তাবলীগ জামায়াত, সৌদি আলেমগণ এবং সৌদি সরকারের শরিয়া বিরোধী কার্যক্রম

তাবলীগ জামায়াত, সৌদি আলেমগণ এবং সৌদি সরকারের শরিয়া বিরোধী কার্যক্রম:

বর্তমানে তাবলীগ জামাআত বিষয়ে সৌদি আলেমদের কড়া অবস্থান ও জুমার খুতবা বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম। একেকজন একেক ভাবে বিশ্লেষণ করছেন। কেউ সৌদি আলেমদের অবস্থানকে সমর্থন করছেন আর কেউ রাগে-ক্ষোভে চরম মাত্রায় সৌদি বিরোধী বিষোদগার করে চলেছেন। এ ছাড়াও সৌদি আরবে সম্প্রতি বেশ কিছু শরিয়া বিরোধী কিছু কার্যক্রম সংগঠিত হওয়ার ব্যাপারে সৌদি আলেমদের অবস্থানের বিষয়েও সামান্য আলোকপাত করার প্রয়োজন মনে করলাম।

সহিহ আকিদার অনুসারী হিসেবে পরিচিত এক সম্মানিত ভাই লিখছেন, “সৌদি শায়খদের উচিৎ, আগে নিজের দেশের বাদশাহর ইসলাম বিরোধী অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা।”

এটি শুধু তার নয় বরং বহু মানুষের মত।

যাহোক, নিম্নে এর সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়া হল:

❑ এক. প্রিয় ভাই, আমি জানি না, আপনি একমত কি না যে, ভারতের ইলিয়াসী তাবলীগ জামাআত অজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত একটা ভ্রান্ত সুফিবাদী ও বিদআত প্রচার কারী জামাআত। (দ্বিমত পোষণ করলে তা ভিন্ন আলোচনার বিষয়) যদি এ কথায় একমত হয়ে থাকেন তাহলে এ কথাও মানতে দ্বিধা থাকার কথা নয় যে, সর্বস্তরের মুসলিমের জন্য বিদআতিদের বিদআতি কার্যক্রমের প্রতিবাদ জানানো আবশ্যক।

তাবলীগ জামাআতের মাধ্যমে কিছু মানুষ দাঁড়ি-টুপি পরে মসজিদ মুখী হয়েছে বলে ধোঁকা খাওয়ার সুযোগ নাই। কারণ বিদাতি পন্থায় যদি কেউ নামাজ পড়ে কপালে দাগ ফেলে দেয়, বিশাল আলখেল্লা ও লম্বা জামা পড়ে, মুখে লম্বা দাড়ি রেখে চলাফেরা করে তবুও আল্লাহর কাছে এসবের কানাকড়িরও মূল্য নাই।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করল যে ব্যাপারে আমার আদেশ (বা অনুমোদন) নেই তা পরিত্যাজ্য।” [বুখারী ও মুসলিম]

অন্য হাদিসে এসেছে:
مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ.
“যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।” [বুখারী ও মুসলিম]

আপনি খেয়াল করে দেখবেন, পৃথিবীতে যত ভণ্ড পীর, সংগঠন ও মতবাদ আছে (যেমন: কবর পূজারী আটরশী, মাইজভাণ্ডারী, কথিত সুন্নি জামাআত, হিযবুত তাওহীদ, এমন কি কাদিয়ানী সম্প্রদায় ইত্যাদি) তাদের মাধ্যমে বহু মানুষ সুদ-ঘুষ ছেড়েছে, চুরি-ডাকাতি ও যেনা-ব্যভিচার ছেড়ে ভালো হয়েছে। কিন্তু তাই বলে কোনও তাওহীদ ও সুন্নাহ পন্থী ব্যক্তি এদেরকে ‘সঠিক’ বলে স্বীকৃতি প্রদান করতে বা তাদেরকে সমর্থন করতে পারে না। কারণ এ কথা স্বতঃ সিদ্ধ যে, আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ ও তার দেখানো পদ্ধতি বহির্ভূত কোনও আমলই কবুল করবেন না-বাহ্যত তা যতই ইখলাস পূর্ণ, সুন্দর ও আকর্ষণীয় হোক না কেন।

