মাটি না কি নুর? (সত্যানুসন্ধিৎসু হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত হোক সত্যের আলো)
আমাদের সমাজে ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাটির তৈরি নাকি নুরের তৈরি’ এ বিষয়ে প্রচুর দ্বন্দ্ব, তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়াঝাটি, গালাগালি ও নানা বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ যুগ পরম্পরায় চলে আসছে-যা অদ্যাবধি বিদ্যমান। কিন্তু মূলত: এসব কার্যক্রম নিছক গোঁড়ামি ও মূর্খতা সুলভ আচরণ ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষও ছিলেন আবার নুর বা আলোও ছিলেন। এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও বাদানুবাদে লিপ্ত হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
▪️আসুন, এ বিষয়টি পরিস্কার করা যাক: وبالله التوفيق
প্রথমত আমাদেরকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে যে, তিনি কি মানুষ ছিলেন, নাকি জিন ছিলেন, নাকি ফেরেশতা ছিলেন। যদি মানুষ জাতির অন্তর্ভুক্ত হন তাহলে মানুষ যে উপাদান থেকে যে পদ্ধতিতে সৃজিত হয়েছে তিনিও সে পদ্ধতিতে সে উপাদান থেকেই সৃজিত হয়েছেন।
তাহলে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষ ছিলেন কি না তা কুরআন-হাদিস থেকে জানা যাক:
◆ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষ ছিলেন; ফেরেশতা ছিলেন না। এ বিষয়ে কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,
وَقَالُوا مَالِ هَٰذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ ۙ لَوْلَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيرًا
“তারা (কাফেরেরা) বলে, এ কেমন রসুল যে, খাদ্য আহার করে এবং হাটে-বাজারে চলাফেরা করে? তাঁর কাছে কেন কোন ফেরেশতা নাজিল করা হল না যে, তাঁর সাথে সতর্ক কারী হয়ে থাকত?” [সূরা ফুরকান: ৭]
– এই আয়াতের তাফসিরে ইমাম বাগাভি বলেন,
( وقالوا مال هذا الرسول ) يعنون محمدا – صلى الله عليه وسلم – ، ) ( يأكل الطعام ) كما نأكل نحن ، ( ويمشي في الأسواق ) يلتمس المعاش كما نمشي ، فلا يجوز أن يمتاز عنا بالنبوة ، وكانوا يقولون له : لست أنت بملك ولا بملك ، لأنك تأكل والملك لا يأكل ، ولست بملك لأن الملك لا يتسوق ، وأنت تتسوق وتتبذل .
وما قالوه فاسد; لأن أكله الطعام لكونه آدميا ، ومشيه في الأسواق لتواضعه ، وكان ذلك صفة له ، وشيء من ذلك لا ينافي النبوة
“তারা বলে, এ আবার কেমন রসুল!” অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সে খাবার খায় যেমন আমরা খাই, সে জীবিকা অন্বেষণে বাজারে যায়, যেমন আমরা যাই!
