প্রশ্ন: ছোট জিহাদ এবং বড় জিহাদ কী?
উত্তর: কাফের দের সাথে মুসলিমদের সংঘটিত যুদ্ধই হল, সবচেয়ে ‘বড় জিহাদ’ ( আল জিহাদুল আকবার)। যে জিহাদে একজন মুজাহিদ আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে নিজের জান-মাল সবকিছু বিসর্জন দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে তার ঘরবাড়ি, স্ত্রী-পরিবার, সন্তান-সন্ততি, প্রিয় মুখ সবকিছু ছেড়ে যুদ্ধের ময়দানে ছুটে যায়। সেখানে সে তার বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়। হয়তোবা যুদ্ধ করতে করতে সে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করবে। ফলে আর কখনোই বাড়িতে ফিরে আসবে না। কখনোই মিলিত হবে না তার স্ত্রী-পরিবার ও প্রিয়জনদের সাথে।
এই জিহাদের ডাক পাওয়ার পর তাকে প্রথমে তার মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কারণ মন কখনো নিজেকে বিপদে ফেলতে চায় না। যুদ্ধ ও রক্তপাত মানুষের কাছে অপ্রিয়। কিন্তু আল্লাহর পথের লড়াকু সৈনিক মনের সাথে লড়াই করে অবশেষে মনের সব পিছুটান, বাধা, ভয় এবং দুনিয়াবি সব আকর্ষণ কে পরাজিত করে সে আল্লাহর শত্রু দেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য, তাদেরকে সত্যের পথ দেখানোর জন্য এবং আল্লাহর দ্বীনকে হেফাজতের উদ্দেশ্যে জিহাদের ময়দানে ছুটে গেছে।
সুতরাং এর থেকে বড় জিহাদ আর কিছু হতে পারে না।
এরপরে ‘ছোট জিহাদ’ (আল জি হা দুল আসগার) হল, নিজের আত্মার সাথে সংগ্রাম করা। নিজের মনকে আল্লাহর নাফরমানি এবং পাপাচার থেকে রক্ষা করা। কষ্ট হলেও মনের বিরুদ্ধে আল্লাহর এবাদতের পথে টিকে থাকা এবং মানুষের ভ্রুকুটি ও সামাজিক তাচ্ছিল্য সবকিছুকে অম্লানবদনে সহ্য করা।
নিঃসন্দেহে কুপ্রবৃত্তি, সংশয়-সন্দেহ ও শয়তানের এর বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করা এবং অননুকূল পরিবেশে দীন পালন করাও বিরাট জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। এটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে ঘরে বসে, সমাজ-পরিবার, ব্যবসা-বাণিজ্য, দুনিয়াদারি সব ঠিক রেখে নফসের সাথে জি হা দ করা কখনো উত্তপ্ত রণাঙ্গনে আল্লাহর দুশমনদের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে জিহাদ করার সমান হতে পারে না।
🔶 “আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদ এর দিকে ফিরে এলাম” একটি ভিত্তিহীন হাদিস:
আমাদের সমাজে একটি হাদিস প্রচলিত রয়েছে যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর বললেন, “আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদ এর দিকে ফিরে এলাম।” তখন তাকে প্রশ্ন করা হল, কাফেরদের সাথে জিহাদ করার চেয়েও কি বড় জিহাদ আছে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ, “নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ।”
এ হাদিসটি মুখে মুখে ব্যাপক প্রচলিত। ওয়াজ মাহফিলে বক্তাদের মুখে শোনা যায়, বিভিন্ন ইসলামি বই বা অনলাইনে ব্যাপকভাবে প্রচারিত কিন্তু বিজ্ঞ হাদিস বিশারদগণের দৃষ্টিতে এটি সহিহ নয়।
🔹 ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ এই হাদিসটিকে “ভিত্তিহীন” বলে আখ্যায়িত করেছেন। (মাজমু ফাতাওয়া ১১/১৯৭)
وقال شيخ الإسلام ابن تيمية رحمه الله في الفتاوى ج11 ص197: (أما الحديث الذي يرويه بعضهم أنه قال في غزوة تبوك: رجعنا من الجهاد الأصغر، إلى الجهاد الأكبر فلا أصل له، ولم يروه أحد من أهل المعرفة بأقوال النبي ﷺ
🔹 যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানি রহিমাহুল্লাহ এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন,
“আমরা বড় জিহাদ থেকে ছোট জিহাদের দিকে ফিরে এলাম” এই মর্মে বর্ণিত হাদিসটি সনদের বিচারে সহিহ নয়। মর্মার্থের দিক থেকেও এটিকে সঠিক মনে করি না। কারণ নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ যদিও মুসলিমদের জন্য নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ-এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
المجاهد من جاهد هواه لله تبارك وتعالى
“মুজাহিদ তো সেই ব্যক্তি যে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে” কিন্তু মুসলিমদের নিকটে এটা অস্পষ্ট নয় যে, শক্তিশালী জিহাদ হওয়ার দিক বিবেচনায় একজন মানুষ মহান আল্লাহর পথে জিহাদ এর জন্য বের হয়ে যাওয়া আর নিজ বাড়িতে, নিজ শহরে, নিজ স্ত্রী-পরিবারের মধ্যে অবস্থান করে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করা সমান নয়-সে যত বড়ই পরহেজগার এবং নেককার ব্যক্তি হোক না কেন।
গৃহ অভ্যন্তরে থেকে জিহাদ করা আর নিজ শহর ছেড়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হওয়া কখনো সমান নয়। যেমন বলা হয় যে, “সে তার জান হাতের মুঠোয় নিয়ে বের হয়েছে।”
যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক হাদিসে উল্লিখিত নফসের বিরুদ্ধে সাধারণ জিহাদ করে তা ওই ব্যক্তির জিহাদের সমান নয় যে নিজেকে সরাসরি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। সে কারণে মনে করি,
رجعنا من الجهاد الأصغر إلى الجهاد الأكبر
“আমরা বড় জিহাদ থেকে ছোট জিহাদের দিকে ফিরে এলাম” এ হাদিসের মর্মার্থও সঠিক নয়।” [Source: Alathar dot net]
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬◢◯◣▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।