শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতি সহিংসতা: ইসলামি দৃষ্টিকোণ এবং প্রতিকার

প্রশ্ন: এক বোন জিজ্ঞাসা করেছেন, মাদরাসা শিক্ষক কর্তৃক শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতি নির্মম অত্যাচারের ঘটনা দেখার পর নিজের সন্তানকে কিভাবে মাদরাসায় ভর্তি করি? প্রশ্ন জাগে, দেশের বড় মাদরাসাগুলোর ওস্তাদদের আচরণও কি এমন সহিংস? ইসলাম এ ব্যাপারে কী বলে?
উত্তর:
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে যে, একজন মাদরাসার শিক্ষক এক শিশু শিক্ষার্থীকে হাতপা বেঁধে নির্মম ভাবে বেধড়ক পেটাচ্ছে।
নি:সন্দেহে এটি একটি চরম বেদনা দায়ক ঘটনা এবং অমানবিক কাজ। এটি মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে অন্যায় এবং আইনগত ভাবে অপরাধ তো বটেই ইসলামের দৃষ্টিতেও হারাম ও গুনাহের কাজ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيُوَقِّرْ كَبِيرَنَا
“যে ছোটদের সত্যি দয়া এবং বড়দেরকে শ্রদ্ধা করে‌ না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।“ (আবু দাউদ, তিরমিযী প্রমূখ-শাইখ আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন)
আয়েশা রা. বলনে, এক গ্রাম্য ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“تُقَبِّلُونَ الصِّبْيَانَ فَمَا نُقَبِّلُهُم. فَقَالَ النَّبِيُّ ﷺ: أَوَأَمْلِكُ لك أَنْ نَزَعَ الله من قَلْبِك الرحمة
“তোমরা কি তোমাদের শিশুদেরকে চুমু খাও?
সে বলল, আমরা তাদেরকে চুমু খাই না।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে দয়া ছিনিয়ে নিয়ে থাকনে তাহলে আমার কী করার আছে?” [সহিহ বুখারি, হা/৫৬৫২]
বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের সাথে আচার-আচরণে ছিলেন অত্যন্ত নম্র ও দয়ালু। বিশেষ করে মানুষকে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে তিনি সহজ, সরল এবং অমায়িক পন্থা অবলম্বন করতেন। কঠোরতা পরিহার করতেন। শিশুদের প্রতি তার ছিল গভীর স্নেহ, মমতা ও ভালবাসা। তিনি শিশুদেরকে আগে সালাম দিতেন। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। তাদেরকে কোলে তুলে চুমু খেতেন। তাদের সাথে মজা করতেন। তাদের খেলাধুলার খোঁজ-খবর নিতেন। কখনো কখনো হাসান হুসাইন রা. কে পিঠে উঠিয়ে তিনি ঘোড়ার মত চলতেন। তিনি সেজদা রত অবস্থায় কখনো তারা তাঁর পিঠে উঠে বসলে তিনি সেজদা দীর্ঘ করতেন কিন্তু জোর করে পিঠ থেকে নামাতেন না। তাদেরকে বকাঝকা করতেন না। কখনো ছোট্ট শিশু তার কোলে পেশাব করে দিলেও তিনি বিরক্ত হতেন না। তিনি তাদেরকে বিভিন্ন বিষয় শেখাতেন এবং কোনও ভুল করলে পরম ভালবাসায় তাদেরকে শুধরে দিতেন।
এই ছিল প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ। কিন্তু আজ তাঁর ওয়ারিশ দাবিদার কতিপয় শিক্ষকের আচরণ কেমন? এদের কারণে সত্যিই আলেমসমাজ আজ লজ্জিত এবং অপমানিত। আল্লাহ এদেরকে হেদায়েত করুন। আমীন।
আল হামদুলিল্লাহ অধিকাংশ মাদরাসার শিক্ষক ছাত্রদের প্রতি অমায়িক, স্নেহশীল ও দয়ালু। তবে হাজার হাজার ভালোর মধ্যে সবসময় কিছু ব্যতিক্রম থাকে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ সমাজের সর্বত্রই তা রয়েছে। কিন্তু আমাদের উচিৎ, ব্যতিক্রমকে মূল মনে না করা।
◍ যাহোক, আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ কাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া আপনার অবশ্য কর্তব্য। তাই তাদেরকে কোনও দীনী প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার পূর্বে সেখানকার শিক্ষকদের আকিদা-বিশ্বাস, লেখাপড়ার মান, শিক্ষার পরিবেশ, পাঠ্যক্রম, আচার-আচরণ ইত্যাদি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিন।
◍ এটা নিশ্চিত যে, অভিভাবকবৃন্দ ও মাদরাসা কমিটি সচেতন থাকলে দু একজন বদমেজাজি শিক্ষকদের সহিংস ও নিপীড়ন মূলক আচরণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। দু একজন শিক্ষকের কারণে পুরো প্রতিষ্ঠান বা পুরো শিক্ষাব্যবস্থা কলুষিত হোক তা কোনভাবেই কাম্য নয়।
◍ মাদরাসার কমিটির কর্তব্য, শিক্ষক নিয়োগের পূর্বে শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তাদের মন-মেজাজ, চিন্তা-ভাবনা, আকিদা-বিশ্বাস, আচার-আচরণ ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া এবং নিয়োগ দেয়ার পর প্রতিনিয়ত এসব তদারকি করা। পাশাপাশি শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সাথে সম্পর্ক বাড়ানো, তাদের সাথে মতবিনিময় করা এবং তাদের অভিযোগগুলো দ্রুত সমাধান করা।
◍ আরেকটি বিষয় হল, স্কুল-কলেজ ও সরকারি মাদরাসাগুলোর জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও কওমি বা বেসরকারি এবং হাফেজি মাদরাসাগুলোর শিক্ষকদের কোনও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বেই। সুতরাং মানসম্মত শিক্ষা দানের স্বার্থে এ সকল শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।
◍ তাছাড়া ছাত্রদের প্রতি নিপীড়ন মূলক আচরণের জন্য শাস্তি মূলক সরকারি আইন আছে। সরকার জাতীয় শিক্ষানীতির যে খসড়া প্রকাশ করেছে সেখানে শারীরিক কিংবা মানসিক শাস্তি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে একে শিক্ষকের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে উল্লেখ করেছে। শিক্ষা আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, “শ্রেণিকক্ষে কোন শিক্ষার্থীকে শিক্ষক কর্তৃক কোন শারীরিক শাস্তি কিংবা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। আর এ বিধান ভঙ্গকারীকে অনধিক ১০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা তিন মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।” (সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব)
সুতরাং প্রশাসনের কর্তব্য, কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন কোন অভিযোগ পেলে গুরুত্বের সাথে তদন্ত পূর্বক তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া।
যদিও ইসলামের দৃষ্টি ছোট বাচ্চাদেরকে আদব-কায়দা শেখানোর জন্য প্রয়োজনবোধে হালকা প্রহার বা সামান্য কিছু শাস্তি দেয়া জায়েজ আছে।
◯ পড়ুন: বাচ্চাদেরকে প্রহার করা বা চড়-থাপ্পড় দেয়ার হুকুম
পরিশেষ বলবো, আসুন, আমরা আমাদের আগামী প্রজন্ম শিশু-কিশোরদের প্রতি আরও বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করি এবং তাদের মেধা বিকাশ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠনের নিমিত্তে স্নেহ, মমতা ও ভালবাসা পূর্ণ একটি নিরাপদ শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করি। তাহলে ইনশাআল্লাহ মানুষ গড়ার আঙ্গিনায় তৈরি হবে প্রত্যাশিত আলোকিত মানুষ।
আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন।
◯ আরও পড়ুন: কিভাবে আপনার সন্তানকে বড় আলেম বানাবেন?
(সন্তানকে বড় আলেম বানানোর দশটি দিক নির্দেশনা)
▬▬▬▬◐◯◑▬▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।