এমনটি হলে নবুওয়তের মাধ্যমে আমাদের থেকে তার আলাদা কিছু হওয়া সিদ্ধ নয়।
তারা আরও বলত, তুমি তো ফেরেশতা নও। কারণ ফেরেশতারা খায় না। আবার তুমি রাজা-বাদশাও নও। কারণ রাজা-বাদশারা বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করে না। কিন্তু তুমি তো বাজারে যাও এবং কেনাকাটা ও খরচাপাতি করো। এরা যে এসব কথাবার্তা বলতো সবই ভ্রান্ত। কারণ তিনি এ জন্য খাবার গ্রহণ করতেন যে, তিনি একজন মানুষ ছিলেন। আর তিনি বাজারে যেতেন। কারণ এটা ছিল তাঁর বিনয়। এটাই তাঁর বৈশিষ্ট্য। এগুলোর কোনও কিছুই নবুওয়ত পরিপন্থী নয়।” [তাফসিরে বাগাভি]
◆ আল্লাহ আরও বলেন,
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَىٰ إِلَيَّ
“হে নবি, আপনি বলে দিন যে, আমি ও তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়…।” [সূরা কাহফ: ১১০]
এই আয়াতের তাফসিরে ইমাম ত্বাবারি বলেন,
يقول تعالى ذكره قل لهؤلاء المشركين يا محمد: إنما أنا بشر مثلكم من بني آدم لا علم لي إلا ما علمني الله وإن الله يوحي إليّ أن معبودكم الذي يجب عليكم أن تعبدوه ولا تشركوا به شيئا، معبود واحد لا ثاني له، ولا شريك
“আল্লাহ তাআলা (এই আয়াতে) বলেছেন, “হে মুহাম্মদ, আপনি ঐ সকল মুশরিকদেরকে বলে দিন যে, আমি তোমাদের মতই আদম সন্তানদের মধ্য থেকে একজন মানুষ মাত্র। আমার কোনও জ্ঞান নেই আল্লাহ যা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া। আর আল্লাহ আমার নিকট এ মর্মে ওহি নাজিল করেন যে, তোমাদের মাবুদ-যার ইবাদত করা এবং তার সাথে কোনও কিছুকে শরিক না করা তোমাদের জন্য আবশ্যক-তিনি হলেন, একমাত্র মাবুদ যার দ্বিতীয় বা অংশীদার কেউ নেই।” [তাফসিরে ত্ববারি]
❑ মানব সৃষ্টির উপাদান:
◆ মা-জননী আয়েশা রা. রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,
«خُلِقَتِ الْمَلَائِكَةُ مِنْ نُورٍ وَخُلِقَ الْجَانُّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ وَخُلِقَ آدَمُ مِمَّا وصف لكم»
“ফেরেশতাদের কে নুর (আলো) দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর জিন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে ধোঁয়া মিশ্রিত অগ্নিশিখা হতে এবং আদম আ. কে সৃষ্টি করা হয়েছে ঐ বস্তু দ্বারা, যার বর্ণনা (কুরআনে) তোমাদেরকে বলা হয়েছে।” [সহিহ মুসলিম] অর্থাৎ কুরআনে বিভিন্ন স্থানে আদম সৃষ্টির যে উপাদানগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলো। যেমন: কাদা-মাটি, বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি, এঁটেল মাটি ইত্যাদি, দেখুন: সুরা আর রহমান-এর ১৪ এবং সূরা স্বদ-এর ৭ নম্বর আয়াত।
◆আদম আলাইহিস সালাম ছাড়া অন্যান্য মানব সৃষ্টির উপাদান সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ بَشَرًا
“তিনিই পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন মানবকে।” [সূরা ফুরকান: ৫৪]
◆ তিনি আরও বলেন,
خُلِقَ مِن مَّاءٍ دَافِقٍ
“সে (মানুষ) সৃজিত হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি (বীর্য) থেকে।” [সূরা ত্বারিক: ৬]
◆তিনি আরো বলেন,
وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنسَانِ مِن طِينٍ - ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِن سُلَالَةٍ مِّن مَّاءٍ مَّهِين
“এবং কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করেন দুর্বল পানির নির্যাস (বীর্য) থেকে।” [সূরা সাজদা: ৭ ও ৮]
উল্লেখ যে, কুরআনে মানব সৃষ্টির উপাদান হিসেবে যেসব স্থানে কাদা-মাটি, বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি, এঁটেল মাটি ইত্যাদি কথা বলা হয়েছে সেগুলো মূলতঃ আদম আলাইহিস সালাম-এর সৃষ্টি প্রসঙ্গে। [দেখুন: সুরা আর রাহমান-এর ১৪, সূরা আনআম-এর ২, সূরা সফফাত-এর ১১ এবং সূরা হিজর-এর ২৬ নম্বর আয়াত]
