একটি মাছির কারণে জাহান্নাম মর্মে ব্যাপক প্রচলিত হাদিস বিষয়ে জরুরি দৃষ্টি আকর্ষণী ও ভ্রান্তি নিরসন

মাছির হাদিসটি আমাদের সমাজে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস হিসেবে প্রচলিত। অনেক বক্তাও শিরকের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে যথাযথ তাহকীক না করে এ ঘটনাটিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস হিসেবে পেশ করে থাকেন। কিন্তু তা ঠিক নয় বরং সঠিক হল, এটি সালমান ফারেসী রা. এর উক্তি মাত্র।

ঘটনাটি নিম্নরূপ:
روى الإمام أحمد في “الزهد” (84) قال: حَدَّثَنَا أَبُو مُعَاوِيَةَ، حَدَّثَنَا الْأَعْمَشُ، عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ مَيْسَرَةَ، عَنْ طَارِقِ بْنِ شِهَابٍ، عَنْ سُلَيْمَانَ قَالَ: ( دَخَلَ رَجُلٌ الْجَنَّةَ فِي ذُبَابٍ، وَدَخَلَ النَّارَ رَجُلٌ فِي ذُبَابٍ.

قَالُوا: وَكَيْفَ ذَلِكَ؟

قَالَ: مَرَّ رَجُلَانِ عَلَى قَوْمٍ لَهُمْ صَنَمٌ لَا يَجُوزُهُ أَحَدٌ حَتَّى يُقَرِّبَ لَهُ شَيْئًا، فَقَالُوا لِأَحَدِهِمَا: قَرِّبْ! قَالَ: لَيْسَ عِنْدِي شَيْءٌ، فَقَالُوا لَهُ: قَرِّبْ وَلَوْ ذُبَابًا! فَقَرَّبَ ذُبَابًا، فَخَلَّوْا سَبِيلَهُ.

قَالَ: فَدَخَلَ النَّارَ. وَقَالُوا لِلْآخَرِ: قَرِّبْ وَلَوْ ذُبَابًا! قَالَ: مَا كُنْتُ لِأُقَرِّبَ لِأَحَدٍ شَيْئًا دُونَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، قَالَ: فَضَرَبُوا عُنُقَهُ، قَالَ: فَدَخَلَ الْجَنَّةَ ) .
তারিক বিন শিহাব সালমান রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘‘এক ব্যক্তি একটি মাছিকে কেন্দ্র করে জান্নাতে প্রবেশ করেছে। আর এক ব্যক্তি একটি মাছিকে কেন্দ্র করে জাহান্নামে গিয়েছে।
শ্রোতাগণ প্রশ্ন করলেন, তা কীভাবে?

তিনি বললেন, (পূর্বযুগে) দু জন লোক এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট দিয়ে যাচ্ছিল যাদের একটা মূর্তি ছিল। কোনও ব্যক্তিকে সে স্থান ত্যাগ করার সুযোগ দেয়া হত না যতক্ষণ না সে উক্ত মূর্তির উদ্দেশ্যে কিছু নজরানা পেশ করে।

যাহোক, তারা দু জনের একজনকে বলল, নজরানা পেশ কর।
সে বলল, আমার কাছে কিছুই নেই।
তারা বলল, একটা মাছি হলেও পেশ করো।

অতঃপর সে একটা মাছি নজরানা দিলে তারা তার পথ ছেড়ে দিলো।

তিনি বললেন, এর ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করল।

অপর ব্যক্তিকে তারা বলল, ‘‘মূর্তির উদ্দেশ্যে একটা মাছি হলেও নজরানা পেশ করো।
সে বলল, আমি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে নজরানা দেই না।
এর ফলে তারা তার গর্দান উড়িয়ে দিলো।

তিনি বলেন, ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করল।
[মুসনাদে আহমদ, অধ্যায়: যুহুদ/৮৪]

এ হাদিসে দেখা গেল, মুসনাদে আহমদে এটি সাহাবি সালমান ফারেসী রা. বক্তব্য হিসেবেই উল্লেখিত হয়েছে এবং শাইখ আলবানী সহ অন্যান্য মুহাক্কিক মুহাদ্দিসগণ এটিকে موقوف (মাওকুফ) তথা সালমান ফারেসী রা. এর বক্তব্য হিসেবে সহিহ বলেছেন; مرفوع (মারফু) তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুখ নিঃসৃত হাদিস হিসেবে নয়। [দ্রষ্টব্য: সিলসিলা যাইফাহ ১২/ ৭২২]

সুতরাং তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস হিসেবে প্রচার করা জায়েজ নাই। অন্যথায় তা তাঁর নামে মিথ্যাচার বলে গণ্য হবে। (আল্লাহ ক্ষমা করুন)।

❑ আর এ ঘটনার বিধান কয়েকটি কারণে গ্রহণযোগ্য নয়:

◍ এক. আলেমগণ বলেন, সালমান ফারেসী রা. হয়ত খৃষ্টান থাকা অবস্থায় খৃষ্টান পাদ্রীদের থেকে তা গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এটি ইসরাইলি বর্ণনা। যেমন: শাইখ আলবানী বলেন,
” إلا أنه يظهر لي أنه من الإسرائيليات التي كان تلقاها عن أسياده حينما كان نصرانيا ” انتهى، من “سلسلة الأحاديث الضعيفة” (12 / 722)
“তবে আমার মনে হয়, এটি ইসরাইলি বর্ণনার অন্তর্ভুক্ত যা তিনি খৃষ্টান থাকা অবস্থায় খৃষ্টান পাদ্রীদের থেকে গ্রহণ করেছেন। [দ্রষ্টব্য: সিলসিলা যাইফাহ ১২/ ৭২২]

সুতরাং ঘটনাটি সত্য-মিথ্যা কোনটাই বলার সুযোগ নাই। কেননা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لا تُصَدِّقُوا أَهْلَ الكِتَابِ وَلا تُكَذِّبُوهُمْ ، وَقُولُوا: ( آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا ) الآيَةَ
“তোমরা আহলে কিতাব তথা ইহুদি-খৃষ্টানদেরকে সত্য বা মিথ্যা কোনটাই বল না। বরং বল, “আমরা আল্লাহ এবং আমাদের উপর যা নাজিল করা হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছি।’’ (সূরা বাকারা: ১৩৬)
[সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ৯৭/ তাওহীদ, পরিচ্ছেদ: ৬৫/২/১১. মহান আল্লাহর বাণী: তোমরা বল, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি।]

◍ দুই. তাছাড়া এ বক্তব্যটি কুরআনের আয়াত ও অন্যান্য সহিহ হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক-যেগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, শত্রুর কবলে জীবন বিপন্ন হওয়া বা বড় ধরণের ক্ষয়-ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে অন্তরে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস অটুট রেখে আত্ম রক্ষার্থে বাহ্যিক ভাবে শিরকি বা কুফরি কাজ করলে বা কথা উচ্চারণ করলেও তাতে ঈমান নষ্ট হয় না। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَن كَفَرَ بِاللَّـهِ مِن بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَـٰكِن مَّن شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِّنَ اللَّـهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
“যার উপর জবরদস্তি করা হয় এবং তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে সে ব্যতীত যে কেউ বিশ্বাসী হওয়ার পর আল্লাহতে অবিশ্বাসী হয় এবং কুফরির জন্য মন উন্মুক্ত করে দেয় তাদের উপর আপতিত হবে আল্লাহর ক্রোধ এবং তাদের জন্যে রয়েছে শাস্তি।” [সূরা আন নহল: ১০৬]
-প্রখ্যাত তাফসীর বিদ আবু বকর আল জাসসাস বলেন,
هذا أصل في جواز إظهار كلمة الكفر في حال الإكراه
“বাধ্যতামূলকভাবে কুফরি বাক্য উচ্চারণ জায়েজ হওয়ার পক্ষে এই আয়াতটি মূল দলিল।“ [আহকামুল কুরআন ৩/১৯২]
– বিশিষ্ট মুফাসসির ইমাম বাগভি রহ. তার তাফসীর গ্রন্থে বলেন,
وأجمع العلماء على: أن من أكره على كلمة الكفر، يجوز له أن يقول بلسانه
“এটি আলেমদের সর্বসম্মত অভিমত যে, কাউকে যদি কুফরি কথা বলার জন্য জবরদস্তী করা হয় তার জন্য তা মুখে উচ্চারণ করা জায়েজ।“ [তাফসীরে বাগভী- মাআলিমুত তানযিল ৫/৪৬]

আর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
عُفِيَ لأمَّتي عن الخطأِ والنِّسيانِ وما استُكرِهوا عليهِ
“আমার উম্মতের হঠাৎ ঘটে যাওয়া ভুল, স্মরণ না থাকার কারণে ঘটে যাওয়া গুনাহ এবং জোরজবরদস্তি মূলক কৃত অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।” [ইবনে হাযম রা. রচিত আল মুহাল্লা, তিনি এটিকে সহীহ বলেছেন]

◍ তিন. অথবা বলা যেতে পারে, এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পূর্ব যুগের শরিয়তের বিধান ছিল কিন্তু এই উম্মতের জন্য তা রহিত করা হয়েছে-উপরোল্লিখিত আয়াত ও হাদিসের মাধ্যমে।

❑ একটি হাদিসের ব্যাখ্যা:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لا تُشركْ باللهِ شيئًا وإنْ قُطِّعتَ أو حُرِّقتَ
“আল্লাহর সাথে কোনও কিছুকে শরিক করবে না যদিও তোমাকে কেটে টুকরা টুকরা করা হয় বা
আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়” [সহীহুত তারগীব, হাসান লি গাইরিহ]

মুহাদ্দিসগণ এ হাদিসের দুটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেগুলো হল:

❂ ১. তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করা হলে বা আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হলেও আন্তরিকভাবে আল্লাহর সাথে শিরক করবে না। অর্থাৎ মন থেকে শিরককে মেনে নিবে না।

❂ ২. কেউ যদি নিহত বা ভস্মীভূত হওয়ার পরও শিরক না করে তাহলে তা উত্তম। এতে সে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবে এবং আল্লাহ তাকে আখিরাতে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। কিন্তু কারও ঈমান যদি এতটা মজবুত না হয় বা সহ্য ক্ষমতা না থাকে তাহলে তার জন্য জায়েজ আছে যে, সে বাহ্যিক ভাবে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে শিরক বা কুফরি করবে কিন্তু অন্তরের দিক দিয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান সুদৃঢ় রাখবে।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।।