আর সে কারণেই শয়তানের কাছে পাপাচার থেকে বিদআত অধিক পছন্দনীয়।

◉ ইমাম সুফিয়ান সাওরী রাহ. বলেন,
إن البدعة أحب إلى إبليس من المعصية لأن البدعة لا يُتاب منها والمعصية يُتاب منها
“ইবলিসের নিকট পাপাচার থেকে বিদআত অধিক প্রিয়। কেননা, বিদআত থেকে তওবা করা হয় না কিন্তু পাপাচার থেকে তওবা করা হয়।” [শারহুস সুন্নাহ লিল বাগাভী ১/২১৬, আত তুহফাতুল ইরাকিয়া ফিল আমালিল কালবিয়া, পৃষ্ঠা নং ১২ ]

◉ শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া রাহ. বলেন,
الزِّنَا مَعْصِيَةٌ وَالبِدْعَةُ شَرٌّ مِنَ المَعْصِيَةِ
“জিনা পাপ কিন্তু বিদআত পাপের থেকেও খারাপ।”

◉ বিদআতিকে সহযোগিতা করা ইসলাম ধ্বংসে সহযোগিতা করার শামিল:
ফুযাইল ইবনে ইয়ায রাহ, বলেন,
من أعان صاحب بدعة فقد أعان على هدم الإسلام
“যে ব্যক্তি বিদআত পন্থীকে সহযোগিতা করল সে যেন দ্বীন ধ্বংস করতে সহযোগিতা করল।” [খাসায়িসু আহলিস সুন্নাহ]

◉ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বিদআতিদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দিয়েছেন:

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. জানতে পারলেন যে, কিছু লোক মসজিদে একত্রিত হয়ে উচ্চস্বরে জিকির এবং দরুদ পড়ছিলেন। তিনি তাদের কাছে এসে বললেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জামানায় কাউকে এভাবে জিকির করতে বা দরূদ পড়তে দেখিনি। অতএব আমি তোমাদেরকে বিদআতি মনে করি। তিনি এ কথাটি বারবার বলেছিলেন, এমনকি তাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দিলেন। [আবু নুআইম]

সুতরাং বিদআতি ব্যক্তি, সংগঠন, জামাআত, বই-পুস্তক, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির প্রতিবাদ করা প্রত্যেক মুক্তিকামী মুসলিমের জন্য আবশ্যক। সৌদি আরবের আলেমদের জন্য যেমন তা আবশ্যক তেমনি আমাদের দেশ সহ পৃথিবীর সকল দেশের আলেম ও তাওহীদ সুন্নাহপন্থী মানুষের জন্য তা আবশ্যক।

সৌদি আরবের আলেমগণ এ বারই প্রথম এ বিষয়ে প্রতিবাদ করেছেন তা নয়। বরং এর আগেও এদের ব্যাপারে অসংখ্যবার জাতিকে সাবধান করেছেন (এ ব্যাপারে শাইখ বিন বায, উসাইমিন, ফাওযান সহ বড় বড় আলেমদের স্পষ্ট ফতোয়া রয়েছে), এখনো করছেন এবং আশা করি, ভবিষ্যতেও করবেন যেভাবে বিশ্বের সকল সালাফি ও তাওহীদ বাদী আলেমগণ অতীতে তাদের বিরোধিতা করেছেন, এখনো করছেন এবং ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও করবেন-যতদিন না তারা ভ্রান্ত সুফিবাদী ও বিদআতি কার্যক্রম থেকে বিরত হবে।

❑ দুই. সৌদি আলেমগণ কি সরকারের শরিয়ত বিরোধী কার্যক্রমের প্রতিবাদ করেন না?
উত্তর:
আমাদের দৃষ্টিতে, সৌদি আরবের বড় আলেমগণ আল হামদুলিল্লাহ বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বিশুদ্ধ আকিদা ও নির্ভেজাল মানহাজের অনুসারী নির্ভরযোগ্য আলেমে দীন। তারা শিরক, বিদআত এবং সব ধরণের শরিয়ত পরিপন্থী বিষয়ে সবসময় সোচ্চার। তারা শিরক-বিদআতের পাশাপাশি নাচ, গান, সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা, মদ, জুয়া, বেহায়াপনা, নারীদের মুখ খোলা, বিড়ি-সিগারেট ইত্যাদি অপসংস্কৃতি এবং সরকার কর্তৃক প্রচলিত ইনস্যুরেন্স, ভ্যাট ইত্যাদি সব ব্যাপারে স্পষ্ট প্রতিবাদ করেছেন এবং ফতোয়া দিয়েছেন।
(নিম্নে তার উদাহরণ হিসেবে কিছু লিংক দেয়া হল)

তবে সরকারের শরিয়া পরিপন্থী কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য তার শরিয়া সম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করেন। আর তা হল, শাসকের সাথে সরাসরি সাক্ষাত করে এসব বিষয়ে আন্তরিকতা সহকারে নসিহত করা ও বুঝানো। এটাই সঠিক পদ্ধতি। এতে হয়ত কখনো সফলতা আসে আর কখনো আসে না। কিন্তু প্রচেষ্টার অব্যাহত রাখেন।

তারা এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে স্টেজে সরকার বিরোধী রক্ত গরম করা বক্তৃতা দিয়ে বা মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে জনসাধারণকে উত্তেজিত করে সরকারের সাথে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিয়ে রক্তপাত ও জানমালের ক্ষতিসাধন করার মত হঠকারী আচরণ করাকে বৈধ মনে করেন না। কারণ এটা মূলত: খাওয়ারেজ ও শিয়া মানহাজ (নীতি)। যদিও দুর্ভাগ্য যে, বর্তমান যুগের অধিকাংশ মুসলিম আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের এই মানহাজকে ভুলে খারেজিও শিয়া মানহাজকেই সঠিক বলে ধরে নিয়েছে। আল্লাহ তাআলা সকলকে দীনের সঠিক জ্ঞান দান করেন। আমিন।

◍ সৌদি আরবে সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা এবং নাচ-গানের অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যাপারে সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি এবং সিনিয়র স্কলার কাউন্সিল প্রধান শাইখ আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন আব্দুল্লাহ আলুশ শায়খ এর ফতোয়া:
লিংক:
– আল জাযিরা:
https://www.aljazeera.net/news/arabic/2017/1/15/%D9%85%D9%81%D8%AA%D9%8A-%D8%A7%D9%84%D8%B3%D8%B9%D9%88%D8%AF%D9%8A%D8%A9-%D8%A7%D9%84%D8%B3%D9%8A%D9%86%D9%85%D8%A7-%D9%88%D8%A7%D9%84%D8%AD%D9%81%D9%84%D8%A7%D8%AA
-বিবিসি অ্যারোবিক:
https://www.bbc.com/arabic/middleeast-38623226
– ভিডিও:

◍ প্রিন্সেস আদেলা বিনতে আব্দুল্লাহ বিনতে আব্দুল আজিজ (বাদশাহ আব্দুল্লাহ রহ. এর মেয়ে) এর মহিলাদের মুখমণ্ডল খোলা বিষয়ক বক্তৃতা এবং নারীবাদী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, মসজিদে নববীর মুদাররিস স্বনামধন্য বিশিষ্ট আলেমে দীন আল্লামা শায়খ আব্দুল মুহসিন আল আব্বাদ (হাফিযাহুল্লাহ) বই লিখে তার প্রতিবাদ করেন।
বইটির লিংক:

ليس هذا من العدل يا عادلة

◍ সৌদি সরকারের ইনস্যুরেন্সের বিরুদ্ধে শাইখ সালেহ আল ফাউযান এর ফতোয়া:

◍ আল্লাহর বিধান ব্যতিরেকে রাষ্ট্রপরিচালনা হারাম হওয়া প্রসঙ্গে গ্র্যান্ড মুফতি:

এভাবে প্রতিটি হারাম ও শরিয়ত বিরোধী কার্যক্রমের বিষয়ে সৌদি আলেমগণ দ্ব্যর্থ হীনভাবে ফতোয়া প্রদান করে থাকেন-আল হামদুলিল্লাহ। যদিও খাওয়ারেজ ও শিয়া প্রেমিক গোষ্ঠী সাধারণ জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে নামিয়ে দিয়ে দেশে রক্তের বন্যা বইয়ে দিতে চায়।
আল্লাহ তাআলা এই ভ্রান্ত আকিদার অনুসারীদের মুখোশ উন্মোচন করুন এবং তাদের অনিষ্ট থেকে মুসলিম উম্মাহকে হেফাজত করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।

❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖❖
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

Share: