অন্যের গৃহে প্রবেশের ক্ষেত্রে ইসলামি শিষ্টাচার এবং আমাদের সমাজের উদাসীনতা

প্রশ্ন: নামাজ বা কুরআন পড়ার সময় যদি পুরুষ দেখতে পায় তাহলে কি গুনাহ হয়? আমার বোনের স্বামী আমার নামাজ পড়া বা কুরআন পড়া মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখে ফেলে। এ ক্ষেত্রে কী করণীয়?
উত্তর:
মহিলারা সর্বাবস্থায় সতর্কাবস্থায় চলাফেরা করবে যেন বেপর্দা অবস্থায় তাকে কোনও পরপুরুষ দেখে না ফেলে। একইভাবে নামাজ পড়ার সময় বা কুরআন তিলাওয়াতের সময়ও সতর্ক থাকা কর্তব্য। তবে যদি বাড়িতে একাকী বেপর্দা অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াতের সময় হঠাৎ কোনও পরপুরুষ তাকে দেখে ফেলে তাহলে তৎক্ষণাৎ পর্দা করবে। তাহলে ইনশাআল্লাহ তাতে গুনাহ হবে না। কারণ হঠাৎ বেখেয়ালে সংঘটিত গুনাহ-খাতা আল্লাহ ক্ষমা ঘোষণা করে দিয়েছেন। যেমন:

◆ আল্লাহ তাআলা বলেন,
رَبَّنا لا تُؤاخِذنا إِن نَسينا أَو أَخطَأناّ
“হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা যদি ভুলে যাই কিংবা হঠাৎ অনিচ্ছাবশত: কোন ভুল করে ফেলি তবে আমাদেরকে ধরিও না।” [সূরা বাকারা: ২৮৬]

◆ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«إِنَّ اللَّهَ قَدْ تَجَاوَزَ عَنْ أُمَّتِي الْخَطَأَ ، وَالنِّسْيَانَ ، وَمَا اسْتُكْرِهُوا عَلَيْهِ».
“আমার উম্মতের হঠাৎ ঘটে যাওয়া ভুল, স্মরণ না থাকার কারণে ঘটে যাওয়া অন্যায় এবং জোরজবরদস্তি করে কৃত অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।” [ইবনে মাজাহ: ২০৪৩; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৭১৭৫, বায়হাকি-হাসান]
আল্লাহ আমাদের জানা-অজানা ইচ্ছাকৃত অনিচ্ছাকৃত সকল অপরাধ ক্ষমা করুন। আমীন।

❑ ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যের বাড়িতে প্রবেশের পূর্বে অনুমতি গ্রহণের আবশ্যকতা:

আমাদের জানা আবশ্যক যে, ইসলামের দৃষ্টিতে কোন পরপুরুষের জন্য অনুমতি ছাড়া অন্যের বাড়িতে হঠাৎ প্রবেশ করা জায়েজ নাই। বরং ইসলামের বিধান হল, সে বাড়ির বাইরে দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি নিবে। অতঃপর প্রবেশের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করবে (এভাবে তিনবার করবে)। তারপর যদি তাকে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয় তাহলে প্রবেশ করবে; অন্যথায় প্রত্যাবর্তন করবে।

◆ আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّىٰ تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَىٰ أَهْلِهَا ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
“হে মুমিনগণ, নিজেদের গৃহ ছাড়া তোমরা গৃহে প্রবেশ কর না যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি নাও গৃহবাসীদেরকে সালাম করো। এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম, যাতে তোমরা স্মরণ রাখ।” [সূরা নূর: ২৭]

◆ এরপর তিনি আরও বলেন,
فَإِن لَّمْ تَجِدُوا فِيهَا أَحَدًا فَلَا تَدْخُلُوهَا حَتَّىٰ يُؤْذَنَ لَكُمْ ۖ وَإِن قِيلَ لَكُمُ ارْجِعُوا فَارْجِعُوا ۖ هُوَ أَزْكَىٰ لَكُمْ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ
“যদি তোমরা গৃহে কাউকে না পাও, তবে অনুমতি গ্রহণ না করা পর্যন্ত সেখানে প্রবেশ করো না। যদি তোমাদেরকে বলা হয় ফিরে যাও, তবে ফিরে যাবে। এতে তোমাদের জন্যে অনেক পবিত্রতা আছে এবং তোমরা যা কর, আল্লাহ তা ভালো ভাবে জানেন।” [সূরা নূর: ২৮]

◆ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
الاِسْتِئْذَانُ ثَلاَثٌ فَإِنْ أُذِنَ لَكَ وَإِلاَّ فَارْجِعْ
“অনুমতি গ্রহণ তিন বার। তাতে যদি তোমাকে অনুমতি দেওয়া হয় তবে ভালো। অন্যথায় ফিরে আস।” [সহীহ মুসলিম (ই.ফা), অধ্যায়: ৩৯/ শিষ্টাচার, পরিচ্ছেদ: ৮. অনুমতি গ্রহণ প্রসঙ্গে]

❑ অন্যের বাড়িতে প্রবেশের পূর্বে অনুমতি গ্রহণের উদ্দেশ্য:

কারও বাড়িতে প্রবেশের পূর্বে অনুমতি নেয়ার নির্দেশ দেয়ার উদ্দেশ্য হল, যেন বাড়িতে অবস্থান রত পর্দা হীন কোনও পর নারীর প্রতি পরপুরুষের দৃষ্টি না পড়ে বা অপ্রস্তুত অবস্থায় বাড়ির লোকজনকে কেউ না দেখে।

যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, সাহল ইবনে সা‘দ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إنَّمَا جُعِلَ الاِسْتِئذَانُ مِنْ أجْلِ البَصَرِ
‘‘দৃষ্টির কারণেই তো (প্রবেশ) অনুমতির বিধান করা হয়েছে।’’ (অর্থাৎ দৃষ্টি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে ঐ নির্দেশ।) [বুখারি ও মুসলিম]

❑ অন্যের বাড়িতে প্রবেশের ইসলামি আদবের প্রতি আমাদের সমাজের অধিকাংশ লোকের অজ্ঞতা ও অবহেলা:

দুর্ভাগ্য বশত: আমাদের সমাজে অধিকাংশ দেবর-ভাসুর, দুলাভাই, বোন জামাই, বেয়াই ইত্যাদি নিকটাত্মীয় পরপুরুষগণ নিকটাত্মীয়দের বাড়িতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ইসলামি আদব-কায়দার ধার ধারে না বা আদতেই তারা এ বিষয়ে জ্ঞান রাখে না। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে এ জাতীয় নন মাহরাম নিকটাত্মীয়কে ‘মৃত্যু’ সমতুল্য বলা হয়েছে। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏”‏ إِيَّاكُمْ وَالدُّخُولَ عَلَى النِّسَاءِ ‏”‏ ‏.‏ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الأَنْصَارِ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ قَالَ ‏”‏ الْحَمْوُ الْمَوْتُ ‏”‏
উকবা ইবনে আমির রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সাবধান! তোমরা মহিলাদের ঘরে প্রবেশ করবে না।
আনসারদের এক ব্যক্তি বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, শ্বশুর গোষ্ঠীর নিকটাত্মীয় (যেমন: দেবর-ভাবী, শালী-দুলাভাই, বেয়াই-বেয়াইন ইত্যাদি ব্যক্তিগণ যারা পরস্পরের জন্য মাহরাম নয়) সম্পর্কে আপনার মত কি?
তিনি বললেন: “সে তো মৃত্যু (সমতুল্য)।”
[বুখারি ও মুসলিম। সুনান আত তিরমিযি [তহকীক কৃত] হা/১১৭১, অধ্যায়: ১০/ শিশুর দুধ পান, পরিচ্ছদ: ১৬. যার স্বামী অনুপস্থিত তার সাথে দেখা করা নিষেধ]
ইমাম নওবী রাহ. বলেন:
فمعناه: أن الخوف منه أكثر من غيره، والشر يُتوقع منه والفتنة أكثر لتمكُّنه من الوصول إلى المرأة والخلوة من غير أن يُنكَر عليه بخلاف الأجنبي
(স্বামীর নন মাহরাম নিকটাত্মীয়কে ‘মৃত্যু সমতুল্য’ বলার) অর্থ হল: অন্যদের তুলনায় তার ব্যাপারে ভয় বেশি। তার মাধ্যমে ক্ষতি ও ফেতনার সম্ভাবনা অধিক। কারণে সে বিনা বাদ-প্রতিবাদে যেভাবে একজন নারীর কাছে পৌঁছুতে পারে এবং একাকী তার কাছে যেতে সক্ষম হয় বাইরের অন্য কারো দ্বারা তা সম্ভব নয়।” [শরহে মুসলিম-ইমাম নওবী রহ.]

আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের সঠিক জ্ঞান দান করুন এবং ইসলাম অনুযায়ী জীবন যাপনের তওফিক দান করুন। আমিন।
الله أعلم

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।