স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে মিথ্যা কথা বলা এবং তার সীমা

প্রশ্ন: অনেক সময় বিভিন্ন কারণে স্বামীর কথা রাখতে পারি না। এ ক্ষেত্রে স্বামী রাগ করবে ভেবে মিথ্যা বললে কি গুনাহ হবে? যেমন: স্বামী কোনও কাজ করতে বলেছেন কিন্তু আমি করি নি। কিন্তু স্বামীকে রাগ করবে ভেবে বলেছি, করেছি। তাহলে কি এতে আমার গুনাহ হবে?

উত্তর: স্ত্রীর জন্য ফরজ হচ্ছে, আল্লাহর নাফরমানি নেই এমন কাজে যথাসাধ্য স্বামীর আনুগত্য করা। কারণ মহান আল্লাহ স্বামীকে স্ত্রীর উপর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।আল্লাহ তাআলা বলেন,

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَبِمَا أَنفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ ۚ فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِّلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ

“পুরুষেরা নারীদের উপর তত্ত্বাবধায়ক (অভিভাবক/পরিচালক)। এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। অতএব, নেককার স্ত্রীগণ হয় আনুগত্যশীল এবং আল্লাহ যা হেফাজতযোগ্য করে দিয়েছেন লোক চক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাজত করে।” [সূরা নিসা: ৩৪]

সুতরাং তিনি যদি স্ত্রীকে কোনও বৈধ কাজ করার আদেশ করেন, তাহলে স্ত্রীর কর্তব্য, তা গুরুত্বের সাথে পালন করা। এই আনুগত্য পাওয়া স্বামীর হক। তাছাড়া স্বামী যেমন তার স্ত্রী-পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল তেমনি স্ত্রীও স্বামীর ঘরের দায়িত্বশীল। স্ত্রীর কাঁধে স্বামীর ঘরের আমানত অর্পিত। আর কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা সকলকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন।

যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالأَمِيرُ رَاعٍ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ زَوْجِهَا وَوَلَدِهِ، فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ
“তোমাদের প্রত্যেকেই এক একজন রক্ষক এবং তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। আমীর (শাসক) হল, তত্ত্বাবধান কারী, একজন ব্যক্তি তার পরিবারের লোকদের তত্ত্বাবধান কারী, একজন নারী তার স্বামীর গৃহের ও সন্তানদের তত্ত্বাবধান কারী। তোমরা প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধান কারী, আর তোমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ অধীনস্থ লোকদের তত্ত্বাবধান সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” [সহিহ বুখারি (ই.ফা.) অধ্যায়: ৫৪/ বিয়ে-শাদি, পরিচ্ছেদ: ২৫১৪. স্ত্রী স্বামীগৃহের তত্ত্বাবধান কারী]।

❑ স্বামীর সাথে মিথ্যা কথা বলা:

কখনো যদি বিশেষ কোনও কারণে স্ত্রী যদি স্বামীর কোনও নির্দেশ পালন করতে সক্ষম না হয় এবং এ ক্ষেত্রে স্বামীকে সত্য কথা বললে তিনি রাগ করবেন বা পরিবারে সমস্যা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা থাকে তাহলে সে ক্ষেত্রে কিছু মিথ্যা কথা বলে যদি স্বামীকে খুশি রাখা যায় তাহলে তা জায়েজ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

প্রখ্যাত সাহাবিয়া আসমা বিনতে ইয়াজিদ রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لاَ يَحِلُّ الْكَذِبُ إِلاَّ فِي ثَلاَثٍ يُحَدِّثُ الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ لِيُرْضِيَهَا وَالْكَذِبُ فِي الْحَرْبِ وَالْكَذِبُ لِيُصْلِحَ بَيْنَ النَّاسِ ‏
“তিনটি ক্ষেত্র ব্যতীত মিথ্যা বলা বৈধ নয়। যথা:
● এক. স্ত্রীকে খুশি করার উদ্দেশ্যে তার সাথে স্বামীর কিছু বলা,
● দুই. যুদ্ধের সময়
● তিন. এবং লোকদের পরস্পরের মাঝে সংশোধন করার জন্য মিথ্যা কথা বলা।” [সুনান আত তিরমিজী (তাহকিক কৃত) ২৫/ সদ্ব্যবহার ও পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখা, পরিচ্ছেদ: ২৬. পরস্পরের মাঝে সংশোধন করা]

অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

لَيْسَ الْكَذَّابُ الَّذِي يُصْلِحُ بَيْنَ النَّاسِ، فَيَنْمِي خَيْرًا، أَوْ يَقُولُ خَيْرًا ‏

“সে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী নয়, যে মানুষের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য (নিজের পক্ষ থেকে বিবদমান লোকদের নিকট) ভালো কথা পৌঁছে দেয় কিংবা ভালো কথা বলে।” [সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৪৫/ সন্ধি, পরিচ্ছেদ: ১৬৭৪. সেই ব্যক্তি মিথ্যাবাদী নয়, যে মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়]।

◈ হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রাহ. বলেন,

وَاتَّفَقُوا عَلَى أَنَّ الْمُرَاد بِالْكَذِبِ فِي حَقّ الْمَرْأَة وَالرَّجُل إِنَّمَا هُوَ فِيمَا لَا يُسْقِط حَقًّا عَلَيْهِ أَوْ عَلَيْهَا أَوْ أَخْذ مَا لَيْسَ لَهُ أَوْ لَهَا ” انتهى .
“আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যে ক্ষেত্রে স্বামীর অথবা স্ত্রীর কারও হক নষ্ট হবে না বা স্বামী বা স্ত্রীর যা প্রাপ্য নয় তা (অন্যায়ভাবে) গ্রহণ করা হবে না।” [ফাতহুল বারি]।

◈ সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি আল্লামা শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের সাথে মিথ্যা কথা বলার ব্যাপারে বলেন,
المقصود: الكذب الذي ينفعهما، ولا يضر أحدًا، ينفعهما فيما بينهما، ولا يضر أحدًا من الناس؛ فلا بأس
“মোটকথা, যে মিথ্যায় স্ত্রীর উপকার হয় এবং কারও ক্ষতি না হয়-যাতে উভয়ের মধ্যস্থিত বিষয়ে উপকার হয় এবং কোনও মানুষের ক্ষতি না হয় তাহলে তাতে কোনও অসুবিধা নেই।” [binbaz]।

অনুরূপভাবে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি প্রেম ও ভালবাসা প্রকাশে বাড়িয়ে বললেও তা মিথ্যা বলে বিবেচিত হবে না। কিন্তু কোনও অবস্থায় মিথ্যা বলে একে অপরের ক্ষতি সাধন করা বা হক নষ্ট করা জায়েজ নাই। এতে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরির পরিবর্তে সমস্যা বৃদ্ধি করবে এবং পরস্পরের অন্তরে অবিশ্বাস ও অনাস্থা দানা বাঁধবে যা তাদের দাম্পত্য জীবনের জন্য বিরাট হুমকি। (আল্লাহ হেফাজত করুন। আমিন)।

মোটকথা, দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখা বা পারিবারকে বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তি বা পারিবারিক সমস্যার সামধানের স্বার্থে স্বামী স্ত্রীকে আর স্ত্রী স্বামীকে কখনো কখনো মিথ্যা কথা বলা দোষণীয় নয় যদি তাতে উপকার হয়, কারও ক্ষতি না হয় বা কারও অধিকার খর্ব করা না হয়। আল্লাহু আলাম।

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: