ইসলামের দৃষ্টিতে কবিতা চর্চার বিধান ও শর্তাবলী

প্রশ্ন: ইসলামের দৃষ্টিতে কবিতা চর্চার বিধান কী?
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: নিম্নে ইসলামের দৃষ্টিতে কবিতা চর্চার বিধান, প্রশংসনীয় কবিতা ও নিন্দনীয় কবিতা এবং কবিতা চর্চা বৈধ হওয়ার শর্তাবলী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল: وبالله التوفيق

মহাগ্রন্থ কুরআনে শুয়ারা (الشعراء) নামক একটি সূরা আছে। এর অর্থ: কবিগণ। এ সূরার ২২৭ ও ২২৮ নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহ কবিদের সম্পর্কে বলেন,
وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ ‎-‏ أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ ‎- إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَذَكَرُوا اللَّهَ كَثِيرًا وَانتَصَرُوا مِن بَعْدِ مَا ظُلِمُوا
“বিভ্রান্ত লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে। তুমি কি দেখ না যে, তারা (কবিরা) প্রতি উপত্যকায় উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে, যা তারা করে না? তবে তাদের কথা ভিন্ন, যারা ইমান আনে, সৎকর্ম করে এবং আল্লাহ কে খুব স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে।” [সূরা শুয়ারা: ২২৭ ও ২২৮]

– ইবনে আব্বাস রা. এর ব্যাখ্যায় বলেন,
أكثر قولهم يكذبون فيه
“কবিরা তাদের অধিকাংশ কথাবার্তায় মিথ্যা বলে।” [তাফসিরে ইবনে কাসির]

– আল্লামা আব্দুর রাহমান বিন সাদি রহ. এই আয়াতের তাফসিরে বলেন,

أَلَمْ تَرَ ) غوايتهم وشدة ضلالهم ( أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ ) من أودية الشعر، ( يَهِيمُونَ ) فتارة في مدح, وتارة في قدح, وتارة في صدق، وتارة في كذب، وتارة يتغزلون, وأخرى يسخرون, ومرة يمرحون, وآونة يحزنون, فلا يستقر لهم قرار, ولا يثبتون على حال من الأحوال.

“(পথভ্রষ্ট ও সত্য চ্যুত কবিরা) কবিতার সব উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়। কখনো প্রশংসা, কখনো কুৎসা, কখনো সত্য, কখনো মিথ্যা, কখনো প্রেম-প্রণয়, কখনো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, একবার আনন্দ-বিনোদন তো আরেকবার দুঃখ গাঁথা (এভাবে তারা সব উপত্যকায় উদভ্রান্তের মত উদ্দেশ্যহীণভাবে বিচরণ করে।) মোটকথা, তারা কোন একটি সিদ্ধান্তের উপর অবিচল থাকে না বা এক অবস্থার উপর উপর স্থির থাকে না।” [তাফসিরে বিন সাদি]

❑ কবিতা চর্চার কতিপয় শর্তবলী:

কবিদের কাব্যচর্চার এ ভাবের জগত থেকে এবং কল্পনা প্রবণতা থেকে দূরে রাখা আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য নয়। তবে তারা যেন এ ভাবের জগতে বিচরণ করতে গিয়ে অসত্য, ভ্রান্ত ও বিপথগামিতার পথে না হাঁটে সে জন্য আল্লাহ তাআলা কবিতা রচনার জন্য উপরোক্ত আয়াতে কয়েকটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। যেমন:
◆ ১. কবিকে ইমানদার হতে হবে।
◆ ২. ঈমান আনার সঙ্গে সঙ্গে সৎকর্ম শীল হতে হবে। সে অন্যায় ও অসৎ কর্ম বর্জন করে সত্য ও সুন্দরের অনুসারী হবে।
◆ ৩. ভাব ও কল্পনা প্রবণতা এবং আবেগী বিচরণ যাতে তাকে সৎ পথ থেকে বিচ্যুত করতে না পারে সে জন্য আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করবে।
◆ ৪. আর যখনই মানবতা বিপন্ন হবে, নিপীড়িত, নির্যাতিত হবে তখনি কবি তার সর্ব শক্তি নিয়োগ করে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করবে। সত্য পন্থী কবিদের অন্যতম দায়িত্ব হল, সত্য, ন্যায় ও সভ্যতার স্বপক্ষে প্রতিবাদ বাণী উচ্চারণ করা।

❑ উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইসলামি শরিয়তে কাব্যচর্চার বিধান প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তাফসিরে ফাতহুল মাজিদে বলা হয়েছে:

পূর্বের আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেল কবিতা ও কবি দু প্রকার। যথা:

