প্রশ্ন: আমরা তো জানি, রমজানে শয়তানদেরকে শেকল বন্দি থাকে। তাহলে তারা কিভাবে মানুষের মনে ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা দেয় এবং কিভাবে পাপাচার সংঘটিত হয়?
উত্তর:
রমাযান মাসে শয়তানদেরকে শেকল বন্দি করার ব্যাপারে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি হল:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا كَانَتْ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ صُفِّدَتْ الشَّيَاطِينُ وَمَرَدَةُ الْجِنِّ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ فَلَمْ يُفْتَحْ مِنْهَا بَابٌ وَفُتِحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ وَنَادَى مُنَادٍ يَا بَاغِيَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ وَيَا بَاغِيَ الشَّرِّ أَقْصِرْ وَلِلهِ عُتَقَاءُ مِنْ النَّارِ وَذَلِكَ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ
হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যখন রমযান মাসের প্রথম রাত আসে, তখন শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শেকল দিয়ে বেধে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, তার একটি দরজাও খোলা হয় না, জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, এর একটি দরজাও বন্ধ হয় না এবং একজন ঘোষক ডেকে বলেন, হে সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি! অগ্রসর হও, হে অসৎকর্মপরায়ণ! থেমে যাও। আল্লাহ্ (রমযানের) প্রতিটি রাতে অনেক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন।” (সহীহুল বুখারী ১৮৯৮, ১৮৯৯, ৩২৭৭, মুসলিম ১০৭৯)
🌀 শয়তানদেরকে শেকল বন্দি করার পরও তারা কিভাবে মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দেয়?
সুনানে নাসাঈর বর্ণনায় এসেছে: وتغل فيه مردة الشياطين “রমাযান মাসে অবাধ্য ও উগ্র শয়তানদেরকে বন্দি করা হয়।” অর্থাৎ সব শয়তানকে বন্দি করা হয় না বরং যেগুলো বেশি উগ্র ও অবাধ্য কেবল সেগুলোকে শেকল পারানো হয়।
সুতরাং অন্যান্য ছোট শয়তানগুলো মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দিতে পারে। তবে যে ব্যক্তি রোযার আদব ও শর্তবলীর প্রতি লক্ষ রেখে ইখলাস ও আন্তরিকতা সহকারে রোযা রাখে এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে আল্লাহর সাহায্যে শয়তানরা তাদের অন্তরে প্রভাব ফেলতে পারে না এবং তাদের ক্ষতি করতে পারে না।
🌀 শয়তানদেরকে শেকল বন্দি করার পরও কিভাবে মানুষ পাপাচার করে?
রমাযানে শয়তানদেরকে বন্দি রাখা হয় এর অর্থ এই নয় যে, রমাযানে কোন পাপাচার সংঘটিত হবে না। কারণ মানুষ কেবল শয়তানের কুমন্ত্রণায় পাপ করে না বরং পাপাচার সংঘটিত হওয়ার পেছনে শয়তান ছাড়াও আরও কিছু কারণ আছে। যেমন: মানুষ রিপুর কামনা-বাসনা ও কু প্রবৃত্তির তাড়নায় পাপ করে। আবার মানুষরূপী শয়তানের খপ্পরে পড়ে এবং বদ অভ্যাসের বশবর্তী হয়েও পাপ করে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, যখন আল্লাহ তাআলা ইবলিসকে প্রথম মানব আদম আ. কে সেজদা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তখন সে আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘণ করেছিলো। এখানে প্রশ্ন হল, কোন শয়তান তাকে আল্লাহর অবাধ্যতা করতে প্ররোচিত করেছিলো? না, কোনো শয়তান নয় বরং তার ভেতরের অহংবোধ ও কুপ্রবৃত্তির কারণে সে আল্লাহর অবাধ্যতা করেছিলো।
তাই তো হাদিসে রমাযান মাসে রোযাদারদেরকে কুপ্রবৃত্তি, বদ অভ্যাস ও খারাপ আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়েছে। যেমন হাদিসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে- আল্লাহ তাআলা বলেন:
فَإِنَّهٗ لِىْ وَأَنَا أَجْزِىْ بِه، يَدَعُ شَهْوَتَه وَطَعَامَه مِنْ أَجْلِىْ
”রোযা আমার জন্যে রাখা হয় এবং আমিই এর প্রতিদান দিব। কারণ রোযাদার ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির তাড়না ও খাবার-দাবার শুধু আমার জন্য পরিহার করে।”
আরও বলা হয়েছে:
إِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلَا يَرْفُثْ وَلَا يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابَّه أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَه فَلْيَقُلْ : إِنِّى امْرُؤٌ صَائِمٌ
“তোমাদের যে কেউ যেদিন রোযা রাখবে হবে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে আর শোরগোল বা উচ্চবাচ্য না করে। তাকে কেউ যদি গালি দেয় বা কটু কথা বলে অথবা তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, সে যেন বলে দেয়, ‘আমি একজন রোযাদার”। (সহীহ : বুখারী ১৯০৪, মুসলিম ১১৫১)
সুতরাং শয়তানকে শিকল বন্দি করে রাখা হলেও উপরোক্ত একাধিক কারণে মানুষ পাপাচার করে।
তবে এটা ঠিক যে, শয়তানদেরকে শেকল পরানোর কারণে সমাজে পাপাচারের পরিমাণ কমে যায়। কারণ সে অবাধে সর্বত্র চলাফেরা করতে পারে না এবং খাঁটি অন্তরে রোযা পালনকারীদের মনে সহজে কুমন্ত্রণা দিতে পারে না। তাইতো এ মাসে মানুষ অধিক পরিমাণে সৎকর্মের দিকে ধাবিত হয়, অনেক পাপিষ্ঠ ব্যক্তি পাপ-পঙ্কিলতা ছেড়ে মসজিদমুখী হয়, নামায-রোযা শুরু করে, কুরআন তিলাওয়াত করে, উমরা আদায় করে, যাকাত দেয়, অনেক বেপর্দা মহিলা পর্দা ধরে, সমাজে নানা ধরণের সৎকর্মের চর্চা বৃদ্ধি পায় এবং প্রকাশ্য পাপাচার কম হয়। এটা বাস্তব ও স্পষ্ট সত্য।
এটাই হল শয়তানদেরকে বন্দি করার ফায়দা। আল্লাহু আলাম।
আল্লাহ আমাদেরকে শয়তানের ষড়যন্ত্র ও কুমন্ত্রণা থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
▬▬▬▬💠🌀💠▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(মদিনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি সৌদি আরব)
দাঈ, জুবাইল, সউদী আরব।।