মহিলাদের সেজদা বিষয়ে আমাদের হানাফি সমাজে প্রচলিত পদ্ধতিতে যেভাবে উরু ও পেটকে একত্রিত করে, দু হাতের বাহুকে পাঁজরের সাথে লাগিয়ে এবং কুনুই সহ পুরো দু হাত মাটিতে বিছিয়ে এক ধরণেরর শুয়ে পড়ার মত করে সেজদা দেওয়ার পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে তা আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শেখানো পদ্ধতি এবং মহিলা সাহাবিদের আমলের সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রকৃতপক্ষে এ বিষয়ে কোনও সহিহ (বিশুদ্ধ) হাদিস নেই। বরং যেসব হাদিস এসেছে সেগুলো মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে জইফ বা দুর্বল। কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক বিষয় হলো যে, এ ক্ষেত্রে আমাদের হানাফি ভাইয়েরা তাদের মতের পক্ষে যেসব হাদিস পেশ করে থাকেন সেগুলো দেখে হাদিসের সহিহ-জইফ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে অনেক সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ছে।
তাই নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণের নাম উল্লেখ পূর্বক তাদের উল্লেখিত হাদিসগুলোর মান উপস্থাপন করা হলো এবং বিস্তারিত জানার জন্য নিম্নে লিংক দেওয়া হলো যেন আবরি জানা আগ্রহী ভাই ও বোনেরা সত্য বিষয়টি জানতে পারেন:
وبالله التوفيق
✪ ১. ইমাম আবু দাউদ রাহ. তাঁর কিতাবুস সুনানের কিতাবুল মারাসীলে বিখ্যাত ইমাম ইয়াযিদ ইবনে আবী হাবীব রাহ.-এর সূত্রে হাদিস বর্ণনা করেন যে,
أن النبى مر على امرأتين تصليان فقال : اذا سجدتما فضما بعض اللحم الى الأرض، فان المرأة ليست فى ذلك كالرجل.
আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুইজন মহিলার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তারা নামাজ পড়ছিল। তিনি তাদের বললেন, “যখন তোমরা সেজদা করবে তোমাদের শরীরের কিছু অংশ, (মানে পিছনের অংশ) মাটির সাথে মিলিয়ে রাখবে। কারণ নারী এই বিষয়ে পুরুষের মত নয়। ” -মারাসীলে আবু দাউদ, হাদিস ৮৭; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদিস ৩২০১; মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার, বায়হাকী, হাদিস ৪০৫৪
● উক্ত হাদিসটি জইফ। (ইমাম জাহাবি, আলবানি প্রমূখ)।
➧ বিস্তারিত:
https://hdith.com/?s=+%D8%A7%D8%B0%D8%A7+%D8%B3%D8%AC%D8%AF%D8%AA%D9%85%D8%A7+%D9%81%D8%B6%D9%85%D8%A7+%D8%A8%D8%B9%D8%B6+%D8%A7%D9%84%D9%84%D8%AD%D9%85+%D8%A7%D9%84%D9%89+%D8%A7%D9%84%D8%A3%D8%B1%D8%B6
✪ ২. ইমাম বায়হাকী রাহ. তাঁর ‘আসসুনানুল কুবরা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إذا جلست المرأة في الصلاة وضعت فخذها على فخذها الأخرى وإذا سجدت ألصقت بطنها في فخذيها كأستر ما يكون لها وإن الله تعالى ينظر إليها ويقول يا ملائكتي أشهدكم أني قد غفرت لها.
“নারী যখন নামাজে বসবে তখন তার এক উরু অন্য উরুর উপর রাখবে। আর যখন সেজদা করবে তখন তার পেটকে উরুর সাথে মিলিয়ে রাখবে। আল্লাহ পাক ঐ নারীর দিকে তাকান এবং বলেন, হে ফিরিশতাগণ! আমি তোমাদের সাক্ষী রাখছি যে, আমি তাকে মাফ করে দিয়েছি”। (সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদিস: ৩১৯৯)
● উক্ত হাদিসটি জইফ। (ইমাম জাহাবি, ইবনে আদি, বায়হাকি, ইবনুল কায়সারানি প্রমূখ)
➧ বিস্তারিত: https://hdith.com/?s=%D9%88%D8%A5%D8%B0%D8%A7+%D8%B3%D8%AC%D8%AF%D8%AA+%D8%A3%D9%84%D8%B5%D9%82%D8%AA+%D8%A8%D8%B7%D9%86%D9%87%D8%A7+%D9%81%D9%8A+%D9%81%D8%AE%D8%B0%D9%8A%D9%87%D8%A7
✪ ৩. ইমাম তবারানী রাহ. ‘আলমুজামুল কাবীর’ গ্রন্থে ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন,
يا وائل بن حجر ! إذا صليت؛ فاجعل يديك حذاء أذنيك، والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها.
“হে ওয়ায়েল, যখন তুমি নামাজ পড়বে তখন তোমার দুই হাত কান বরাবর উঠাবে। আর নারী তার হাত উঠাবে বুক পর্যন্ত।” -মুজামে কাবীর, তবারানী, হাদিস ২৮
● এ হাদিসটি জইফ (আলবানি)।
✪ ৪. আলী ইবনে আবী তালিব রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, سئل عن صلاة المرأة নারীর নামাজ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন,
إذا سجدت المرأة فلتحتفز ولتلصق فخذيها ببطنها
“নারী যখন সেজদা করবে তখন যেন সে জড়সড় হয়ে সেজদা করে এবং তার দুই উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে।” -মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক ৫০৭২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, ২৭৭৭
● এ হাদিসটি জইফ। (ইমাম জাহাবি, ইবনে আদি, বায়হাকি, ইবনুল কায়সারানি প্রমূখ)।
❑ সঠিক পদ্ধতিতে মহিলাদের সেজদা দেওয়ার নিয়ম কী?
উত্তর:
সেজদার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগতভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। এ মর্মে যে সব হাদিস এসেছে সেগুলো নারী-পুরুষ উভয়কেই সমানভাবে শামিল করবে যতক্ষণ না নারীদের সেজদা দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে আলাদা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত কোনও হাদিস পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ ব্যাপারে একটিও সহিহ হাদিস নেই। এ মর্মে আমাদের হানাফি ভাইয়েরা যে সব হাদিস পেশ করে থাকেন কোনটিই বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয় যেমনটি মুহাদ্দিসগণ সনদের তাহকিক (সনদ বিশ্লেষণ)-এর মাধ্যমে স্পষ্ট করেছেন। (পূর্বোক্ত আলোচনা দেখুন)
◈◈ সেজদার পদ্ধতি সংক্রান্ত নিম্নোক্ত হাদিসগুলো নারী-পুরুষ সকলের জন্যই প্রযোজ্য:
❂ ১. আনাস বিন মালিক রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াা সাল্লাম বলেছেন,
اعْتَدِلُوا فِي السُّجُودِ، وَلَا يَبْسُطْ أَحَدُكُمْ ذِرَاعَيْهِ انْبِسَاطَ الْكَلْبِ.
“সেজদায় (অঙ্গ প্রত্যঙ্গের) সামঞ্জস্য রক্ষা কর। তোমাদের কেউ যেন সেজদায় তার হাতকে বিছিয়ে না দেয় যেভাবে কুকুর হাত বিছিয়ে দেয়।” [সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: আজান, পরিচ্ছেদ: ৫৩২. সেজদায় কনুই বিছিয়ে না দেওয়া। আবূ হুমাইদ (রা.) বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদা করেছেন এবং তাঁর দু হাত রেখেছেন, কিন্তু বিছিয়েও দেননি আবার তা গুটিয়েও রাখেননি।
ইমাম বুখারি উক্ত অধ্যায়ে আরেকটি অনুচ্ছেদে উক্ত হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। তা হলো:
অনুচ্ছেদ: ১০/১৪১. সেজদায় কনুই বিছিয়ে না দেওয়া।
وَقَالَ أَبُو حُمَيْدٍ سَجَدَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم وَوَضَعَ يَدَيْهِ غَيْرَ مُفْتَرِشٍ وَلاَ قَابِضِهِمَا.
আবু হুমাইদ রা. বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেজদা করেছেন এবং তাঁর দু হাত রেখেছেন কিন্তু বিছিয়েও দেননি আর তা গুটিয়েও দেননি।
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৪/ সালাত, অনুচ্ছেদ: পরিচ্ছেদ: ৪৫. সেজদার অঙ্গসমূহ ঠিকভাবে রাখা এবং দুই হাতের তালু মাটিতে রাখা, দুই কনুই পাঁজর থেকে ও পেট উরু থেকে পৃথক রাখা]
প্রাণীটি যখন অর্ধশায়িত অবস্থায় থাকে তখন যেভাবে তার সামনের দুই হাত জমিনে বিছানো থাকে, সেজদায় ঐভাবে হাত বিছিয়ে দেওয়া নিষেধ। এ হাদিসে যে শিক্ষা তা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেই বিখ্যাত হাদিসেরই একটি প্রায়োগিক রূপ যাতে তিনি বলেছেন,
«صَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي
“তোমরা ঐভাবে নামাজ পড়ো যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখ”। [সহিহ বুখারি, হা/ ৬৩১] ওখানে পুরো নামাজের কথা বলা হয়েছে আর সহিহ বুখারীর এই হাদিসে নামাজের একটি অংশ সেজদা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
❂ ২. সহিহ মুসলিমেও এ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। ওখানে বারা ইবনে আযিব রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন,
إِذَا سَجَدْتَ فَضَعْ كَفَّيْكَ وَارْفَعْ مِرْفَقَيْكَ
“যখন তুমি সেজদা করবে তখন দুই হাতের পাতা মাটিতে রাখবে। আর দুই কনুই উঁচু রাখবে”। -সহিহ মুসলিম, হাদিস ৪৯৪
সহিহ মুসলিমের এই হাদিস আর সহিহ বুখারীর উপরোক্ত হাদিসের মূলকথা একই। এই দুই হাদিস এবং এ বিষয়ের আরো বিভিন্ন হাদিস থেকে পাওয়া যায় যে, সেজদায় দুই হাতের বাহু পাঁজর থেকে আলাদা থাকবে এবং পেট উরু থেকে আলাদা থাকবে আর দুই হাত (অর্থাৎ কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত অংশ) মাটি থেকে উপরে থাকবে। এভাবেই সেজদা করার নিয়ম বিভিন্ন হাদিসে এসেছে। এ পদ্ধতি নারী-পুরুষ সকলের জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।