অতএব বলা যায় যে, মানব সৃষ্টি সূচনা হয়েছে মাটি থেকে। তবে আদম আ. ছাড়া অন্য কাউকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়নি। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সরাসরি ‘মাটি থেকে সৃষ্টি’ বলা সঙ্গত নয়। হ্যাঁ, প্রথম মানুষ আদম আলাইহিস সালামকে যেহেতু মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে সেহেতু মানব সৃষ্টির মূল উপাদান হিসেবে তাঁকেও মাটির তৈরি বললেও অত্যুক্তি হবে না। তবে বিতর্ক এড়াতে না বলাই ভালো।
যাহোক, প্রমাণিত হল যে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষ ছিলেন। অত:এব (আদম আ., হাওয়া আ. এবং ঈসা আ. ছাড়া) পৃথিবীর অন্যান্য সকল মানুষ যে উপাদান থেকে সৃষ্টি এবং স্বামী-স্ত্রীর মিলনের মাধ্যমে মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করেছে তিনিও সেভাবেই মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করে দুনিয়ার বুকে পদার্পণ করেছেন।
তিনি জিন ছিলেন না যে, বলা হবে তিনি আগুন থেকে সৃষ্ট আর ফেরেশতাও ছিলেন না যে, বলা হবে তিনি নুর বা আলো থেকে সৃষ্ট।
❂ তিনি মানুষ হলেও অন্য সব মানুষের তুলনায় ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী:
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষ হলেও তিনি সাধারণ কোনও মানুষ ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তিনি চরিত্র মাধুরী, সুন্দর আচার-আচরণ, ক্ষমা, উদারতা, বিনয়-নম্রতা, অহংকার মুক্ত জীবন, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা, রাগ নিয়ন্ত্রণ, যৌন কামনা সংবরণ, দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শন, সাহসিকতা, ন্যায়-ইনসাফ, লজ্জাশীলতা, দানশীলতা, হাসি-কৌতুক ইত্যাদি মানবিক গুণাবলীর ক্ষেত্রে এক অনন্য-অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। তার কথা বলার ধরণ, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, দুনিয়ার সম্পদের প্রতি অনাগ্রহ, শিশুদের সাথে আচরণ, দাম্পত্য জীবন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই তিনি বিশ্ব মানবতার সামনে এক বিশাল প্রেরণার উৎস ও অনুকরণীয় মহান আদর্শ।
▪️তিনি কতটা সহজ-সরল ও সাংসারিক মানুষ ছিলেন তা আয়েশা রা. এর এ কথাটি থেকে প্রতীয়মান হয়:
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كان يَخيطُ ثوبَه ويخصِفُ نعلَه ويعمَلُ ما يعمَلُ الرِّجالُ في بيوتِهم
❝রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কাপড় সেলাই করতেন, জুতা মেরামত করতেন এবং লোকজন যেভাবে বাড়িতে গৃহস্থালির কাজ-কর্ম করে থাকে তেমনি তিনিও বাড়িতে গৃহস্থালির কাজ-কর্ম করতেন।” [সহিহ ইবনে হিব্বান-সহিহ]
তিনি অন্যত্র বলেছেন,
كان بشرًا من البشرِ : يَفْلِي ثوبَه ، و يحلبُ شاتَه ، و يخدم نفسَه
“তিনি মানুষের মধ্য থেকে একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কাপড়ে উকুন খুঁজতেন, বকরীর দুধ দোহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই করতেন।❞ [মুসনাদে আহমদ, ইবনে হিব্বান, সিলসিলা সহিহা, হা/৬৭১]
সুবহানাল্লাহ!! মানবজাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হয়েও কত সহজ-সরল ও সাধারণ জীবন যাপন করতেন আমাদের প্রাণের নবী ভালোবাসার নবি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সত্যি তিনি ছিলেন এক মহান আদর্শ ও অনুকরণীয় জীবনের প্রতিচ্ছবি!
❑ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মানবিক বৈশিষ্ট্য সমূহ:
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে অধিকাংশই মানবিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। তিনি হাসতেন, কাঁদতেন, আনন্দিত হতেন, রাগান্বিত হতেন, কষ্ট পেতেন, ভয় পেতেন (ওহি নাজিলের ঘটনা), ক্ষুধার্ত হতেন, ঘুমাতেন, পরিশ্রান্ত হতেন, তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন হত, তিনি ঘর্মাক্ত হতেন। রাস্তা চলাচলের সময় সূর্যের আলোতে তাঁর ছায়া পড়ত।
তিনি বিয়ে করেছেন। স্ত্রী সহবাস করতেন। তাঁর বীর্য নির্গত হত। তিনি মাঝেমধ্যে কিছু বিষয় ভুলে যেতেন। সালাতেও একাধিক বার তার ভুল হয়েছে (যেমন: যুল ইয়াদাইনের হাদিস)। তিনি ভুলে গেলে সাহাবিদেরকে বলতেন যে, তারা যেন তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি আহত হয়েছেন। তাঁর শরীর থেকে রক্ত নির্গত হয়েছে (তায়েফের ঘটনা)। যুদ্ধে তাঁর দাঁত ভেঙ্গেছে (উহুদের যুদ্ধ)। তিনি যুদ্ধে যাওয়ার আগে আত্মরক্ষার জন্য শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করেছেন।
তিনি গায়েব বা অদৃশ্যের খবর জানতেন না আল্লাহ তাকে বিশেষভাবে যা জানিয়েছেন তা ছাড়া। যার প্রমাণ উহুদের যুদ্ধে পরাজয়, ইহুদি মহিলা কর্তৃক বিষ মেশানো গোশত খাওয়ানো, ইফক তথা আয়েশা রা. এর প্রতি অপবাদের ঘটনা, বিরে মাউনায় ৭০ জন সাহাবির মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি।
তবে মানবিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রেও আল্লাহ তাআলা তাঁর মধ্যে ব্যতিক্রমী কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়েছিলেন। যেগুলো ছিল তাঁর মুজিযা ও তাঁর প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। যেমন: আল্লাহ তাআলা তাকে ৩০ বা ৪০ জন স্ত্রীর সহবাস করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন, সালাতরত অবস্থায় তাঁর পেছনের অবস্থা দেখতে পেতেন, তিনি একটানা নিরবিচ্ছিন্নভাবে রোজা রাখার শক্তি রাখতেন। কেননা আল্লাহ তাকে পানাহার করাতেন ইত্যাদি। এছাড়াও তাঁর মোজেজা সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনা এর প্রমাণ।
ইসলামের কিছু বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে তার জন্য ব্যতিক্রমী বিধান ছিল। তাহাজ্জুদের সালাত তাঁর জন্য ফরজ হওয়া, সওমে বিসাল বা একটানা অবিচ্ছিন্নভাবে রোজা পালনের অনুমতি, চারের অধিক বিয়ে ইত্যাদি। এই জাতীয় আরো কিছু বিষয়ে তার জন্য স্বতন্ত্র বিধান ছিল যেগুলো তার উম্মতের জন্য প্রযোজ্য ছিল না।
❑ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নুর বা আলো ছিলেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক দিকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুওয়ত ও রিসালাত প্রাপ্তির মাধ্যমে সম্মান ও মর্যাদায় সমগ্র মানব জাতির মধ্যে তুলনাবিহীন এবং জ্ঞান-প্রজ্ঞা, উত্তম চরিত্র এবং অন্যান্য মানবিক বৈশিষ্ট্যে ছিলেন এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত মহামানব। অন্যদিকে তিনি ছিলেন নুর বা আলো। কুরআনে তাঁকে নুর বা আলো বলা হয়েছে। হ্যাঁ, সত্যিই তিনি ছিলেন আলো। আলোকিত মানুষ। আলোর দিশা। তাঁর নিকট থেকে জ্ঞানের আলোয় বিশ্ব-ভুবন আলোকিত হয়েছে। মানুষ জাহেলিয়াত ও গোমরাহির গাঢ় অমানিশায় তাওহিদ ও হেদায়েতের আলো পেয়েছে। তিনি সত্যের আলো ছড়িয়েছেন। মূর্খতার অন্ধকারে তিনি জ্বেলেছেন জ্ঞানের মশাল। কেননা জ্ঞান হল, আলো আর অজ্ঞতা হল, অন্ধকার। তাওহিদ হল, আলো আর শিরক ও ভ্রষ্টতা হল, অন্ধকার। এই অর্থে তিনি অবশ্যই নুর বা আলো ছিলেন।
◆ এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِّمَّا كُنتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ ۚ قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ
“হে আহলে-কিতাবগণ, তোমাদের কাছে আমার রসুল আগমন করেছেন। কিতাবের যেসব বিষয় তোমরা গোপন করতে, তিনি তার মধ্য থেকে অনেক বিষয় প্রকাশ করেন এবং অনেক বিষয় মার্জনা করেন। তোমাদের কাছে একটি নুর বা আলো এবং একটি সমুজ্জ্বল গ্রন্থ এসেছে।” [সূরা মায়িদা: ১৫]
এই আয়াতের তাফসিরে ত্বাবারিতে বলা হয়েছে,
يعني بالنور، محمدًا صلى الله عليه وسلم الذي أنار الله به الحقَّ، وأظهر به الإسلام، ومحق به الشرك، فهو نور لمن استنار به يبيِّن الحق. ومن إنارته الحق، تبيينُه لليهود كثيرًا مما كانوا يخفون من الكتاب.
