প্রশ্ন: ওযুর দু রাকআত সালাতের ফযিলত কি? এ সংক্রান্ত বিধিবিধানগুলো জানতে চাই।
আর অনেকের মুখে শুনেছি যে, ‘ওযুর দু রাকআত সালাত না পড়লে নাকি ফরয ও সুন্নত সালাত পূর্ণাঙ্গতা পায় না।’ এই কথাটার সত্যতা কতটুকু?
উত্তর:
নিন্মে এ সকল প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা হল: وبالله التوفيق
♦ ওযুর পরে দু রাকআত সালাত আদায় করা অত্যন্ত ফযিলত পূর্ণ আমল:
ওযুর পর দু রাকআত নফল সালাত আদায় কতটা ফযিলত পূর্ণ আমল তা বুঝা যায় নিন্মোক্ত হাদিসগুলো থেকে:
◈◆ ওযুর পরে নিবিষ্ট চিত্তে দু রাকআত নফল সালাত আদায় করলে পূর্বের সকল গুনাহ মোচন করে দেয়া হয়:
উসমান ইবনে আফফান রা. থেকে বর্ণিত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
مَنْ تَوَضَّأَ نَحْوَ وُضُوئِي هَذَا ثُمَّ قَامَ فَرَكَعَ رَكْعَتَيْنِ لاَ يُحَدِّثُ فِيهِمَا نَفْسَهُ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
“যে ব্যক্তি আমার এ ওযুর ন্যায় ওযু করবে এবং একান্ত মনোযোগের সাথে দু’ রাকআত সালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তির অতীতের সকল (সগিরা বা ছোট) গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”
(সহিহ বুখারী হা/১৬০, সহীহ মুসলিম, হা/৪২৬, অধ্যায়: তাহারাহ (পবিত্রতা) (كتاب الطهارة), পরিচ্ছদ: ওযু করার নিয়ম ও ওযুর পূর্ণতা।)
ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন: فيه استحباب صلاة ركعتين عقب الوضوء
“এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, ওযুর পরে দু রাকআত সালাত পড়া মুস্তাহাব (উত্তম)।”
◈◆ ওযুর করার পর দেহমন পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর প্রতি সমর্পণ করে দু রাকআত সালাত আদায় জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম মাধ্যম:
উকবা ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমার ওপর উট চরানোর দায়িত্ব ছিল। আমার পালা এলে আমি উট চরিয়ে বিকেলে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম। তারপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে পেলাম, তিনি দাঁড়িয়ে লোকদের সঙ্গে কথা বলছেন। তখন আমি তাঁর এ কথাটি শুনতে পেলাম:
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَتَوَضَّأُ فَيُحْسِنُ وُضُوءَهُ ثُمَّ يَقُومُ فَيُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ مُقْبِلٌ عَلَيْهِمَا بِقَلْبِهِ وَوَجْهِهِ إِلاَّ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ
“যে মুসলিম সুন্দরভাবে ওযু করে তারপর দাঁড়িয়ে দেহমনকে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ নিবদ্ধ রেখে দু রাকআত সালাত আদায় করে তার জন্য জান্নাত অবধারিত (ওয়াজিব) হয়ে যায়।”
উকবা রা. বলেন, কথাটি শুনে আমি বলে উঠলাম: বাহ! হাদিসটি কত চমৎকার!
তখন আমার সামনের একজন বলতে লাগলেন: আগের কথাটি আরও উত্তম। আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি উমর রা.।
তিনি আমাকে বললেন: তোমাকে দেখেছি, এ মাত্র এসেছ। রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগে বলেছেন:
مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ يَتَوَضَّأُ فَيُبْلِغُ – أَوْ فَيُسْبِغُ – الْوُضُوءَ ثُمَّ يَقُولُ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ إِلاَّ فُتِحَتْ لَهُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ الثَّمَانِيَةُ يَدْخُلُ مِنْ أَيِّهَا شَاءَ ,
“তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে ওযু করে এ দুআ পড়বে:
أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ
উচ্চারণ: আশহাদু আল্লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান ‘আবদুহূ ওয়া রসূলুহু”
অর্থ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনও উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রসূল”। তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেয়া হবে। সে যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৪৪১)
➤ উল্লেখ্য যে, উক্ত দুআটি সহিহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় একটু ভিন্ন শব্দে বর্ণিত হয়েছে। তা হল:
أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ.
উচ্চারণঃ আশহাদু আল্-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্’দাহু লা শারিকা-লাহু ওয়াআশহাদু আন্না মুহা’ম্মাদান আ’বদুহু ওয়া রাসুলুহু।
অর্থঃ “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া সত্য কোন মাবূদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।”
(মুসলিম ১/২০৯, মিশকাতঃ ২৮৯।)
◈◆ কেউ যদি ওযুর পর নিয়মিতভাবে কমপক্ষে দু রাকআত নফল সালাত আদায় করে তাহলে সে জান্নাতবাসী হবে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لِبِلَالٍ عِنْدَ صَلَاةِ الْغَدَاةِ «يَا بِلَالُ حَدِّثْنِي بِأَرْجَى عَمَلٍ عَمِلْتَهُ فِي الْإِسْلَامِ منفعة فاني فَإِنِّي سَمِعْتُ اللليلة خشف نَعْلَيْكَ بَيْنَ يَدَيَّ فِي الْجَنَّةِ » قَالَ بلال مَا عَمِلْتُ عَمَلًا أَرْجَى عِنْدِي منفعة من أَنِّي لَمْ أَتَطَهَّرْ طَهُورًا تَامًّا فِي سَاعَةِ مِنْ لَيْلٍ أَوْ نَهَارٍ إِلَّا صَلَّيْتُ بِذَلِكَ الطُّهُورِ مَا كُتِبَ لِي أَنْ أُصَلِّيَ
“আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন ফজরের নামাযের পর বেলাল রা. কে জিজ্ঞেস করলেন, হে বেলাল, ইসলাম গ্রহণের পর তুমি যত আমল করেছো তার মধ্যে তোমার কাছে সবচেয়ে আশা বঞ্চক আমল কোনটি? কেননা আজ রাতে (মিরাজের রাতে) আমি জান্নাতে আমার সামনে তোমার জুতার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি।
বেলাল রা. বললেন: আমি এর চেয়ে অধিক কোন আমল তো দেখছি না যে, দিনে বা রাতে যখনই আমি ওযু করি তখনই যতটুকু আল্লাহ তাওফিক দেন ততটুকু নফল সালাত আমি আদায় করি। (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
♦ কতিপয় মাসায়েল:
💠 ১. দিন-রাতের যে কোনও সময় ওযুর পর দু রাকআত নফল সালাত পড়া জায়েজ; এমনকি নিষিদ্ধ সময়ের মধ্যে হলেও:
দিন-রাতের যে কোনও সময় ওযুর পর দু রাকআত নফল সালাত পড়া জায়েজ আছে-এমনকি নিষিদ্ধ সময়ের মধ্যে হলেও। কারণ উপরোক্ত বেলাল রা. বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে: “দিনে বা রাতে যখনই আমি ওযু করি তখনই যতটুকু আল্লাহ তাওফিক দেন ততটুকু নফল সালাত আমি আদায় করি।” সুতরাং এখান থেকে বুঝা যায়, দিন-রাতের যখন ইচ্ছা তখনই এই নামায পড়া যাবে-যদিও তা নিষিদ্ধ সময়ের মধ্যে হয়।
এ ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন:
” وَيُسْتَحَبُّ أَنْ يُصَلِّيَ رَكْعَتَيْنِ عَقِبَ الْوُضُوءِ وَلَوْ كَانَ وَقْتَ النَّهْيِ ، وَقَالَهُ الشَّافِعِيَّةُ ” انتهى ))الفتاوى الكبرى 5 / 345((
“ওযুর পরে দু রাকআত সালাত আদায় করা মুস্তাহাব যদিও তা নিষিদ্ধ সময়ের মধ্যে হয়। শাফেয়ীরাও এ কথা বলেছেন।” (ফাতাওয়া কুবরা ৫/৩৪৫)
💠 ২. ওযুর দু রাকআত নফরের সাথে তাহিয়াতুল মসজিদের দু রাকআত এবং যোহরের পূর্বের দু রাকআত একসাথে নিয়ত করে পড়লে সবগুলোর জন্যই যথেষ্ট হবে:
এ ব্যাপারে সৌদি আরবের বড় আলেমদের স্থায়ী ফতোয়া কমিটির ফতোয়া নিন্মরূপ:
” إذا توضأ المسلم ودخل المسجد بعد أذان الظهر وصلى ركعتين ناويا بهما تحية المسجد وسنة الوضوء وسنة الظهر أجزأه ذلك عن الثلاث ؛ لقول النبي صلى الله عليه وسلم : (إنما الأعمال بالنيات ، وإنما لكل امرئ ما نوى) إلا أنه يسن له أن يصلي ركعتين أخريين إتماماً لسنة الظهر الراتبة القبلية ؛ لأن النبي صلى الله عليه وسلم كان يحافظ على صلاة أربع ركعات قبل الظهر ” انتهى .
“فتاوى اللجنة الدائمة” (7 / 248-24
“কোন মুসলিম যদি যোহরের আযানের পরে ওযু করে মসজিদে প্রবেশ করে অত:পর তাহিয়াতুল মসজিদ, ওযুর সুন্নত ও যোহরের সুন্নত একসাথে নিয়ত করে দু রাকআত সালাত আদায় করে তাহলে তা সবগুলোর জন্য যথেষ্ট হবে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “সমস্ত আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। মানুষ তাই পায় যা সে নিয়ত করে।” তবে এর পরে আরও দু রাকআত সালাত পড়া সুন্নত যেন, যোহরের পূর্বের চার রাকআত পূর্ণ হয়। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যোহরের পূর্বে চার রাকআত সুন্নত নামাযের প্রতি যত্নশীল ছিলেন।” (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়েমাহ ৭/২৪ ও ২৪৮)
💠 ৩. ওযুর দু রাকআত নফল সালাত কি ওযু করার সাথেই পড়তে হবে না কি বিলম্ব পড়লেও চলবে?
উত্তর: উপরোক্ত হাদিস সমূহ থেকে বুঝা যায়, ওযু করার পর সাথে সাথেই উক্ত দু রাকআত সালাত আদায় করতে হবে। দীর্ঘ সময় বিলম্ব হলে তার সময় শেষ বলে গণ্য হবে।
💠 ৪. ওযুর দু রাকআত সালাত না পড়লে ফরয ও সুন্নত সালাত পরিপূর্ণ হয় না’-এ কথা কি ঠিক?
না, এ কথা ঠিক নয়। কারণ ওযুর পরে দু রাকআত সালাত নফল। আর নফল, সুন্নত, ফরয প্রতিটি স্বতন্ত্র। একটি পূর্ণতার উপর আরেকটি নির্ভরশীল নয়। যে ব্যক্তি ওযুর দু রাকআত সালাত পড়বে সে সওয়াব পাবে; যে পড়বে না সে সওয়াব পাবে না। এর সাথে অন্য নামাযের কোনো সম্পর্ক নাই। আল্লাহু আলাম।।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই মৃতপ্রায় সুন্নতটিকে পুনর্জীবিত করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
▬▬▬◄❖►▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
জুবাইল, সৌদি আরব