, কিন্তু খেজুরগুলোর বীচি ফেলোনি।” (অথচ এই সামান্য বিষয়টাও তোমার বন্ধুর নজর এড়াতো না)
উমর রা. হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লেন। তাঁর চোখ অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। আর এই অবস্থায় উমর রা. তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি বললেন,
“হে আবু বকর, আপনি পরবর্তী খলিফাদের কাজ অত্যন্ত কঠিন করে গেছেন। ”
(আল্লাহ্‌ তাঁদের উপর রহম করুন)
[সংগৃহীত]

🔎 ঘটনার সত্যতা বিশ্লেষণ:

সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘটনাটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত। ইসলামিক মোটিভেশনাল লেখকরাও তাদের বইয়ে এ গল্পটি তুলে ধরেছেন। যেমন:
ড. মুহাম্মদ আব্দুর রহমান আরিফী তার বিখ্যাত “জীবনকে উপভোগ করুন (আরবি নাম: استمتع بحياتك)” বইয়ে এই গল্পটি আকর্ষণীয় ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু এই বইয়ের উপরে মন্তব্য করতে গিয়ে গবেষক ডক্টর আতাবি সহ অন্যান্য গবেষকগণ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, উক্ত গল্পের বিস্তারিত বিবরণ বানোয়াট।
তাছাড়াও আবু বকর রা. বা ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর জীবনী সংক্রান্ত কোনো গ্রন্থ, খলিফাদের জীবনী শীর্ষক বই বা নির্ভরযোগ্য কোন হাদিসের কিতাবে তা স্থান পায়নি।
তবে তারিখে ইবনে আসাকির শীর্ষক ইতিহাস গ্রন্থে এই ঘটনার সাথে কিছুটা সাদৃশ্য আছে (কিন্তু বিবরণগতভাবে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান) এমন একটি গল্প উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেটিও সনদগতভাবে অত্যাধিক দুর্বল। কারণ এর সনদ একাধিক মাজহুল (অজ্ঞাত পরিচয়ধারী) ও মাতরুক (পরিত্যাজ্য)‌ বর্ণনাকারী এবং সনদের মধ্যে ইনকিতা (বিচ্ছিন্নতা), ইরসাল ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত।
সুতরাং তাও গ্রহণযোগ্য নয়।

▪️তাছাড়া নিম্মোক্ত বিষয়টিও ঘটনাটির মিথ্যাচারিতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট হতে পারে। তা হল:

এ ব্যাপারে ফকিহগণ কোন দ্বিমত করেননি যে, কোন পুরুষের জন্য নির্জনে কোন নন‌ মাহরাম মহিলার ঘরে প্রবেশ করা জায়েজ নেই যদিও সে বয়স্কা বা বৃদ্ধা হয় না কেন। কেননা কুরআন-হাদিসে এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধ পুরুষ বা মহিলার জন্য আলাদাভাবে ছাড় দেওয়া হয়নি। বরং হাদিসে আম ভাবে বলা হয়েছে,

لا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ وَلا تُسَافِرَنَّ امْرَأَةٌ إِلا وَمَعَهَا مَحْرَمٌ
“কোন পুরুষ পরনারীর সাথে নির্জনতা অবলম্বন করবে না এবং
মাহরাম (বিবাহ নিষিদ্ধ পুরুষ) সঙ্গী ব্যতিরেকে পর নারীর সাথে সফর করবে না।” [সহীহ বুখারী ও মুসলিম]

ইমাম নওয়াবি এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন,
وَأَمَّا إِذَا خَلَا الْأَجْنَبِيّ بِالْأَجْنَبِيَّةِ مِنْ غَيْر ثَالِث مَعَهُمَا، فَهُوَ حَرَام بِاتِّفَاقِ الْعُلَمَاء
“তৃতীয় ব্যক্তি ছাড়া পরপুরুষ পরনারীর সাথে নির্জনতা অবলম্বন করা আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে হারাম।”

– ফিকাহ বিশ্বকোষ (২৯/২৯৫) এ এসেছে,
ولفظ الرجل في الحديث يتناول الشيخ والشاب, كما أن لفظ المرأة يتناول الشابة والمتجالة (العجوز) ” انتهى.
“হাদিসে ‘পুরুষ’ শব্দটি যুবক এবং বৃদ্ধ এবং ‘নারী’ শব্দটি যুবতী এবং বৃদ্ধা উভয়ই শামিল করে।”

🔸সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি এবং বিশ্ব বরেণ্য আলেম আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রহ. বলেন,
لا يخلو رجل بامرأة فإن الشيطان ثالثهما
ولا فرق بين العجوز والشابة ، لكن الشابة أشد خطراً، والنبي صلى الله عليه وسلم عمم، ولم يقل إلا أن تكون عجوزاً .. والشيطان يخشى منه على الرجل مع المرأة العجوز ومع غيرها…” انتهى من فتاوى “نور على الدرب
(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,) “কোন পুরুষ পর নারীর সাথে নির্জনতা অবলম্বন করলে সেখানে তৃতীয় জন হবে শয়তান।” যুবতী বা বৃদ্ধের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তবে যুবতী বেশি বিপদজনক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আম ভাবে বলেছেন। এ কথা বলেননি যে, “বৃদ্ধ মহিলা ব্যতিরেকে।” (অর্থাৎ তিনি একথা বলেননি যে, বৃদ্ধ মহিলার জন্য এ বিধান প্রযোজ্য নয়‌)
একজন পুরুষের জন্য শয়তানকে ভয় করা কর্তব্য, বৃদ্ধা অথবা অন্য যেকোনো মহিলার ক্ষেত্রে।” [ফাতাওয়া নুরুন আলাদ্দারব (সৌদি আরবের ইসলামি প্রশ্ন-উত্তর বিষয়ক রেডিও প্রোগ্রাম)]

সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘনিষ্ঠতম এবং এই উম্মতের সবচেয়ে মর্যাদাবান এই দুই সম্মানিত সাহাবি একজন নন মাহরাম বৃদ্ধ মহিলার নির্জন ঘরে গিয়ে সেবা করবেন-এমন হারাম কাজ করতে পারেন না। এটি তাদের মর্যাদা এবং শরিয়তের জ্ঞানের ব্যাপারে অপবাদের শামিল। কোন অসহায় বৃদ্ধ নারীর বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন থাকলে তারা অবশ্যই অন্য কোন মহিলা বা দাসী পাঠিয়ে তাদের সেবা করার ব্যবস্থা করতেন।
মোটকথা, ইসলামে মানবিকতা, মানবসেবা ও সৎকাজে প্রতিযোগিতা ইত্যাদির জন্য সাহাবিদের নামে কোন মিথ্যা ও বানোয়াট কিচ্ছা কাহিনীর অবতারণার প্রয়োজন নেই। বরং এসব ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদিসের যেসব মহান দিক নির্দেশনাবলী রয়েছে সেগুলোই যথেষ্ট।
আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরনের রং মাখানো মিথ্যা ও বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী থেকে হেফাজত করুন। আমিন। আল্লাহ ক্ষমা করুন।

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।