সাত জমিনে সাতজন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থাকা বিষয়ে বিভ্রান্তির জবাব

সাত জমিনে সাতজন আদম, সাতজন নূহ, সাতজন ইবরাহিম, সাতজন ইসা আ. এবং সাতজন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থাকা বিষয়ে এক বক্তার বিভ্রান্তির জবাব এবং এ ব্যাপারে ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি:

প্রশ্ন: সাত জমিনে সাতজন আদম, সাতজন নূহ, সাতজন ইবরাহিম, সাতজন ইসা এবং সাতজন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আছেন”- এ ব্যাপারে ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাই।
উত্তর: মূল প্রশ্নের উত্তর জানার আগে আমরা জানব, জমিনের সংখ্যা কয়টি, এ বিষয়ে কুরআনে কী বলা হয়েছে এবং এ বিষয়ে মুফাসসিরগণের মতামত কী?

কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা এটি প্রতিষ্ঠিত কথা যে, সাত আসমান যেমন থরে থরে সাজানো আছে ঠিক তেমনটি সাত তবক জমিনও থরে থরে সাজানো আছে। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,

اللَّهُ الَّذِى خَلَقَ سَبْعَ سَمٰوٰتٍ وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ يَتَنَزَّلُ الْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوٓا أَنَّ اللَّهَ عَلٰى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ وَأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَىْءٍ عِلْمً

“আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সপ্ত আসমান এবং জমিনও অনুরূপ। ওগুলোর মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ, যাতে তোমরা বুঝতে পার যে, অবশ্যই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন।” [সূরা তালাক: ১২]

❑ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরবিদগণের বক্তব্য:

◈ ১. তাফসিরে আহসানুল বায়ান-এ বলা হয়েছে:

أَيْ: خَلَقَ مِنَ الأَرْضِ مِثْلَهُنَّ

“অর্থাৎ সাত আসমানের ন্যায় সাত জমিনও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন।”

কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন, সাতটি প্রদেশ। তবে এ কথা ঠিক নয়। বরং যেভাবে উপর্যুপরি সাতটি আসমান রয়েছে, অনুরূপ সাতটি জমিনও রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দূরত্ব ও ব্যবধানও আছে এবং প্রত্যেক জমিনে আল্লাহর সৃষ্টি আবাদ রয়েছে। [কুরতুবী]

বহু হাদিস দ্বারা এ কথার সমর্থনও হয়। যেমন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি জুলুম করে বিঘত পরিমাণ জমিন আত্মসাৎ করবে, কিয়ামতের দিন সাত তবক জমিনকে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।” [মুসলিম, বাণিজ্য অধ্যায়, জুলুম করা হারাম পরিচ্ছেদ]

সহীহ বুখারির শব্দাবলী হলো,
خُسِفَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِلَى سَبْعِ أَرَضِينَ
“কিয়ামতের দিন তাকে সপ্ত জমিনের নীচ পর্যন্ত ধসিয়ে দেওয়া হবে।” [বুখারী, মাযালিম অধ্যায়, জমিন আত্মসাৎ করার পাপ পরিচ্ছেদ]

কেউ কেউ এটাও বলেন যে, প্রত্যেক জমিনে ঐ রকমই পয়গম্বর রয়েছেন, যে রকম পয়গম্বর তোমাদের জমিনে এসেছেন। যেমন: আদমের মত আদম, নুহের মত নুহ, ইবরাহিমের মত ইবরাহিম এবং ইসার মত ইসা (আলাইহিমুস সালাম)। কিন্তু এ কথা কোন সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়।

◈ তাফসিরে ফাতহুল মাজিদে উক্ত আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে,

(وَّمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ)

অর্থাৎ সাত আসমানের মত সাত জমিনও আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন। হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি জুলুম করে এক বিঘত পরিমাণ অন্যের জমি দখল করে নেবে তাকে সপ্ত জমিনের গলাবন্ধ পরানো হবে।”[সহীহ বুখারী হা. ২৪৫২]

অন্যত্র এসেছে, “তাকে সাত জমিনের নীচ পর্যন্ত ধসিয়ে দেওয়া হবে।” [আহমদ, হা/ ৫৭৪০]

(يَتَنَزَّلُ الْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ)

অর্থাৎ যেভাবে প্রত্যেক আসমানে আল্লাহ তাআলার বিধান কার্যকর ও বলবত আছে অনুরূপ প্রত্যেক জমিনেও তাঁর নির্দেশ চলে। সপ্ত আকাশের মত সপ্ত জমিনের পরিচালনাও তিনিই করেন।

❑ সাত জমিনে সাত জন আদম, সাতজন নূহ, সাতজন ইবরাহিম, সাতজন ইসা আ. এবং সাতজন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থাকার বর্ণনাটি সহিহ নয়:

সাত জমিনে সাতজন আদম, সাতজন নূহ, সাতজন ইবরাহিম, সাতজন ইসা আ. এবং সাতজন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থাকার পক্ষে ইবনে আব্বাস রা. এর যে বর্ণনাটি পেশ করা হয় তা বিজ্ঞ মুহাদ্দিসদের দৃষ্টিতে সহিহ নয় (শায ও ইসরাইলি বর্ণনা)।

বর্ণনাটি হলো, ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন,

سبع أرضين ، في كل أرض نبي كنبيكم ، وآدم كآدم ، ونوح كنوح ، وإبراهيم ، كإبراهيم ، وعيسى كعيسى

“সাত জমিনের প্রতিটি জমিনে তোমাদের নবীর মতই একজন করে নবী, আদমের মত আদম, নূহের মত নুহ, ইবরাহিমের মত ইবরাহিম এবং ইসার মত ইসা আছে।”

◯ মুহাদ্দিস ও বিজ্ঞ আলেমগণের অভিমত নিম্নরূপ:

◆ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন, এ বর্ণনাটি شاذ ‘শায’। [তুহফাতুন নুবালা/৬৫]

◆ ইমাম বায়হাকিও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন,
إسناد هذا عن ابن عباس صحيح وهو شاذ بمرة ، لا أعلم لأبي الضحى عليه متابعا
“ইবনে আব্বাস রা. থেকে উক্ত বর্ণনাটি সহিহ। কিন্তু তা شاذ بمرة “একদম শায।” এবং (সাহাবি থেকে বর্ণনাকারী) আবুয যুহা-এর কোনও متابع (সমর্থনকারী বর্ণনাকারী) আছে বলে জানি না।”

উল্লেখ্য যে, “একাধিক সিকাহ (নির্ভরযোগ্য) রাবি (বর্ণনাকারী)-এর বিপরীতে একজন সিকাহ রাবির বর্ণনাকে শায বলা হয়।
মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টি শায বর্ণনা জইফ (দুর্বল) হাদিসের অন্তর্ভুক্ত।

◆ আব্দুর রহমান আল মুআল্লিমি বলেন, إسناده ليس صحيحا “এর সনদ সহিহ নয়।” [আল আনোয়ারুল কাশেফাহ/১১৭]

◆ ইবনে কাসির রাহ. বলেন,

إن صح نقله عنه على أنه أخذه ابن عباس رضي الله عنه عن الإسرائيليات

“ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনাটি সহিহ বলে ধরা হলে তিনি তা ইসরাইলি বর্ণনা থেকে নিয়েছেন।” [বিদায়া-নিহায়া ১/১৮] অর্থাৎ এটি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোনো হাদিস নয় বরং তা ইবনে আব্বাস রা.-এর বক্তব্য-যা তিনি ইসরাইলি বর্ণনা (আহলে কিতাবদের) থেকে গ্রহণ করেছেন।
আর এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মূলনীতি হল, সহিহ হাদিসের সমর্থন ছাড়া ইসরাইলি বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ এ কথার পক্ষে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোনও হাদিস সাব্যস্ত হয়নি।

❑ “সাতটি জমিনের মধ্যে দূরত্ব ৫০০ বছরের রাস্তা” এ মর্মে বর্ণিত হাদিসটি সহিহ নয়:

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

قال: أَتَدْرون ما هذا تحتَكم؟ قلنا: اللهُ ورسولُه أَعلَمُ
قال: أرضٌ، أَتَدْرون ما تحتَها؟ قلنا: اللهُ ورسولُه أَعلَمُ،
قال: أرضٌ أُخرى، أَتَدْرون كم بينَهما؟ قلنا: اللهُ ورسولُه أَعلَمُ،
قال: مَسيرةُ خمسِ مِئةِ عامٍ. حتى عَدَّ سبعَ أرَضينَ، ثمَّ قال: وَايْمُ اللهِ، لو دَلَّيتُم أَحدَكم بحبلٍ إلى الأرضِ السُّفلى السابعةِ؛ لَهَبَطَ. ثمَّ قرَأَ: {هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ} [الحديد: 3].
رواه الترمذي فقال: هذا حديث غريب من هذا الوجه

“রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জানো, তোমাদের নিচে কী আছে?
আমরা বললাম: আল্লাহ ও তার রসুল ভালো জানেন।
তিনি বললেন: জমিন। তোমরা কি জানো, এই জমিনের নিচে কী আছে?
আমরা বললাম: আল্লাহ ও তার রসুল ভালো জানেন।
তিনি বললেন, আরেকটি জমিন। তোমরা কি জানো, এই দুই জমিনের মাঝে দূরত্ব কত?
আমরা বললাম: আল্লাহ ও তার রসূল ভালো জানেন।
তিনি বললেন, ৫০০ বছরের পথ। এভাবে তিনি ৭টি জমিন গণনা করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, সেই মহান সত্তার কসম যার হাতে মোহাম্মাদ-এর প্রাণ। যদি তোমরা একটি রশি নীচে জমিনের দিকে ঝুলিয়ে দাও, তা অবশ্যই আল্লাহর কাছে গিয়ে পৌঁছবে। অতঃপর তিনি কুরআনের এ আয়াতটি পাঠ করলেন,
هُوَ الۡاَوَّلُ وَ الۡاٰخِرُ وَ الظَّاهِرُ وَ الۡبَاطِنُ ۚ وَ هُوَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ
“তিনি প্রথম, তিনি শেষ, তিনি প্রকাশ্য, তিনি গোপন।” [সূরা আল হাদীদ: ৩]
য’ঈফ: তিরমিযী ৩২৯৮, য’ঈফুল জামি ৬০৯৪, হাসান বাসরী ‘আন দ্বারা হাদীস বর্ণনা করেছেন, আর তিনি মুদাল্লিস; হিদায়াতুর রুওয়াত ৫/২৫৩, ৫৬৬৭।] ” [তিরমিযী]

◯ হাদিসটি মান: (সহিহ নয় ✘)

মুহাদ্দিসগণের গবেষণায় সনদের মানদণ্ডে উক্ত হাদিসটি সহিহ নয়। নিম্নে এ প্রসঙ্গে জগদ্বিখ্যাত কয়েকজন মুহাদ্দিসের মতামত তুলে ধরা হল:

১. ইবনুল জাওযী উপরোক্ত হাদিস সম্পর্কে বলেন, لا يصح “এ হাদিসটি সহিহ নয়।” [আল ইলালুল মুতানাহিয়া ১/২৭]

২. ইবনে হাজার আসকালানী. বলেন, روي من طرق ولا يصح سنده “এটি একাধিক সনদে বর্ণিত হলেও এর সনদ সহিহ নয়।” [তুহফাতুন নুবালা/৬৩]
৩. ইবনে কাসির বলেন, روي مرسلا وهذا أشبه “এটি মুরসাল (জইফ-এর একটি প্রকার) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এ কথাই অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ।” [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১/১৭]
৪. হায়সামি বলেন, فيه الحكم بن عبد الملك وهو متروك الحديث “এর সনদে আল হাকাম বিন আব্দুল মালিক নামক একজন বর্ণনাকারী আছে। সে মাতরূকুল হাদিস (হাদিসের ক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য])” [মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১/৯০) অন্যত্র বলেছেন, উক্ত ব্যক্তি জঈফ বা দুর্বল পূর্বোক্ত গ্রন্থ ৭/১২৩]
৫. শুআইব আরনাবুত বলেন: إسناده ضعيف “এর সনদ দুর্বল।” [তাখরিজুল মুসনাদ/ ৮৮২৮]

❑ গল্পবাজ বক্তাদের ব্যাপারে সতর্কীকরণ:

দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, বর্তমানে কিছু তথাকথিত বক্তা নামধারী গল্পবাজদের কারণে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে একটা ঈমানি জাগরণ শুরু হয়েছিলে তাতে আবার হতাশার আঁধার নামতে শুরু হয়েছে। এ সব আলতু-ফালতু ওয়াজ শুনে মানুষ আজ বিরক্ত ও হতাশ। মানুষকে চমকপ্রদ তথ্য দেওয়ার চিন্তা থেকে এভাবে খুঁজে খুঁজে জাল-জঈফ ও অদ্ভুত ইসরাইলি বর্ণনা উপস্থাপনের মাধ্যমে যদি সাধারণ মানুষের সামনে ওয়াজ করা হয় তাহলে জাতির ইমানের বারোটা বাজতে সময় লাগবে না। তাই এদের ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। তারা এ পথ থেকে ফিরে না আসলে তাদেরকে বয়কট করা সময়ের দাবী।
আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন। আল্লাহু আলাম।

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।