প্রশ্ন: যে শিশু বালেগ হওয়ার আগে থেকে রমজানের রোজা পালন করত। রমজান মাসের দিনের বেলায় সে বালেগ হল। তাকে কি সেই দিনের রোজা কাযা করতে হবে? একইভাবে রমজান মাসে দিনের বেলা যে কাফের ইসলাম গ্রহণ করল, যে নারী হায়েয থেকে পবিত্র হল, যে পাগল জ্ঞান ফিরে পেল, যে মুসাফির রোজা না-রাখা অবস্থায় স্বগৃহে ফিরে আসল, যে অসুস্থ ব্যক্তি রোজা ছিল না, কিন্তু সে সুস্থ হয়ে উঠল – এ সমস্ত ব্যক্তির জন্য সেই দিনের বাকি অংশ রোজাভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকা ও সেদিনের রোজার কাযা আদায় করা কি ওয়াজিব?
উত্তর:
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
প্রশ্নে উল্লেখিত ব্যক্তিদের সবার ক্ষেত্রে একই হুকুম প্রযোজ্য নয়। এ ব্যাপারে আমরা আলেমগণের মতভেদ ও তাদের বক্তব্য (49008) নং প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করেছি।
প্রশ্নে উল্লেখিত ব্যক্তিদের দুটি গ্রুপে ভাগ করা যেতে পারে :
১) কোন শিশু যদি বালেগ হয়, কোন কাফির যদি ইসলাম গ্রহণ করে, কোন পাগল যদি জ্ঞান ফিরে পায়- তবে তাদের সবার হুকুম এক। সেট হল- ওজর বা অজুহাত চলে যাওয়ার সাথে সাথে দিনের বাকি অংশে রোজা ভঙ্গকারী সমস্ত মুফাত্তিরাত হতে বিরত থাকা ওয়াজিব। কিন্তু তাদের জন্য সেই দিনের রোজা কাযা করা ওয়াজিব নয়।
২) অপরদিকে হায়েযগ্রস্ত নারী যদি পবিত্র হয়, মুসাফির ব্যক্তি যদি স্বগৃহে ফিরে আসে, অসুস্থ ব্যক্তি যদি আরোগ্য লাভ করে- এদের সবার হুকুম এক। এদের জন্য রোজা ভঙ্গকারী মুফাত্তিরাত হতে বিরত থাকা ওয়াজিব নয়। কারণ বিরত থাকাতে তাদের কোন লাভ নেই। যেহেতু সেই দিনের রোজা কাযা করা তাদের উপর ওয়াজিব।
প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রুপের মধ্যে পার্থক্য:
প্রথম গ্রুপের মধ্যে তাকলিফের তথা শরয়ি ভার আরোপের সকল শর্ত পাওয়া গেছে। শর্তগুলো হচ্ছে- বালেগ হওয়া, মুসলিম হওয়া ও আকল (বুদ্ধি) সম্পন্ন হওয়া। যখন থেকে তাদের উপর শরয়ি ভার আরোপ সাব্যস্ত হয়েছে তখন থেকে মুফাত্তিরাত তথা রোজা ভঙ্গকারী বিষয় হতে বিরত থাকা তাদের উপর ওয়াজিব; কিন্তু সেই দিনের রোজা কাযা আদায় করা তাদের উপর ওয়াজিব নয়। কারণ যখন থেকে তাদের উপর মুফাত্তিরাত (রোজা ভঙ্গকারী বিষয়) হতে বিরত থাকা ওয়াজিব হয়েছে তখন থেকে তারা তা থেকে বিরত থেকেছে। এর আগে তো তারা রোজা পালনের ব্যাপারে মুকাল্লাফ (ভারপ্রাপ্ত) ছিল না।
পক্ষান্তরে, দ্বিতীয় গ্রুপটি সিয়াম পালনের ব্যাপারে আইনতঃ মুকাল্লাফ ছিল। তাই তা পালন করা তাদের উপর ওয়াজিব ছিল। তবে তাদের শরিয়ত অনুমোদিত ওজর থাকায় তাদেরকে রোজা না-রাখার বৈধতা দেয়া হয়েছে। এ ধরনের ওজর হচ্ছে- হায়েয, সফর ও রোগ। এসব ওজরের কারণে আল্লাহ্ রোজার বিধান তাদের জন্য কিছুটা সহজ করেছেন এবং রোজা না-থাকা তাদের জন্য বৈধ করেছেন। উল্লেখিত ওজরগ্রস্ত ব্যক্তি রমজানের দিনের বেলায় বে-রোজদার থাকাতে এ মাসের পবিত্রতা বিনষ্টকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে না। যদি রমজানের দিনের বেলায় তাদের ওজর দূর হয়ে যায় তবুও দিনের বাকী সময়টা রোজা ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকাতে তাদের কোন লাভ নেই্। কারণ রমজান মাসের পরে তাদেরকে সেই দিনের রোযা কাযা করতে হবে।
শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন:
“যদি কোন মুসাফির রোজা না-রাখা অবস্থায় স্বগৃহে ফিরে আসে তবে তার জন্য রোজা ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব নয়; দিনের বাকী সময়ে পানাহার করা তার জন্য বৈধ। যেহেতু তাকে এই দিনের রোজা কাযা করতে হবে। তাই এই দিনের অবশিষ্টাংশে পানাহার থেকে বিরত থেকে কোন লাভ নেই। এটাই সঠিক মত। এটি ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ীর অভিমত এবং ইমাম আহমাদ থেকে দুইটি বর্ণনার একটি। তবে সে ব্যক্তির প্রকাশ্যে পানাহার করা উচিৎ নয়।” সমাপ্ত [মাজমূ ফাতাওয়াশ শাইখ ইবনে উছাইমীন (১৯/৫৮ নং প্রশ্ন)]
তিনি আরও বলেন:
“কোন হায়েযগ্রস্ত নারী অথবা নিফাসগ্রস্ত নারী দিনের বেলায় পবিত্র হলে তাদের জন্য রোজা ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব নয়। তিনি পানাহার করতে পারেন। কারণ তার বিরত থাকায় কোন লাভ নেই। যেহেতু সেই দিনের রোজা তাকে কাযা করতে হবে। এটি ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ীর অভিমত ও ইমাম আহমাদ থেকে বর্ণিত দুইটি অভিমতের একটি।
ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন:
( من أكل أول النهار فليأكل آخره)
“দিনের প্রথম অংশে যে ব্যক্তি খেয়েছে দিনের শেষভাগেও সে খেতে পারে।”অর্থাৎ যার জন্য দিনের প্রথম অংশে রোজা ভঙ্গ করা জায়েয তাঁর জন্য দিনের শেষ অংশেও রোজা ভঙ্গ করা বৈধ।“ সমাপ্ত [মাজমূ ফাতাওয়াশ শাইখ ইবনে উছাইমীন (১৯/৫৯) নং প্রশ্ন)]
শাইখ উছাইমীনকে আরও প্রশ্ন করা হয়েছিল:
যে ব্যক্তি রমজান মাসের দিনের বেলায় শরিয়ত অনুমোদিত ওজরের কারণে রোজা ভেঙ্গেছে ওজর দূর হয়ে যাওয়ার পর সে দিনের বাকি সময়ে পানাহার করা কি তার জন্য জায়েয হবে?
