আমাদের সমাজে নিম্নোক্ত হাদিসটি ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধ। অনেক ইসলামি বই-পুস্তক এবং বক্তাদের মুখে তা প্রায় শোনা যায়। প্রচলিত হাদিসটি হলো,
النساء حبائل الشيطان
“নারীরা শয়তানের ফাঁদ।” কিন্তু মুহাদ্দিসদের গবেষণায় উক্ত হাদিসটি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদিস হিসেবে প্রমাণিত নয়। অনেক মুহাদ্দিসের মতে তা বানোয়াট বা জাল। আবার অনেকের মতে তা সনদগতভাবে অত্যন্ত দুর্বল।
নিম্নে এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মতামত উল্লেখ পূর্বক হাদিসটি মান উল্লেখ করা হলো:
◈ ১. আবুশ শাইখ আসপাহানি [আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ আসপাহানি (জন্ম:২৭৪, মৃত্যু: ৩৬৯ হিজরি মোতাবেক ৮৮৭-৯৭৯ খৃষ্টাব্দ)] তার আল আমসাল গ্রন্থে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি লম্বা বক্তৃতা উল্লেখ করেছেন। সে বক্তৃতার মধ্যে উক্ত বাক্যটি রয়েছে। কিন্তু উক্ত বক্তৃতাটি সহিহ সনদে প্রমাণিত নয়। বরং তা মুহাদ্দিসগণের নিকট ضعيف جدا বা অত্যধিক দুর্বল। কেননা এর সনদে দু জন অভিযুক্ত রাবি (বর্ণনাকারী) রয়েছে। যেমন:
◆ ক. আবু উবায়দ আল আত্তার। তিনি متروك الحديث বা মুহাদ্দিসগণের নিকট পরিত্যাজ্য।
◆ খ. আমর বিন সাবেত। এই ব্যক্তি শিয়া-রাফেজি এবং দুর্বল।
◈ ২. এ হাদিসটি মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-এ ইবনে মাসউদ রা. থেকে মওকুফ সূত্রে উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ এই সূত্র অনুযায়ী এটি প্রখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর বক্তব্য; আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদিস নয়।
◈ ৩. ইমাম বায়হাকি তার দালায়েলুন নবুওয়াহ কিতাবেও উক্ত লম্বা বক্তৃতাটি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেটিও সনদগতভাবে শুদ্ধ নয় বরং তা ضعيف جدا বা অত্যধিক দুর্বল। কেননা এর বর্ণনা সূত্রে ৪ জন রাবি বা বর্ণনাকারীর ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ আপত্তি করেছেন। মুহাদ্দিসগণ বলেন,
ابو أمية الطرسوسى ضعيف.
يعقوب بن محمد بن عيسى الزهرى و هو ضعيف في حديثه نكارة، و لكن يعتبر به.
عبد العزيز بن عمران الزهرى و هو ابن أبي ثابت و هو متروك الحديث.
عبدالله بن مصعب و أبيه لم أعرفهما
◈ ৪. এ ছাড়াও কাসেম বিন মুসা [মৃত্যু: ৩০২ হিজরি] তার জুয-এ উক্ত লম্বা বক্তৃতাটি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেটিও সনদগতভাবে মুনকার। কারণ মুহাদ্দিসগণ বলেন,
عبد الله بن مصعب بن خالد الجهنى و أبيه مجهولان
“আব্দুল্লাহ বিন মুসআব বিন খালেদ আল জুহানি বর্ণনা করেছেন তার পিতা থেকে। কিন্তু দুজনই মাজহুল বা অজ্ঞাত পরিচয়।”
قال العراقي في تخريج الاحياء:” أخرجه الأصفهاني في الترغيب والترهيب من حديث خالد بن زيد الجهني بإسناد فيه جهالة
[সোর্স: al-maktaba]
◈ ৫. ইমাম সাখাবি এ হাদিসটিকে তার বানোয়াট বা জাল হাদিস সংকলন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
[দ্রষ্টব্য: আল মাকাসিদুল হাসানা كتاب المقاصد الحسنة في بيان كثير من الأحاديث المشتهرة على الألسنة, বানোয়াট হাদিস নং-১২৭৪]
◈ ৬. আল্লামা মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন আলবানি রাহ. “নারীরা শয়তানের ফাঁদ” শীর্ষক প্রচলিত এ হাদিসটি সম্পর্কে বলেন,
هذا لا اصل له في الحديث ، ومعناه لا ينبغي إطلاقه علي الناس لأن فيه هضم لهن بصورعامة والنساء كما قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ( شقائق الرجال) ففيهن الطالحة والصالحة كالرجال ، وإن كان الرجال تميزوا عليهن بكثرة الصالحين كما أشار الرسول صلى الله عليه وسلم بقوله كمل من الرجال كثير ولم يكمل من النساء إلا آسيا ومريم
“হাদিসে এ কথার কোনও ভিত্তি নাই। আর তার মমার্থটাও মানুষের উপর ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা উচিত নয়। কারণ তা সাধারণভাবে নারীদের জন্য অপমান জনক। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
النِّسَاءُ شَقَائِقُ الرِّجَالِ
“নারীরা পুরুষদের সমকক্ষ।”
সুতরাং পুরুষদের মত তাদের মধ্যেও ভালো-মন্দ রয়েছে। যদিও পুরুষরা এদিক থেকে বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত যে, তাদের মধ্যে নারীদের তুলনায় সৎ লোকের সংখ্যা বেশি। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন,
كَمَلَ مِنَ الرِّجالِ كَثِيرٌ، ولَمْ يَكْمُلْ مِنَ النِّساءِ إلَّا مَرْيَمُ بنْتُ عِمْرانَ، وآسِيَةُ امْرَأَةُ فِرْعَوْنَ
“পুরুষদের মধ্যে অনেক মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। কিন্তু মহিলাদের মধ্যে ইমরান কন্যা মরিয়ম আ. এবং ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া আ., খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ-এর মত আর কেউ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেনি।” (অন্য বর্ণনায় ফাতিমা রা.-এর নাম এসেছে-অনুবাদক)। [source: kulalsalafiyee]
তবে অন্যত্র এ হাদিসটিকে জইফ বা দুর্বল বলেছেন। [সিলসিলা যাইফা, ২৪৬৪, যইফুত তারগিব, ১৪১৪]
অবশ্য এ হাদিস বানোয়াট হলেও এ মর্মার্থটাকে অনেক আলেম সঠিক বলেছেন। কারণ শয়তান নারীর ফাঁদে ফেলে অসংখ্য দ্বীনদার-পরহেজগার ভালো মানুষকে ধ্বংস করেছে। এটা বাস্তব সত্য। অর্থাৎ এটি হাদিস নয় তবে একটি আরবি প্রবাদ বাক্য। এর মাধ্যমে দুশ্চরিত্রা নারীদের থেকে সাবধান করা হয়েছে; সকল নারী উদ্দেশ্য নয়।
নারী ফিতনার ব্যাপারে কুরআন এবং বিশুদ্ধ হাদিসে অনেক সতর্কতা মূলক বক্তব্য এসেছে। সেগুলোই আমাদের জন্য যথেষ্ট। এসব জাল-বানোয়াট বা অপ্রমাণিত হাদিসের আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই। আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরণের ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে রক্ষা করুন। আমিন। আল্লাহু আলাম।
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।