প্রশ্ন:◾ পুলসিরাত কি? এ সম্পর্কে সঠিক আকিদা এবং তার উপর দিয়ে অতিক্রম করার বর্ণনা
উত্তরঃ
🔷 পুলসিরাতের ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদা:
ইমাম ইবনে আবী যায়দ আল কায়রাওয়ানী (মৃত্যু: ৩৮৭ হি:) বলেন, “পুলসিরাত সত্য। (জাহান্নামের উপর স্থাপিত ব্রিজ বা পুল। জান্নাতে যাওয়ার জন্য এটি অতিক্রম ব্যতীত উপায় নেই)। বান্দারা তাদের আমল অনুসারে পুলিসরাত পার হবে। পুলসিরাত পার হওয়ার সময় যারা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে যাবে তাদের পার হওয়ার গতির মধ্যে কমবেশি থাকবে। (অর্থাৎ আমল অনুযায়ী কেউ দ্রুতবেগে আর কেউ মন্থর গতিতে পার হবে)। পুলসিরাত পার হওয়ার সময় কিছু মানুষ তাদের আমলের কারণে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
[মুকদ্দামায়ে ইমাম ইবনে আবী যায়দ আল কায়রাওয়ানী: “আকিদা ও বিশ্বাসের মূলকথা” অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল]
🔷 পুলসিরাতের বিবরণ এবং তার উপর দিয়ে অতিক্রম করার বর্ণনা:
কিয়ামতের দিন জাহান্নামের উপর নির্মিত পুলসিরাতের উপর দিয়ে সকল মানুষকে অবশ্যই অতিক্রম করতে হবে। যেসকল ঈমানদারের জন্য আল্লাহ তাআলা জান্নাতের ফায়সালা করেছেন তারা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাবেন এবং তারা পুলসিরাত অতিক্রম করতে সক্ষম হবেন আর কাফের, মুশরিক, নাস্তিক, মুনাফিকগণ এবং যাদের ওপর জাহান্নামের আগুন অবধারিত হয়ে গেছে তারা পুলসিরাত অতিক্রম করার সময় জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। (মহান আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমিন)
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَإِن مِّنكُمۡ إِلَّا وَارِدُهَاۚ كَانَ عَلَىٰ رَبِّكَ حَتۡمٗا مَّقۡضِيّٗا
ثُمَّ نُنَجِّي ٱلَّذِينَ ٱتَّقَواْ وَّنَذَرُ ٱلظَّٰلِمِينَ فِيهَا جِثِيّٗا
“আর তোমাদের প্রত্যেকেই তার (জাহান্নামের) উপর দিয়েই অতিক্রম করবে, এটা আপনার রবের অনিবার্য সিদ্ধান্ত।” পরে আমরা উদ্ধার করব তাদেরকে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে এবং যালেমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় রেখে দেব।”
[Surah Maryam, Ayah 71-72]
ولا يخفى أن القول بأن الورود هو المرور على الصراط أو الورود على جهنم وهي خامدة فيه جمع بين الأدلة من الكتاب والسنة فينبغي حمل هذه الآية على ذلك، لأنه قد حصل الجمع بحمل الورود على دخول النار مع كون الداخل من المؤمنين مبعدا من عذابها، أو بحمله على المضي فوق الجسر المنصوب علها وهو الصراط. انتهى.
কেমন হবে সেই পুলসিরাত এবং তা অতিক্রমের সময় মানুষের অবস্থা কেমন হবে তা বিবৃত হয়েছে নিম্নোক্ত হাদিসে:
▪️১. সহিহ বুখারির বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
ثُمَّ يُؤْتَى بِالْجَسْرِ فَيُجْعَلُ بَيْنَ ظَهْرَيْ جَهَنَّمَ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا الْجَسْرُ قَالَ مَدْحَضَةٌ مَزِلَّةٌ عَلَيْهِ خَطَاطِيفُ وَكَلاَلِيبُ وَحَسَكَةٌ مُفَلْطَحَةٌ لَهَا شَوْكَةٌ عُقَيْفَاءُ تَكُونُ بِنَجْدٍ يُقَالُ لَهَا السَّعْدَانُ الْمُؤْمِنُ عَلَيْهَا كَالطَّرْفِ وَكَالْبَرْقِ وَكَالرِّيحِ وَكَأَجَاوِيدِ الْخَيْلِ وَالرِّكَابِ فَنَاجٍ مُسَلَّمٌ وَنَاجٍ مَخْدُوشٌ وَمَكْدُوسٌ فِي نَارِ جَهَنَّمَ حَتَّى يَمُرَّ آخِرُهُمْ يُسْحَبُ سَحْبًا
“এমন সময় জাহান্নামের উপর পুল স্থাপন করা হবে। সাহাবীগণ বললেন, সে পুলটি কেমন হবে হে আল্লাহর রাসূল?
তিনি বললেন, “দুর্গম পিচ্ছিল স্থান। এর ওপর আংটা ও হুক থাকবে, শক্ত চওড়া উল্টো কাঁটা বিশিষ্ট হবে, যা নাজদের সাদান বৃক্ষের কাঁটার মত হবে। সে পুলের উপর দিয়ে ঈমানদারগণের কেউ পার হয়ে যাবে চোখের পলকের মতো, কেউ বিদ্যুতের মতো, কেউ বাতাসের মতো আবার কেউ দ্রুতগামী ঘোড়া ও সাওয়ারের মতো।”
তবে মুক্তিপ্রাপ্তরা কেউ নিরাপদে চলে আসবেন, আবার কেউ জাহান্নামের আগুনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। এ কবারে শেষে অতিক্রম করবে যে লোকটি, সে হেঁচড়িয়ে কোন ভাবে পার হয়ে আসবে।”
[সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) অধ্যায়: ৯৭/ তাওহীদ, পরিচ্ছেদঃ ৯৭/২৪. আল্লাহর বাণীঃ কতক মুখ সেদিন উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে। (সূরাহ আল-ক্বিয়ামাহ ৭৫/২২-২৩)]
▪️২. সহিহ মুসলিমে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হয়েছে:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
فَيَمُرُّ أَوَّلُكُمْ كَالْبَرْقِ ” . قَالَ قُلْتُ بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي أَىُّ شَىْءٍ كَمَرِّ الْبَرْقِ قَالَ ” أَلَمْ تَرَوْا إِلَى الْبَرْقِ كَيْفَ يَمُرُّ وَيَرْجِعُ فِي طَرْفَةِ يْنٍ ثُمَّ كَمَرِّ الرِّيحِ ثُمَّ كَمَرِّ الطَّيْرِ وَشَدِّ الرِّجَالِ تَجْرِي بِهِمْ أَعْمَالُهُمْ وَنَبِيُّكُمْ قَائِمٌ عَلَى الصِّرَاطِ يَقُولُ رَبِّ سَلِّمْ سَلِّمْ حَتَّى تَعْجِزَ أَعْمَالُ الْعِبَادِ حَتَّى يَجِيءَ الرَّجُلُ فَلاَ يَسْتَطِيعُ السَّيْرَ إِلاَّ زَحْفًا – قَالَ – وَفِي حَافَتَىِ الصِّرَاطِ كَلاَلِيبُ مُعَلَّقَةٌ مَأْمُورَةٌ بِأَخْذِ مَنْ أُمِرَتْ بِهِ فَمَخْدُوشٌ نَاجٍ وَمَكْدُوسٌ فِي النَّارِ ” . وَالَّذِي نَفْسُ أَبِي هُرَيْرَةَ بِيَدِهِ إِنَّ قَعْرَ جَهَنَّمَ لَسَبْعُونَ خَرِيفًا .
“তোমাদের প্রথম দলটি এ সিরাত বিদ্যুৎ গতিতে পার হয়ে যাবে।”
সাহাবী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার জন্য আমার পিতামাতা উৎসর্গ হউক। আমাকে বলে দিন “বিদ্যুৎ গতির ন্যায়” কথাটির অর্থ কি?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আকাশের বিদ্যুৎ চমক কি কখনো দেখনি? চক্ষের পলকে এখান থেকে সেখানে চলে যায় আবার ফিরে আসে।”
তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এর পরবর্তী দলগুলি যথাক্রমে বায়ুর বেগে, পাখির গতিতে, তারপর লম্বা দৌড়ের গতিতে পার হয়ে! যাবে। প্রত্যেকেই তার আমল হিসাবে তা অতিক্রম করবে।”
আর তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে অবস্থায় পুলসিরাতের উপর দাঁড়িয়ে এ দুআ করতে থাকবে: “হে আল্লাহ, এদেরকে নিরাপদে পৌছে দিন, এদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিন, এদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিন।”
এভাবে মানুষের আমল মানুষকে চলতে অক্ষম করে দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা এ সিরাত অতিক্রম করতে থাকবে।
শেষে এক ব্যক্তিকে দেখা যাবে, সে নিতম্বের উপর ভর করে পথ অতিক্রম করছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, “সিরাতের উভয় পার্শের ঝুলান থাকবে কাঁটাযুক্ত লৌহশলাকা। এরা আল্লাহর নির্দেশ ক্রমে চিহ্নিত পাপীদেরকে পাকড়াও করবে। তন্মধ্যে কাউকে তো ক্ষত-বিক্ষত করেই ছেড়ে দিবে; সে নাজাত পাবে। আর কতক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে জাহান্নামের গর্ভে নিক্ষিপ্ত হবে।”
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, “শপথ সে সত্তার, যার হাতে আবু হুরায়রার প্রাণ। জেনে রাখ, জাহান্নামের গভীরতা সত্তর খারিফ (অর্থাৎ সত্তর হাজার বছরের পথ তুল্য)।:
[সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ১/ কিতাবুল ঈমান, পরিচ্ছেদ: ৮০. সর্বনিম্ন মর্যাদার জান্নাতবাসী]
উল্লেখ্য যে, একটা হাদিস লোকমুখে শোনা যায় যে, “জাহান্নামের উপর নির্মিত সিরাত হেঁটে পার হতে ৪০ বছর লাগবে।” কিন্তু এমন কোনও হাদিস আমার জানা নাই এবং আমার ক্ষুদ্র অনুসন্ধানেও তা পাওয়া যায় নি।
পরিশেষে রাব্বুল আলামীনের দরবারে অতি কাতর কণ্ঠে দোয়া করি, তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টি মূলক কার্যক্রম করার এবং তার নিষেধ কৃত হারাম বিষয়াদি থেকে হেফাজত করেন। আরও দোয়া করি, তিনি যেন নিজ অপার করুণা বলে আমাদেরকে হাশরের মাঠের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি, তাঁর বিচারের কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান হওয়া, হিসাব-নিকাশ, আমলের ওজন এবং সর্বোপরি জাহান্নামের উপরিভাগে অবস্থিত অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও দুর্গম পথ পুলসিরাত অতিক্রম করার কঠিন মুহূর্তে আমাদের উপর দয়া করেন এবং সকল সংকটময় পরিস্থিতিতে সাহায্য করেন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
🔶 উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স,মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
দাঈ,জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদি আরব।