“নুর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যার মাধ্যমে তিনি সত্যকে প্রস্ফুটিত ও ইসলামকে বিকশিত করেছেন এবং শিরককে করেছেন নিশ্চিহ্ন। সুতরাং তিনি তার জন্য আলো যে তার দ্বারা আলোকিত হয়েছে। তিনি সত্যকে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি সত্যকে আলোর মত ফুটিয়ে তুলেছেন। এর একটি দিক হল, ইহুদিরা আল্লাহর কিতাব (তাওরাতের) যা কিছু গোপন করেছিলো তিনি তার অনেক কিছুই প্রকাশ করে দিয়েছেন।” [তাফসিরে ত্বাবারি]
আল্লাহ তাআলা আল কুরআনকেও নুর বা আলো বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন:
◆ মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُم بُرْهَانٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَأَنزَلْنَا إِلَيْكُمْ نُورًا مُّبِينًا
“হে মানুষেরা, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট শক্তিশালী প্রমাণ হাজির হয়ে গেছে। আর আমি তোমাদের প্রতি সুস্পষ্ট নুর বা আলো অবতীর্ণ করেছি।” [সূরা নিসা: ১৭৪]
এখানে নুর বা আলো দ্বারা উদ্দেশ্য কুরআন। যেমন: তাফসিরে কুরতুবিতে বলা হয়েছে,
النور المنزل هو القرآن ؛ عن الحسن ؛ وسماه نورا لأن به تتبين الأحكام ويهتدى به من الضلالة ، فهو نور مبين ، أي واضح بين
“(আল্লাহর পক্ষ থেকে) অবতরণ কৃত নুর বা আলো হচ্ছে, কুরআন। তিনি কুরআনকে নুর বলেছেন এ কারণে যে, এর মাধ্যমে বিধিবিধান প্রস্ফুটিত হয় এবং গোমরাহির মধ্যে হেদায়েত লাভ করা যায়। সুতরাং তা نور مبين তথা সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার আলো।” [তাফসিরে কুরতুবি]
তাফসিরে ইবনে কাসিরে বর্ণিত হয়েছে,
(وأنزلنا إليكم نورا مبين )
أي : ضياء واضحا على الحق ، قال ابن جريج وغيره : وهو القرآن
“আর আমি প্রকৃষ্ট নুর (আলো) অবতীর্ণ করেছি।” অর্থাৎ সত্যের উপর স্পষ্ট জ্যোতি। ইবনে জুরাইজ প্রমুখ বলেছেন, তা হল, কুরআন।”
◆ আল্লাহ তাআলা আল্লাহর কিতাব তাওরাতের ব্যাপারেও বলেছেন যে, তাতে রয়েছে নুর বা আলো:
إِنَّا أَنزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ
“আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছি। এতে হেদায়েত তথা সঠিক পথের দিশা ও নুর (আলো) রয়েছে।” [সূরা মায়িদা: ৪৪]
◆ আল্লাহ তাআলা আল্লাহর কিতাব ইঞ্জিলের ব্যাপারেও একই কথা বলেছেন,
وَآتَيْنَاهُ الْإِنجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ
“আমি তাঁকে ইঞ্জিল প্রদান করেছি। এতে সঠিক পথের দিশা ও আলো রয়েছে।” [সূরা মায়িদা: ৪৬]
ইমাম ত্ববারি বলেন,
ونور “، يقول: وضياء من عَمَى الجهالة
“নুর অর্থ: অজ্ঞতার অন্ধত্বের মধ্যে আলোর জ্যোতি।” [তাফসিরে ত্বাবারি]
কিন্তু কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা ও কিছু বানোয়াট হাদিস দিয়ে কিছু মানুষ বলতে চাইছে যে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নুর বা আলো থেকে সৃষ্টি হয়েছেন। এটি কুরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা এবং মূর্খতা। এ বিষয়ে তারা অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি করে। এমনকি যারা এ মত সমর্থন করে না তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রে ‘কাফের’ বলতেও তারা দ্বিধা করে না!
এ সকল কার্যক্রম দ্বীনের মধ্যে গুলু বা বাড়াবাড়ি এবং নিছক জাহেলিয়াত ছাড়া কিছু নয়। অথচ ইসলামে বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ।
❑ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রশংসা ও সম্মান প্রদর্শনে বাড়াবাড়ি করা নিষিদ্ধ:
ওমর রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لاَ تُطْرُونِي ، كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ ، فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ ، وَرَسُولُهُ
‘‘তোমরা আমার মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করো না যেমনিভাবে প্রশংসা করেছিলো খৃষ্টানরা মরিয়ম তনয় ঈসা আ. এর। আমি আল্লাহ তাআলার বান্দা মাত্র। তাই তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রসুল বলবে।’’ [বুখারি ও মুসলিম]
✪ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,
“إياكم والغُلُوَّ؛ فإنما أهلك من كان قبلكم
‘‘তোমরা বাড়াবাড়ির ব্যাপারে সতর্ক হও। কেননা, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগোষ্ঠী এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।’’ [মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ প্রমুখ-সহিহ]
✪ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«هَلَكَ المُتنَطِّعونَ» قالها ثلاثًا
‘‘সীমালঙ্ঘন কারীরা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।’’ এ কথা তিনি তিনবার বলেছেন।” [সহিহ মুসলিম]
পরিশেষে বলব, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল, সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা, সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক, সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা, সর্বশ্রেষ্ঠ কমান্ডার, সর্বশ্রেষ্ঠ স্বামী, সর্বশ্রেষ্ঠ পিতা। সর্বোপরি তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তাকে সর্বগুণে গুণান্বিত করেছিলেন। জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতায় ছিলেন অতুলনীয়। আল্লাহ তার পূর্বাপর সকল গুনাহ মোচন করে তাকে করেছিলেন পুত-পবিত্র ও নিষ্পাপ।
সুতরাং প্রিয় নবীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া ফরজ। তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ সম্মান ও ভালবাসার প্রমাণ দিতে হবে তাঁর আনুগত্য তথা তাঁর আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়ন এবং তাঁর আনিত শরিয়ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে। কিন্তু কোনও অবস্থায় তাঁর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনে অতিরঞ্জন করা যাবে না, প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করা যাবে না এবং তাঁর দেখানো পদ্ধতির বাইরে কোন ইবাদত করা যাবে না। অন্যথায় তা হবে, আমাদের ধ্বংসের কারণ-যেমনটি পূর্বোক্ত হাদিসে বলা হয়েছে।
🔸সারাংশ:
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টিগতভাবে মানুষ ছিলেন। অতএব মানুষ সৃষ্টির যে উপাদান তিনিও সে উপাদান থেকেই সৃষ্ট। কিন্তু ইসলামের জ্ঞান বিতরণ এবং সত্যের পথনির্দেশের ক্ষেত্রে ছিলেন নুর বা আলো। সুতরাং এ দুটি বিষয়ের মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই। আল্লাহ তাআলা আমাদের হৃদয় পটে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি পূর্ণ ভালোবাসা ধারণের পাশাপাশি তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ও সুন্নতের প্রতি আমল করার এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর নিঃশর্ত আনুগত্য করার তাওফিক দান করুন এবং তাঁর নামে সব ধরনের বাড়াবাড়ি, সীমালংঘন এবং তাঁর নির্দেশনার বাইরে সর্বপ্রকার নব আবিষ্কৃত বিদআতি কার্যক্রম থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।