✪ ১. যারা অশ্লীল-বেহায়া, অসত্য ও কাল্পনিক-অবাস্তব কথা বলে, মানুষের প্রশংসা ও নিন্দা করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে কবিতা রচনা করে এবং আল্লাহ তাআলার স্মরণ, কুরআন ও জ্ঞানচর্চার ওপর প্রবল হয়ে যায় ও শরিয়ত বিরোধী বিষয়বস্তু সম্বলিত হয় তাহলে সে সব কবি ও কবিতা নিন্দনীয়, এরূপ কবি ও কবিতাকে আল্লাহ তাআলা নিন্দা করেছেন যেমন: সূরা শুয়ারা-এর ২২৭ ও ২২৮ নাম্বার আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। হাদিসে এসেছে,
আবু সাঈদ খুদরি রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে আরজ অঞ্চলে ভ্রমণ করছিলাম। সে সময় এক কবি কবিতা আবৃতি করতে করতে আসতে লাগল। তখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, শয়তানটাকে ধরো। অথবা (বর্ণনায় সংশয়, তিনি বললেন) শয়তানটাকে বাধা দাও। তারপর বললেন,
لأنْ يَمْتلِئَ جَوْفُ أحَدِكم قَيْحًا حتَّى يَرِيَه خيْرٌ له مِن أن يَمْتلِئَ شِعْرًا
“তোমাদের কারো পেট পুঁজ দ্বারা পূর্ণ করুক এটা তার জন্য উত্তম কবিতা দিয়ে পেট পূর্ণ করা থেকে।” [সহীহ বুখারী হা/৬১৫৪, সহীহ মুসলিম হা/ ২২৫৭]
– খলিফা উমর রা. এর গভর্নর আদী বিন নযলাকে অশ্লীল কবিতা বলার অপরাধে পদচ্যুত করেন।
– উমর বিন আব্দুল আজিজ একই কারণে আবুল আহওয়াসকে দেশান্তরিত করেন। [তাফসিরে কুরতুবি]

✪ ২. যে সব কবিতায় অসত্য, বেহায়া, অশ্লীল ও শরিয়ত গর্হিত কোন কথা নেই এবং আল্লাহ তাআলার জিকির, ইবাদত ও কুরআন থেকে গাফেল রাখে না বরং ঈমান ও আমলের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে, জি/হা/দের প্রতি প্রেরণা যোগায় তা ভালো ও প্রশংসনীয়। এরূপ কবি ও কবিতা উভয়কে আল্লাহ তাআলা ও রসূল প্রশংসা করেছেন। যেমন: সূরা শুয়ারা-এর ২২৭ নাম্বার আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

– রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّ مِنَ الشِّعْرِ حِكْمَةً
“কিছু কবিতা রয়েছে প্রজ্ঞা পূর্ণ।” [সহীহ বুখারী, হা/ ৬১৪৫]
– তিনি আরও বলেন,
الشعرُ بمنزلةِ الكلامِ ، فحسَنُه كحسنِ الكلامِ ، و قبيحُه كقبيحِ الكلامِ
“কবিতা হল, কথার মত। ভালো কবিতা ভালো কথার মত আর খারাপ কবিতা খারাপ কথার মত।” [সিলসিলা সহীহাহ, হা/৪৪৭, সহিহুল জামে, হা/ ৩৭৩৩]

– রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একজন কবি ছিলেন যার নাম হাসসান বিন সাবেত রা.। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষে কাফিরদের কবিতার প্রত্যুত্তর দিতেন। মদিনায় দশ জন সাহাবি কবি ছিলেন। [তাফসিরে কুরতুবি]।

সুতরাং কবিদের সতর্ক হওয়া উচিত সে কী কবিতা বলছে। যদি ভাল হয় তাহলে তার পরিণাম ভালো আর মন্দ হলে তার মন্দ পরিণাম নিজের ওপর বর্তাবে।”
[শাইখ শহীদুল্লাহ খান মাদানি (হাফিযাহুল্লাহ) রচিত তাফসিরে ফাতহুল মাজিদ থেকে নেওয়া। সামান্য পরিমার্জিত ও সংযোজিত]

◈ আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবি হাসসান বিন সাবিত রা.-এর উদ্দেশ্যে দুআ করেছেন:

হাসসান ইবনে সাবিত রা. হতে বর্ণিত। তিনি বললেন, হে আবু হুরায়রা, আমি আপনাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি। আপনি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ কথা বলতে শুনেছেন যে,

‏ يَا حَسَّانُ أَجِبْ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ، اللَّهُمَّ أَيِّدْهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ ‏

“ওহে হাসসান! তুমি আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে (মুশরিকদের) প্রত্যুত্তর দাও। হে আল্লাহ! তুমি জিবরিল আ.-এর মাধ্যমে তাকে সাহায্য কর।”?
আবু হুরাইরা রা. বললেন, হ্যাঁ।”
[সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), অধ্যায়: ৭৮/ আচার-ব্যবহার, পরিচ্ছেদ: ৭৮/৯১. কবিতার মাধ্যমে মুশরিকদের নিন্দা করা।]

