প্রশ্ন: ছোট থেকে দেখছি, গর্ভবতী নারী কোথাও গেলে মুরব্বি বা মাঝ বয়স্ক নারীরা প্রথমেই প্রশ্ন করেন যে, সাথে ম্যাচ, রসুন, লোহা, তাগা (আরও কত রকমের জিনিস) ইত্যাদি সাথে এনেছো? তারা বলে, গর্ভবতী মেয়েরা এসব জিনিস সব সময় সাথে না রাখলে বাচ্চার ক্ষতি হবে, নজর লাগবে, জীন-ভুত এর আছর পড়বে ইত্যাদি।
ইসলামের দৃষ্টিতে এসব কথা কি সঠিক? না কি তা শিরকি কথা-দয়া করে জানিয়ে বাধিত করবেন।
উত্তর:
আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে গর্ভবতী নারীদের বিষয়ে বহু কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে নারীরা এসব কুসংস্কারে বেশি নিমজ্জিত।
এগুলোর মধ্যে অন্যতম হল, গর্ভবতী নারীকে হাওয়া-বাতাস (জিনের আক্রমণ), বান-যাদু-টোনা, বদ নজর ইত্যাদি থেকে আত্মরক্ষার জন্য সাথে শুকনা মরিচ, রসুন, লোহার টুকরা, দিয়াশলাই ইত্যাদি শাড়ির আঁচলে বেঁধে রাখা। এসব জিনিস সঙ্গে না থাকলে গর্ভবতী নারী বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি, জিন-পরীর আক্রমণের শিকার হবে এবং গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হবে।
প্রকৃতপক্ষে এগুলো সুস্পষ্ট কুসংস্কার ও ভিত্তিহীন ভ্রান্ত বিশ্বাস যেগুলোর সাথে ইসলামের কোনও সম্পর্ক নাই। ইসলামের সঠিক জ্ঞানের অভাবে এ বিষয়গুলো সম্ভবত: হিন্দুদের থেকে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে।
কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, এসব জিনিস গর্ভবতী নারীকে জিন-পরীর আসর, শয়তানের অনিষ্ট, জাদু-টোনা, বদ নজর ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষা করবে তাহলে তা বড় শিরক বলে গণ্য হবে। কারণ এসব জড়পদার্থ মানুষকে ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না। বরং সকল বালা-মুসিবত, ক্ষয়-ক্ষতি এবং মাখলুকের অনিষ্ট থেকে উদ্ধারকারী একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِن يَمْسَسْكَ اللَّـهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ
“আর আল্লাহ যদি তোমার উপর কোন কষ্ট আরোপ করেন তাহলে কেউ নেই তা খণ্ডাবার মত কেই নাই তিনি ছাড়া।” (সূরা ইউনুস: ১০৭)
সুতরাং কেউ যদি এসব জড়বস্তুকে অনিষ্ট থেকে রক্ষাকারী মনে করে তাহলে সে প্রকারন্তরে এগুলোকে আল্লাহর স্থানে বসালো যা সুস্পষ্ট শিরকে আকবর বা বড় শিরক।
আর এ কথা বলা বাহুল্য যে, শিরক হল, সবচেয়ে ভয়াবহ গুনাহ যা মানুষকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়। তার জন্য জান্নাত হারাম এবং সে চিরকালের জন্য জাহান্নামি। (আল্লাহ হেফাজত করুন। আমিন)
পক্ষান্তরে যদি কেউ বিশ্বাস করে যে, এসব জিনিস বিভিন্ন অনিষ্ট ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার ওসিলা (মাধ্যম) মাত্র তাহলে তা শিরক না হলেও ভ্রান্ত ও হারাম বিশ্বাস-তাতে কোনও সন্দেহ নাই। (এটাই অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস)।
❑ জাদু-টোনা, জিন-শয়তান, বদনজর ইত্যাদি অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার ইসলামি পদ্ধতি:
ইসলামের শিক্ষা হল, জিনের সংক্রমণ, শয়তানের অনিষ্ট, বান ও জাদু-টোনা, বদ নজর ইত্যাদি থেকে আত্মরক্ষার জন্য সকাল-সন্ধ্যায়, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে এবং ঘুমের পূর্বে হাদিসে বর্ণিত বিভিন্ন দুআ ও জিকিরের আমল করা। যেমন:
✪ ১. সকাল-সন্ধ্যায় সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস তিন বার করে এবং আয়াতুল কুরসি একবার করে পাঠ করা।
✪ ২. পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পর উক্ত তিনটি সূরা পড়ার পাশাপাশি আয়াতুল কুরসি একবার পাঠ করা।
✪ ৩. ঘুমের পূর্বে দু হাত একত্রিত করে তাতে ফুঁ দিয়ে তিন কুল পাঠ করে মাথা, মুখমণ্ডল ও শরীরের উপরিভাগে যতদূর সম্ভব মাসেহ করা ( এভাবে তিনবার করা)। তৎসঙ্গে আয়াতুল কুরসি একবার পাঠ করা।
✪ ৪. কোথাও গেলে সেখানে নিম্নোক্ত দুআটি পাঠ করা:
أَعُوذُ بِكلِمَاتِ الله التّامّاتِ مِن شَرّ مَا خَلَقَ
উচ্চারণ: আউযুবি কালিমাতিল্লা-হিত তা-ম্মাতি মিন শাররি-মা-খলাক।
অর্থ: “আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমা (বাণী/বাক্য) সমূহের ওসিলায় তাঁর নিকট আমি তিনি যা সৃষ্টি করেছেন সেগুলোর অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই।”
➧ খাওলাহ বিনতে হাকিম রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْ نَزَلَ مَنْزِلاً فقَالَ أَعُوذُ بِكلِمَاتِ الله التّامّاتِ مِن شَرّ مَا خَلَقَ لَمْ يَضُرّهُ شيءٌ حَتّى يَرْحَلَ مِنْ مَنْزِلِهِ ذَلِكَ . رواه مسلم
“যে ব্যক্তি কোনও স্থানে পৌঁছে পাঠ করে:
أَعُوذُ بِكلِمَاتِ الله التّامّاتِ مِن شَرّ مَا خَلَقَ
কোনও কিছুই তার ক্ষতি সাধন করতে পারবে না যতক্ষণ না সে ওই স্থান থেকে (অন্য কোথাও) চলে যায়।” [সহিহ মুসলিম]
➧ অন্য হাদিসে এসেছে,
مَنْ قَالَ اذا أمْسي ثَلَاثَ مَرَّاتٍ : أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ ، لَمْ تضُرَّهُ حُمَةٌ تِلْكَ اللَّيْلَةَ .
“যে ব্যক্তি সন্ধ্যা কালে তিন বার উক্ত দুআটি পাঠ করবে (কোনও বিষধর প্রাণীর দংশন/বিষ) তার ক্ষতি সাধন করতে পারবে না”। [মুসনাদে আহমদ- ২/২৯০-সহিহ]
➧ ৫. বাহির থেকে বাড়িতে প্রবেশের সময় সালাম প্রদান ও ঘরে প্রবেশের দুআ পাঠ করা, টয়লেটে প্রবেশের দুআ পাঠ করা, খাবারের সময় বিসমিল্লাহ পাঠ করা, স্ত্রী সহবাসের দুআ পাঠ করা এবং ঘরে সূরা বাকারা পাঠ করা। এসব আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা ঘরকে জিন-শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন ইনশাআল্লাহ।
মোটকথা, গর্ভবতী নারী সহ সকলকেই এসব অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি কর্তৃক শেখানো দুআ ও জিকিরগুলো পাঠ করতে হবে এবং নিয়মিত আমল করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, ইসলামের শেখানো এই সুন্দর ও বরকতময় দিক নির্দেশনাগুলো অজ্ঞ মুসলিমদের থেকে বিদায় নিয়ে সেখানে নানা ভ্রান্ত বিশ্বাস ও কুসংস্কার স্থান দখল করে আছে। (লা হওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ!)
❑ কুসংস্কারের অন্ধকারে আলোর মশাল জ্বালাতে কী করণীয়?
এসব অজ্ঞতা, ভ্রান্ত বিশ্বাস ও কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে বের হতে হলে অবশ্যই সমাজে সঠিক ইসলামি শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে এবং মানুষকে সচেতন করতে হবে। তাওহিদ ও বিশুদ্ধ আকিদা বিষয়ক জ্ঞানের বিস্তার ঘটাতে হবে, শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার সংক্রান্ত আলোচনা ও দাওয়াতি কার্যক্রম ব্যাপক আকারে বিস্তৃত করতে হবে।
বিশেষ করে নারী শিক্ষা এবং নারীদের মাঝে দাওয়াতি কার্যক্রমের প্রয়োজনীয় আরও বেশি। কারণ প্রতিটি মা তাদের শিশুদের প্রথম শিক্ষক। মাতৃক্রোড়ই শিশুদের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সুতরাং মায়েরা যদি কু সংস্কারমুক্ত ও ইসলামের প্রকৃত জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয় তাহলে আমাদের সমাজ উদ্ভাসিত হবে। গড়ে উঠবে কুসংস্কার, মূর্খতা ও ভ্রান্ত অন্ধ বিশ্বাস মুক্ত আলোকিত সুন্দর সমাজ ইনশাআল্লাহ।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরণের বিদআতি ও ভ্রান্ত চিন্তাভাবনা, কুসংস্কার, অজ্ঞতা এবং ইসলামবিরোধী আকিদা-বিশ্বাস থেকে হেফাজত করুন । আমীন
▬▬▬▬◈◯◈▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দু্ল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল৷
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।