তিনি উত্তরে বলেন:
“তার জন্য পানাহার করা জায়েয। কারণ সে শরিয়ত অনুমোদিত ওজরের কারণে রোজা ভঙ্গ করেছে। শরিয়ত অনুমোদিত ওজরের কারণে রোজা ভঙ্গ করায় তার ক্ষেত্রে রমজানের দিবসের পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্ব থাকে না। তাই সে পানাহার করতে পারে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি রমজান মাসের দিনের বেলায় কোন শরয়ি ওজর ছাড়া রোজা ভঙ্গ করেছে তার অবস্থা ভিন্ন। তার ক্ষেত্রে আমরা বলব: দিনের বাকি অংশে রোজা ভঙ্গকারী বিষয় থেকে বিরত থাকা তার জন্য ওয়াজিব। যদিও এ রোজার কাযা পালন করাও তার উপর ওয়াজিব। এই মাসয়ালা দুইটির পার্থক্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।” সমাপ্ত। [মাজমূ ফাতাওয়া আশ-শাইখ ইবনে উছাইমীন (১৯/৬০) নং প্রশ্ন)]
তিনি আরও বলেন:
“সিয়াম বিষয়ক গবেষণাপত্রে আমরা উল্লেখ করেছি যে, কোন নারীর যদি হায়েয হয় এবং (রমজান মাসে) দিনের বেলায় তিনি পবিত্র হন তবে সেই দিনের বাকী অংশে তাকে পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে কি- এ ব্যাপারে আলেমগণ মতভেদ করেছেন।
আমরা বলব: এ মাসয়ালায় ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ থেকে দুটি অভিমত বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আহমাদ থেকে সর্বজনবিদিত মত হল- দিনের বাকি অংশে রোজা ভঙ্গকারী সমস্ত মুফাত্তিরাত থেকে বিরত থাকা সে নারীর উপর ওয়াজিব। সুতরাং সে পানাহার করবে না।
দ্বিতীয় মত হচ্ছে- তার জন্য মুফাত্তিরাত থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব নয়। তাই পানাহার করা তার জন্য জায়েয। আমরা বলব: এই দ্বিতীয় মতটি ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেয়ি (রাঃ) এরও অভিমত। এটি ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও বর্ণিত। তিনি বলেন:
( من أكل أول النهار فليأكل آخره)
“যে ব্যক্তির জন্য দিনের প্রথম অংশে খাওয়া বৈধ তার জন্য দিনের শেষ অংশেও খাওয়া বৈধ।”
আমরা আরও বলব ভিন্ন মত আছে এমন মাসয়ালার ক্ষেত্রে তালিবে ইলমের কর্তব্য হল দলিলগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করা এবং তার কাছে যে মতটি অগ্রগণ্য প্রতীয়মান হয় সে মতটি গ্রহণ করা। আর দলিল যেহেতু তার পক্ষে রয়েছে সেহেতু ভিন্ন মতাবলম্বীর ভিন্নমতের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা। কারণ আমরা রাসূলকে অনুসরণ করার ব্যাপারে আদিষ্ট। এ বিষয়ে আল্লাহ্ বলেন:
( وَيَوْمَ يُنَـادِيهِمْ فَيَقُولُ مَاذَا أَجَبْتُمُ ٱلْمُرْسَلِينَ )
“যে দিন তাদেরকে ডেকে বলবেন: তোমরা রাসূলগণকে কি জওয়াব দিয়েছিলে?” [২৮ সূরা আল-ক্বাস্বাস্ব : ৬৫]
ভিন্ন মতাবলম্বীগণ একটা সহিহ হাদিস দিয়ে দলিল দেয়। সেটা হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিনের মধ্যভাগে ‘আশুরা’-র রোজা পালনের আদেশ দিয়েছিলেন। তখন সাহাবীরা দিনের বাকি অংশ রোজা-ভঙ্গকারী বিষয় থেকে বিরত থেকেছেন। আমরা বলব, এই হাদিসে তাদের পক্ষে কোন দলিল নেই। কারণ ‘আশুরা’-র রোজা পালনের ক্ষেত্রে ‘প্রতিবন্ধকতা দূর হওয়া’ (হায়েয, নিফাস, কুফর ইত্যাদি)-র কোন ব্যাপার ছিল না। বরং সেক্ষেত্রে ‘নতুন ওয়াজিব দায়িত্ব বর্তানোর’ ব্যাপার ছিল।
‘প্রতিবন্ধকতা দূর হওয়া’ ও ‘নতুন ওয়াজিব দায়িত্ব বর্তানোর’ মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ‘নতুন ওয়াজিব দায়িত্ব বর্তানোর’ অর্থ হল- যে কারণে কোন বিধান আবশ্যকীয় হয় সে কারণ উপস্থিত হওয়ার আগে সেই হুকুমটি সাব্যস্ত হয় না। পক্ষান্তরে ‘প্রতিবন্ধকতা দূর হওয়ার’ অর্থ হল- বিধান সাব্যস্ত আছে; কিন্তু প্রতিবন্ধকতা থাকায় সেটা বাস্তবায়ন করা যায় না। বিধান ওয়াজিব হওয়ার কারণ পাওয়া গেলেও এই প্রতিবন্ধকতার উপস্থিতিতে বিধানটি পালন করা শুদ্ধ হবে না।
এই মাসয়ালার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অন্য একটি মাসয়ালা হলো- যে ব্যক্তি রমজান মাসে দিনের বেলায় ইসলাম গ্রহণ করল তাঁর ক্ষেত্রে রোজার দায়িত্ব তার উপর নতুনভাবে বর্তাল।
এ রকম আরো একটি উদাহরণ হল- কোন নাবালেগ যদি রমজান মাসে দিনের বেলায় সাবালক হয় এবং সে বে-রোজদার থাকে তবে তার ক্ষেত্রেও রোজার দায়িত্বটি নতুনভাবে বর্তায়।
তাই যে ব্যক্তি দিনের বেলায় ইসলাম গ্রহণ করেছে আমরা তাঁকে বলব: দিনের বাকি অংশে রোজা ভঙ্গকারী বিষয়বস্তু থেকে বিরত থাকা আপনার উপর ওয়াজিব। তবে এ রোজাটি আর কাযা করা আপনার উপর ওয়াজিব নয়।
অনুরূপভাবে রমজান মাসের দিনের বেলায় যে নাবালেগ বালেগ হয়েছে আমরা তাকে বলল: দিনের বাকী অংশে রোজা ভঙ্গকারী বিষয়বস্তু থেকে বিরত থাকা তোমরা উপর ওয়াজিব। তবে এ রোজাটি কাযা করা তোমার উপর ওয়াজিব নয়।
কিন্তু রমজানের দিনের বেলায় যে ঋতুবতী নারী পবিত্র হয়েছে তার ক্ষেত্রে বিধানটি ভিন্ন। আলেমগণের ইজমা তথা সর্বসম্মত মত হচ্ছে- তার উপর রোজাটি কাযা করা ওয়াজিব। ঋতুবতী নারী যদি রমজানের দিনের বেলায় পবিত্র হয় তাহলে দিনের বাকী অংশ রোজা ভঙ্গকারী বিষয়াদি থেকে বিরত থাকায় তার কোনো উপকারে হবে না, এই বিরত থাকাটা রোজা হিসেবে গণ্য হবে না। বরং তাকে রোজাটি কাযা করতে হবে। এ ব্যাপারে আলেমগণ ইজমা করেছেন।
এই আলোচনার মাধ্যমে ‘নতুন করে ওয়াজিব দায়িত্ব বর্তানো’ ও ‘প্রতিবন্ধকতা দূর হওয়া’ এর মধ্যে পার্থক্য জানা গেল। সুতরাং হায়েযগ্রস্ত নারী রমজানের দিনের বেলায় পবিত্র হওয়ার মাসয়ালাটি ‘প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত হওয়া’ শ্রেণীর মাসয়ালা। পক্ষান্তরে কোন শিশুর বালেগ হওয়া অথবা প্রশ্নকারীর উল্লেখিত রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে ‘আশুরা’ দিনের রোজা ফরজ হওয়া- এর মাসয়ালাটি ‘নতুন করে ওয়াজিব দায়িত্ব বর্তানো’ শীর্ষক মাসয়ালা। আল্লাহই তাওফিক দাতা। ” সমাপ্ত।
[মাজমূ ফাত্ওয়া আশ-শাইখ ইবনে উছাইমীন (১৯/৬০ নং প্রশ্ন)]