◈ কা/ফি/র-মু/শ/রি/কদের বিরুদ্ধে কবিতা আবৃতিকে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমর্থন করেছেন:
আনাস রা. থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমরাতুল কাযায় মক্কায় প্রবেশ করেন। আর তখন আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা. এই কবিতা পাঠ করতে করতে তাঁর সামনে হাঁটছিলেন:

خَلُّوا بَنِي الْكُفَّارِ عَنْ سَبِيلِهِ
الْيَوْمَ نَضْرِبْكُمْ عَلَى تَنْزِيلِهِ
ضَرْبًا يُزِيلُ الْهَامَ عَنْ مَقِيلِهِ
وَيُذْهِلُ الْخَلِيلَ عَنْ خَلِيلِهِ

অর্থ: “হে কাফির সম্প্রদায়! তাঁর রাস্তা ছেড়ে দাও। তার প্রবেশে বাধা দিলে তোমাদেরকে আঘাত করবো। এমন আঘাত, যা মাথা স্থানচ্যুত করে দেবে এবং বন্ধুকে বন্ধুর কথা তুলিয়ে দেবে।”

তারপর তাকে উমর রা. বললেন, হে ইবনে রাওয়াহা! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে হারাম শরিফে তুমি কবিতা আবৃত্তি করছ! তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। এই কবিতা কাফিরদের অন্তরে তীর নিক্ষেপের চেয়ে দ্রুত প্রভাব বিস্তারকারী।”

[সুনান আন-নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ২৪/ হজ্জের নিয়ম-পদ্ধতি, পরিচ্ছেদ: ১০৯. ইমামের সামনে দিয়ে হারামে কবিতা পাঠ করা ও হাঁটা-চলা করা]

❑ আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. বলেন,

هذا فيه تفصيل أيضًا، والشعر مثلما قال الشافعي رحمه الله: “حسنه حسن، وقبيحه قبيح”، فالشعر الذي ينصر الحقَّ ويُؤيد الحقَّ، ويهدم الباطل وأهل الباطل؛ هذا مطلوبٌ، هذا مشروعٌ، وهو الذي كان يقوم به حسان بن ثابت ، وعبدالله بن رواحة، وسعد بن مالك، وغيرهم من الشعراء الذين كانوا في عهده ﷺ وبعده.
أما إذا كان الشعر في ذمِّ الحق، ومدح الخنا والفساد، والدعوة إلى الزنا والفجور؛ فهذا منكرٌ محض لا يجوز.
فالشعر يختلف بحسب مقاصده ومراد صاحبه: فإن أراد الحقَّ والخير ومُقتضى شعره يدل على ذلك؛ فلا بأس في ذلك، ومن الدعوة إلى الخير، والدعوة إلى الحق، وإن كان شعره يدعو إلى الباطل والفساد؛ صار مذمومًا يجب منعه منه

“ইসলামে কবিতা চর্চা জায়েজ-নাজায়েজ হওয়ার বিষয়টিও ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। যেমনটি ইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেছেন, “এর ভালোটি ভালো এবং খারাপটি খারাপ।”
সুতরাং যে কবিতা সত্য ও ন্যায়কে সাহায্য ও সমর্থন করে এবং বাতিল এবং বাতিল পন্থীদেরকে ধ্বংস করে সে কবিতা প্রত্যাশিত এবং তা শরিয়ত সম্মত। এ কাজটিই করেছেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর-যুগে হাসান বিন সাবিত রা., আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা., সাদ বিন মালিক রা. প্রমুখ যে সব কবিরা ছিলেন তারা।
কিন্তু কবিতা যদি সত্যের সমালোচনা করে, বিশ্বাসঘাতকতা, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার প্রশংসা করে এবং ব্যভিচার ও পাপাচারের দিকে আহ্বান জানায় তাহলে তা হল, নিন্দনীয় ও নিকৃষ্ট কাজ-যা জায়েজ নয়।

মোটকথা, কবিতার উদ্দেশ্য এবং কবির অভিপ্রায় অনুসারে কবিতার বিধান ভিন্ন হয়। যদি তার উদ্দেশ্য হয় সত্য ও কল্যাণ এবং তার কবিতার মূল বক্তব্য সে দিকে ইঙ্গিত দেয়, কল্যাণ ও সত্যের দিকে আহ্বান করে তাহলে তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যদি কবিতা মিথ্যা, বিশৃঙ্খলা ও অন্যায়ের দিকে আহ্বান করে তাহলে তা হয়ে উঠে নিন্দনীয়- যা থেকে তাকে নিবৃত রাখা অপরিহার্য।” [binbaz]
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: