বারবার সিজার বা জরায়ু অপসারণ ও সন্তান গ্রহণের বিষয়ে ইসলামি দৃষ্টিকোণ

প্রশ্ন: আমার দুইটি সন্তান রয়েছে। দুটোই সিজারিয়ান ডেলিভারির মাধ্যমে হয়েছে। আমি নরমাল ডেলিভারির জন্য অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু সম্ভব হয়নি। এখন তৃতীয় সন্তানের ব্যাপারে আমি আমার ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি বলেছেন, তৃতীয় সিজার করা যায় তবে এতে ঝুঁকি থাকে এবং জরায়ু কেটে ফেলতে হতে পারে। কারণ বারবার সিজার করানো জরায়ুর সংক্রমণের কারণ হতে পারে।

এক্ষেত্রে কী করা উচিত? সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করা কি ঠিক হবে যেহেতু ডাক্তার বলছেন জরায়ু কেটে ফেলতে হতে পারে? আবার ইসলামে বেশি বেশি সন্তান গ্রহণের ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, এক্ষেত্রে সন্তান নেওয়ার চেষ্টা না করলে কি গুনাহ হবে? পুরুষ ডাক্তারের মাধ্যমে সন্তান ভূমিষ্টের জন্য সিজার করার বিধান জানতে চাই।

উত্তর: নিম্নে অতিসংক্ষেপে পুরুষ ডাক্তারের মাধ্যমে সন্তান ভূমিষ্টের জন্য সিজার করা, জরায়ু অপসারণ এবং অধিক সন্তান গ্রহণ বিষয়ক প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হলো: وبالله التوفيق

❑ ১. ইসলামের দৃষ্টিতে অভিজ্ঞ নারী চিকিৎসক থাকা অবস্থায় পুরুষ চিকিৎসকের নিকট সিজার করা জায়েজ নয়:

ইসলামি শরিয়তে নারীর সংবেদনশীল স্থান কেবলমাত্র স্বামী ব্যতীত অন্য কোনও নারী বা পুরুষের জন্য দেখা বা স্পর্শ করা জায়েজ নয় যদিও সে মাহরাম (যেমন: ছেলে, বাবা, ভাই) হয়ে থাকে। তবে যদি কোনও যোগ্য নারী চিকিৎসক পাওয়া না যায় এবং পরিস্থিতি একান্তই সংকটময় হয় তখন সিজারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পুরুষ চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া বৈধ হবে।

এক্ষেত্রে পুরুষ চিকিৎসককে অবশ্যই গ্লাভস পরিধান করতে হবে এবং রোগীর শরীর যথাসম্ভব আবৃত রাখতে হবে যাতে একান্ত প্রয়োজনীয় স্থান ব্যতীত অন্য কোনও অংশ প্রকাশিত না হয়।

– শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা হলো:

الضرورة تبيح المحظورات

“প্রয়োজন নিষিদ্ধ বিষয়গুলোকে বৈধ করে দেয়।”

(এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আলেমদের ফতোয়া সহকারে আলাদা পোস্ট রয়েছে)
সিজার ছাড়াও জটিল নারী রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসা গ্রহণের বিধান একই।

❑ ২. বারবার সিজার ও জরায়ু অপসারণের বিষয়ে শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি:

সন্তান জন্মদান ও চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে শরিয়তের মূলনীতি হলো, যদি এটি মাতার জীবন বা স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়, তাহলে ইসলাম এ ক্ষেত্রে ছাড় দেয়। নিম্নে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হলো:

❂ ক. নিজের প্রাণহানির ঝুঁকি থাকলে সন্তান না নেওয়া বৈধ:

যদি তৃতীয় সিজার করার কারণে আপনার জীবন বা স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হয়, তাহলে শরিয়ত আপনাকে সন্তান গ্রহণ থেকে বিরত থাকার অনুমতি দেয়। কারণ ইসলাম জীবন রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়।

প্রাণহানি বা মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কায় কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার দলিল:

আল্লাহ তাআলা বলেন:

فَمَنِ ٱضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍۢ وَلَا عَادٍۢ فَلَآ إِثْمَ عَلَيْهِ ۚ

“কিন্তু যদি কেউ নিরুপায় হয়ে পড়ে (হারাম কিছু খেতে), অথচ সে অবাধ্য বা সীমালঙ্ঘনকারী না হয়, তবে তার জন্য কোনো পাপ নেই।” [সূরা বাকারা ২: ১৭৩]

সুতরাং যদি কোনো নারী বারবার সিজার করানোর ফলে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে এবং ডাক্তাররা নিশ্চিত করেন যে, জরায়ু রেখে দিলে বিপদ হবে তাহলে এটি إضطرار (অপরিহার্য অবস্থা) হিসেবে গণ্য হবে এবং তখন শরিয়ত এ ব্যাপারে শিথিলতা প্রদান করে। অর্থাৎ এ পরিস্থিতি জরায়ু অপসারণ করা জায়েজ।

❂ খ. নিজের প্রাণহানি ঘটানো হারাম। তাই ঝুঁকিপূর্ণ কিছু থেকে বেঁচে থাকা জরুরি:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ

“নিজেদের হাত দিয়ে নিজেদের ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না।” [সূরা বাকারা: ১৯৫]

সুতরাং যদি বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ ডাক্তার নিশ্চিত করেন যে তৃতীয়বার সিজার মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে তাহলে সন্তান নেওয়া থেকে বিরত থাকা বৈধ হবে। এতে গুনাহ হবে না। কারণ ইসলাম নিজেকে ধ্বংসের মুখে ফেলা নিষিদ্ধ করেছে।

❂ গ. জরায়ু অপসারণ (হিস্টেরেকটমি) কেবলমাত্র চূড়ান্ত প্রয়োজনেই করা উচিত:

যদি চিকিৎসক নিশ্চিতভাবে বলেন যে, জরায়ু না কাটলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি হতে পারে তবে শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি বৈধ হবে। তবে শুধুমাত্র সম্ভাব্য সংক্রমণের আশঙ্কায় জরায়ু অপসারণ করা উচিত নয় বরং বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বস্ত চিকিৎসকের সুস্পষ্ট মতামত প্রয়োজন।

❑ ৩. সন্তান গ্রহণ না করলে গুনাহ হবে কি?

অধিক সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে; আবশ্যক করা হয়নি।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

تَزَوَّجُوا الْوَدُودَ الْوَلُودَ فَإِنِّي مُكَاثِرٌ بِكُمُ الْأُمَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

“তোমরা এমন নারীকে বিয়ে করো, যে বেশি ভালোবাসে এবং বেশি সন্তান প্রসব করে। কারণ, আমি কিয়ামতের দিন তোমাদের সংখ্যাধিক্যে গর্ব করব।” [সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ২০৫০, সহিহ]

সুতরাং বিশেষ কারণে কেউ যদি অধিক সন্তান গ্রহণ থেকে বিরত থাকে তাহলে এতে কোনও গুনাহ নেই। কেননা ইসলামে বেশি সন্তান গ্রহণের বিষয়টি তখনই প্রযোজ্য যখন তা মায়ের জন্য ক্ষতির কারণ না হয়। যদি এটি তার জন্য শারীরিক বড় ধরণের ক্ষয়-ক্ষতি বিপদের কারণ হয় তবে তা জরুরি নয়। অর্থাৎ তা শারীরিক সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল। যদি শরীরিক বা চিকিৎসাগত কারণে আপনি সন্তান নেওয়া থেকে বিরত থাকেন তাহলে গুনাহ হবে না। বরং শরিয়ত আপনাকে নিজের স্বাস্থ্য ও জীবনের সুরক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিতে অনুমতি দেয়।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ

“নিজের ক্ষতি করো না এবং অন্যের ক্ষতিসাধন করো না।” [সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস: ২৩৪১, সহিহ]

সুতরাং যদি মা অতিরিক্ত সন্তান ধারণ করলে মারাত্মক শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন তাহলে সন্তান নেওয়া থেকে বিরত থাকা জায়েজ। এতে কোনও গুনাহ নেই ইনশাআল্লাহ।

❑ ৪. চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে শরিয়তের মূলনীতি:

ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞগণ বলেন:

الضرورات تبيح المحظورات

“প্রয়োজনীয়তা নিষিদ্ধ বিষয়কে বৈধ করে তোলে।” [আল-কাওয়ায়িদ আল-ফিকহিয়া]

অতএব যদি শারীরিক সমস্যা বা চিকিৎসাগত কারণে জরায়ু অপসারণ করতে হয় এবং এটি না করলে জীবননাশের ঝুঁকি থাকে তাহলে শরিয়তে তা বৈধ।

❖ পরামর্শ:

প্রথমে একজন অভিজ্ঞ ইসলামি চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যদি ঝুঁকি সত্যিই গুরুতর হয় তাহলে স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ বা জরায়ু অপসারণের মতো পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। তবে শুধুমাত্র সম্ভাব্য ভয় বা আশঙ্কার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন এবং দোয়া করুন যেন তিনি আপনার জন্য কল্যাণ নির্ধারণ করেন।

❖ সারাংশ:

✅ যদি চিকিৎসক বলেন যে, তৃতীয়বার সিজার করালে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে তাহলে সন্তান নেওয়া থেকে বিরত থাকা জায়েজ এবং এতে কোনো গুনাহ নেই।
✅ যদি জরায়ু অপসারণ ছাড়া বিকল্প না থাকে তাহলে তা বৈধ হবে তবে নিশ্চিত হতে একাধিক ইসলামি চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
✅ সন্তান নেওয়া ইসলামে উৎসাহিত হলেও এটি বাধ্যতামূলক নয় বরং শারীরিক সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করে। আল্লাহু আলাম-আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

▬▬▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: