বউ-শাশুড়ির ঝগড়াঝাটি ও মনোমালিন্য: ইসলামী সমাধান

প্রশ্ন: বর্তমানে বউয়েরা শাশুড়িদের প্রতি ছোট ছোট বিষয় নিয়ে বিদ্বেষ পোষণ করে এবং ঝগড়া-ঝাটিতে লিপ্ত হয়। এ ক্ষেত্রে শাশুড়িরাও পিছিয়ে নেই। সুতরাং এ বিষয়ে ইসলামের দিক-নির্দেশনা কি?

উত্তর:
ইসলাম মানুষকে উত্তম চরিত্র, সুন্দর কথা, নম্র ব্যবহার, বিনয়, ধৈর্য, সহনশীলতা, ক্ষমা, বড়দের প্রতি সম্মান ও ছোটদের প্রতি স্নেহ-মমতা ইত্যাদি মহৎগুণের প্রশিক্ষণ দেয়।

সুতরাং কোন মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা, তার সাথে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া, গালাগালি করা, খারাপ ব্যবহার করা জায়েয নাই- চাই সে বউ হোক, শ্বশুর হোক, শাশুড়ি হোক, স্বামী হোক, স্ত্রী হোক বা অন্য কেউ হোক। ইসলামের বিধান সকলের জন্য সমান।

কেউ যদি অন্যায়ভাবে কাউকে গালি দেয়, কষ্ট দেয়, কারও সাথে খারাপ আচরণ করে বা ঝগড়া-ঝাটি করে তাহলে সে তার প্রতি জুলুম করল। আর আখিরাতে জুলুমের পরিণাম খুবই খারাপ।

নিম্নে এ বিষয়টি হাদিসের আলোক তুলে ধরা হল:

🌀 নিম্নোক্ত হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ:

عَنْ أَبي هُرَيرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ قَالَ إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الحَدِيثِ وَلاَ تَحَسَّسُوا وَلاَ تَجَسَّسُوا وَلاَ تَنَافَسُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا وَلاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَدَابَرُوا وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَاناً كَمَا أَمَرَكُمْ المُسْلِمُ أَخُو المُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ التَّقْوَى هاهُنَا التَّقْوَى هاهُنَا وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ بِحَسْبِ امْرِىءٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ المُسْلِمَ كُلُّ المُسْلِمِ عَلَى المُسْلِمِ حَرَامٌ : دَمُهُ وَعِرْضُهُ وَمَالُهُ إِنَّ اللهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى أَجْسَادِكُمْ وَلاَ إِلَى صُوَرِكُمْ وَلكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ وَفِي رواية لاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَجَسَّسُوا وَلاَ تَحَسَّسُوا وَلاَ تَنَاجَشُوا وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْواناً وفي رواية لاَ تَقَاطَعُوا وَلاَ تَدَابَرُوا وَلاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَحَاسَدُوا وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْواناً وَفِي رِواية وَلاَ تَهَاجَرُوا وَلاَ يَبِعْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَيْعِ بَعْضٍ رواه مسلم بكلّ هذِهِ الروايات، وروى البخاريُّ أَكْثَرَهَا

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
‘‘তোমরা কু ধারণা পোষণ করা থেকে বিরত থাক। কারণ কু ধারণা সব চাইতে বড় মিথ্যা কথা।
অপরের গোপনীয় দোষ খুঁজে বেড়ায়ও না।
গোয়েন্দাগিরি করো না।
একে অপরের সাথে (অসৎ কাজে) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করো না,
পরস্পরে হিংসা করো না,
পরস্পরে বিদ্বেষ পোষণ করো না,
একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন হইয়ো না।
তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও; যেমন তিনি তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন।

এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সুতরাং-
 সে তার প্রতি জুলুম করবে না
 তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেবে না
 এবং তাকে তুচ্ছ ভাববে না।
“আল্লাহ ভীতি এখানে রয়েছে… আল্লাহ ভীতি এখানে রয়েছে…” (এ কথা বলে তিনি নিজ বুকের দিকে ইঙ্গিত করলেন।)
(রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:)
 কোন মুসলমান ভাইকে তুচ্ছ ভাবা একটি মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
 প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত, সম্ভ্রম ও সম্পদ অপর মুসলমানের উপর হারাম।
 নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের দেহ ও আকার-আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন।’’

💠 অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘তোমরা পরস্পর হিংসা করো না,
পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, অপরের গোয়েন্দাগিরি করো না, একে অপরের গোপনীয় দোষ খুঁজে বেড়ায়ও না, পরস্পরের পণ্যদ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও।’’

💠 আর এক বর্ণনায় আছে, ‘‘তোমরা পরস্পর সম্পর্ক-ছেদ করো না, একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন হইয়ো না, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর হিংসা করো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও।’’

💠 অন্য আরও এক বর্ণনায় আছে, ‘‘তোমরা একে অন্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো না এবং অপরের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয় করো না।’’ (এ সবগুলি মুসলিম বর্ণনা করেছেন ৬৭০১-৬৭০৫ এবং এর অধিকাংশ বর্ণনা করেছেন বুখারী ৫১৪৩, ৬০৬৪, ৬০৬৬, ৬৭২৪)

🌀 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ.
“মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেকি (পাপাচার) এবং তার সাথে লড়াই করা কুফরি।” (৬০৪৪,৭০৭৬; মুসলিম ১/২৮, হাঃ ৬৪, আহমাদ ৩৬৪৭) (আধুনিক প্রকাশনী: ৪৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬)

🌐 জুলুমের পরিণাম:

ইমাম মুসলিম আবু যার রা. হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ তাআলা হাদিসে কুদসিতে বলেন:
يا عبادي إني حرمت الظلم على نفسي وجعلته بينكم محرماً، فلا تظالموا
“হে আমার বান্দাগণ! আমি জুলুমকে নিজের উপর হারাম করেছি এবং তোমাদের উপরও তা হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর জুলুম করবে না।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
أتقوا الظلم فإن الظلم ظلمات يوم القيامة
“তোমরা জুলুম থেকে বিরত থাকো। কেননা কিয়ামতের দিন জুলুমের পরণাম হবে খুবই অন্ধকার।”(মুসলিম)
কুরআন ও হাদিসে এ মর্মে আরও বহু বক্তব্য এসেছে।

পরিশেষ বলব, প্রতি মুসলিমের জন্য আবশ্যক হল, অপর মুসলিমের মান-সম্মান হেফাজত করা, তাকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও তিরস্কৃত না করা, হেয় না করা, তার প্রতি কোনভাবেই জুলুম-নির্যাতন না করা এবং কষ্ট না দেয়া। কেউ যদি তা করে তাহলে আখিরাতে তাকে আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সেখানে তিনি অবশ্যই সুবিচার করবেন। তিনি জালিমের সওয়াবগুলো কর্তন করে মাজলুম ব্যক্তিকে দান করবেন এবং মাজলুমের গুনাহগুলো জালিমের কাঁধে তুলে দিবেন।

মোটকথা শ্বশুর, শাশুড়ি, বউ, স্বামী, স্ত্রী, পিতা, মাতা, সন্তান, ভাই, বোন এবং সাধারণ মানুষ যেই হোক না কেন সকলের জন্য উপরোক্ত বিধান প্রযোজ্য। বউ, শ্বশুর, শাশুড়ি কেউ এই আওতার বাইরে নয়। অত:এব প্রতিটি মুসলিমের জন্যই আল্লাহকে ভয় করা এবং সময় থাকতে নিজেদের চরিত্রকে সংশোধন করা কর্তব্য। আল্লাহ সকলকে তাওফিক দান করুন। আমীন।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব

Share: