শরীরে ট্যাটু করা সম্পর্কে ইসলামের বিধান, ভয়াবহতা এবং এ অবস্থায় ওজু-গোসল, সালাত ইত্যাদির নিয়ম

বহু হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে যে শরীরে ট্যাটু (attoo) করা বা উল্কি অঙ্কন করা হারাম, কবিরা গুনাহ (বড় পাপ) এবং অভিশাপ যোগ্য কাজ। পাশাপাশি এটি অমুসলিমদের সাথে ও সাদৃশ্য অবলম্বনে অন্তর্ভুক্ত। সেই সাথে এটি কৃত্রিমভাবে আল্লাহর সৃষ্টিগত সৌন্দর্য বিকৃতির শামিল।
তাই নারী-পুরুষ সকলের জন্য শরীরে ট্যাটু উল্কি অঙ্কন করা, করিয়ে নেয়া, এটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা, ইউটিউব বা অনলাইন-অফলাইনে এগুলো মানুষকে শিখানো বা প্রচার করা সম্পূর্ণ হারাম।

সেই সাথে ট্যাটুতে যদি অমুসলিমদের ধর্মীয় প্রতীক, প্রাণীর ছবি, ড্রাগনের মাথা, প্রাণীর কার্টুন, নারী-পুরুষের ছবি, বয় ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ড এর নাম, অশ্লীল বাক্য ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় অথবা বিপরীত লিঙ্গের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ট্যাটু করা হয় তখন তার গুনাহ ও ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পায়।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে কিছু মুসলিম যুবক-যুবতী তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে কালিমা, আল্লাহ, রাসূল, কাবা শরীফ, মসজিদে নব্বী ইত্যাদি ইসলামি নির্দশনের ট্যাটু অঙ্কন করে এটিকে হালাল করার অপচেষ্টা করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটিও অত্যন্ত গর্হিত কাজ ও ইসলামের প্রতি ধৃষ্টতার শামিল।

সুতরাং এসব হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আবশ্যক। (আল্লাহ ক্ষমা করুন। আমিন)

কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, বর্তমানে অনেক মুসলিম যুবক-যুবতী এ বিষয়ে ইসলামের কঠোর নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে না জানার কারণে অথবা হয়ত জেনেও অবজ্ঞা বশত: তথাকথিত ফ্যাশন হিসেবে শরীরে উল্কি অঙ্কন বা ট্যাটু করছে, অনেকে রীতিমত এ কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছে। অথচ এ কাজ করা যেমন হারাম তেমনি এ পেশা থেকে উপার্জিত অর্থও হারাম।

❑ ট্যাটু প্রথার বিস্তৃতি এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ভবিষ্যতবাণী:

দু:খ জনক হলেও সত্য, ইদানীং আমাদের মুসলিম সমাজে ট্যাটু প্রথা বৃদ্ধি পেয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ধনীদের আলালের ঘরের দুলাল তরুণ-তরুণী সহ বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ এই অপসংস্কৃতিতে লিপ্ত হচ্ছে।
এই অপসংস্কৃতি বিস্তৃতির অন্যতম কারণ হল, বিভিন্ন অমুসলিম বা নামধারী ফাসেক মুসলিম নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, মডেল, খেলোয়াড় ইত্যাদির অন্ধ ভক্তি এবং অন্ধ অনুকরণ। কালের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া কিছু বিপথগামী তরুণ-তরুণী পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়ে তাদের মত অন্যায়-অপকর্মে লিপ্ত হতে দ্বিধা করছে না।
সত্যি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যতবাণী যথার্থভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি সতর্ক করেছিলেন যে, কেয়ামতের আগে এক শ্রেণীর মুসলিম ইহুদি- খ্রিস্টানদেরকে প্রতিটি পদে-পদে অনুসরণ-অনুকরণ করবে। এমনকি যদি তারা শান্ডার গর্তে প্রবেশ করে এরাও তাদের অনুসরণে ওই গর্তে গিয়ে প্রবেশ করবে। (বুখারি ও মুসলিম)
আল্লাহ তালা এসকল অর্বাচীন ও অজ্ঞ লোকদেরকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান দান করুন এবং হেদায়েত করুন। আমীন।

❑ ট্যাটু করা শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর?

অনেক মানুষ জানে না যে, ট্যাটুতে যে রঙ ব্যবহার করা হয় তার সঙ্গে মেশানো হয় মারাত্মক একটি রাসায়নিক পদার্থ৷ এই রাসায়নিক পদার্থ চামড়ার একেবারে ভিতর থেকে শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে৷ আর যেহেতু এই উল্কি সারাজীবন শরীরে থাকবে তাই এই রাসায়নিক পদার্থ সারাজীবন দেহে থেকে যাবে৷ এর ফলে বিভিন্ন ধরণের অসুখ এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে৷ (বিশেষজ্ঞদের মতে এতে হেপাটাইটিস, টিউবারকিউলোসিস, টিটেনাসের মতো বিভিন্ন রোগের সংক্রমণের আশঙ্কা আছে।)

গবেষক এফা মারিয়া বললেন,‘‘আমরা বিভিন্ন ধরণের প্রসাধনী থেকে শুরু করে উল্কি আঁকার কালি নিয়ে গবেষণা করি৷ ২০১০ সালে আমরা বেশ কিছু ট্যাটু পার্লার থেকে কালি সংগ্রহ করেছি৷ প্রায় ৩৮ ধরণের কালি আমাদের সংগ্রহে আসে৷ এর মধ্যে লাল, হলুদ এবং কমলা রঙ ছিল সবচেয়ে বেশি৷”
পরীক্ষায় কী পাওয়া গেছে? যা পাওয়া গেছে তা ভয় পাওয়ার মত৷ অনেক রঙ বা কালি তৈরি করা হয় এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে যা কোন প্রাণীর ওপর ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ৷ এর মধ্যে একটি পদার্থের নাম এজো ডাই৷ রঙটি এমনিতে কোন ক্ষতি করবে না কিন্তু অন্য কোন কিছুর সংস্পর্শে আসলে তা হবে অত্যন্ত ক্ষতিকারক৷ এর মধ্যে আরও অনেক রাসায়নিক পদার্থ আছে যা ব্যবহারে কোন নিষেধ নেই কিন্তু কোন অবস্থাতেই তা মানবদেহে ব্যবহার করা যাবে না৷ এফা মারিয়া আরও জানালেন,‘‘এই পদার্থগুলো বাজার পাওয়া যায় কারণ এগুলো প্লাস্টিক বা কঠিন পদার্থের ওপর প্রয়োগ করা যায়৷ গাড়ির রঙ বা দেয়ালের রঙে তা ব্যবহার করা যায়৷ আর সমস্যা এখানেই৷ এই পদার্থগুলো মানবদেহে ঢুকে কী কী ক্ষতি করতে পারে তা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি৷”
(উৎস: DW ডয়চে ভেলে-জার্মান তরঙ্গ এর অফিসিয়াল বাংলা ওয়েব সাইট)

❑ শরীরে উল্কি ট্যাটু থাকা অবস্থায় অজু, গোসল এবং সালাত:

প্রথমে আমাদের জানা দরকার যে, কীভাবে শরীরে উল্কি বা ট্যাটু আঁকা হয়। মূলত: শরীরে দু ভাবে তা করা হয়। যথা:

◈ ১) স্থায়ী ট্যাটু:

বিদ্যুৎচালিত একটি যন্ত্রের সাহায্যে তা করা হয়৷ দেখতে তা অনেকটা ডেন্টিস্ট এর ড্রিল মেশিনের মত যা দিয়ে দাঁতের চিকিৎসা করানো হয়৷ মেশিনের মাথায় রয়েছে অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটি সুঁই৷ এই সুঁইটির মাথায় রঙ লাগানো থাকে৷ প্রতিবার সুঁইটি যখন চামড়ার ভেতরে প্রবেশ করানো হয় সেই সঙ্গে রঙও ভেতরে প্রবেশ করে৷ রঙের পরিমাণ এক মিলিলিটারেরও কম৷ চামড়ার যে স্তরে রঙটি লাগানো হয় তার নাম ডের্মিস৷ এই স্তরে যে কোন রঙ ঢোকাতে পারলে তা সারাজীবন দেখা যাবে৷ ভিক্টর আরও বলল,‘‘এটা বিশেষ এক পদ্ধতি৷ সারাজীবনই থাকবে৷ আপনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এই উল্কি আপনার গায়ে থাকবে৷ বিষয়টি দারুণ উত্তেজনার।”

এ ক্ষেত্রে শরীরের যে স্থানে ট্যাটু করা হয় সেখানে রক্ত জমাট বাধে-যা নাপাক এবং রক্তের সাথে বিভিন্ন রঙ কেমিক্যাল, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি মিশ্রণের ফলে সেখানে চামড়ার উপর একটা আস্তরণ তৈরি হয়। যার কারণে ওজু-গোসলের সময় চামড়া পানি পৌঁছে না।
তাই ট্যাটু কৃত স্থানটা নাপাক হওয়ার পাশাপাশি ওজু-গোসলের সময় সেখানে পানি পৌঁছতে বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে এ অবস্থায় ওজু-গোসল শুদ্ধ হবে না।ফলশ্রুতিতে সালাতও শুদ্ধ হবে না।

তবে কেউ যদি এর বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে এমনটি করে থাকে তাহলে তা জানার সাথে সাথে অনুতপ্ত হৃদয়ে খাঁটি ভাবে তাকে আল্লাহর নিকট তওবা-ইস্তিগফার করতে হবে এবং শরীরে লাগানো উল্কি/ ট্যাটু উঠিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে হবে।

বর্তমানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অথবা আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে লেজারের সাহায্যে স্থায়ী ট্যাটু রিমুভ করা সম্ভব। অবশ্য লেজারের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এ কাজটি সম্পাদন করা হয় এবং এক সাময় ট্যাটুর চিহ্ন মুছে যায়। ইদানীং এটি আমাদের দেশেও করা হচ্ছে।
কিন্তু কোন কারণে যদি তা রিমুভ করা সম্ভব না হয় বা এতে অঙ্গহানি বা শারীরিক ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাহলে সে অবস্থাই যথারীতি ওজু-গোসল এবং সালাত অব্যাহত রাখতে হবে। এ কারণে কোনভাবেই সালাত পরিত্যাগ করা বৈধ নয়। খাঁটি অন্তরে তওবার কারণে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করবেন বলে আশা করা যায় ইনশাআল্লাহ।
قال الحافظ ابن حجر رحمه الله تعالى:

” ويصير الموضع الموشوم نجسا، لأن الدم انحبس فيه ، فتجب إزالته إن أمكنت، ولو بالجرح، إلا إن خاف منه تلفا، أو شينا، أو فوات منفعة عضو: فيجوز إبقاؤه، وتكفي التوبة في سقوط الإثم، ويستوي في ذلك الرجل والمرأة ” انتهى من”فتح الباري” (10 / 372).

◈ ২) অস্থায়ী ট্যাটু:

স্থায়ী ট্যাটুর বিকল্প হিসেবে অনেকে অস্থায়ী ট্যাটু ব্যবহার করে। এটি দু ধরণের। যথা:

◍ ক. এয়ারব্রাশ ট্যাটু:
তুলির সাহায্যে রঙ দিয়ে শরীরে ট্যাটু আঁকা হয়। এটি দু তিন মাসের মধ্যে শরীর থেকে আপনা আপনি মুছে যায়। এ কারণে এটিকে এয়ারব্রাশ ট্যাটু বলে।

◍ খ.স্টিকার ট্যাটু:
ট্যাটুর স্টিকার শরীরের পছন্দ মত জায়গায় বসিয়ে ট্যাটু করা হয়। অবশ্য অস্থায়ী ট্যাটুকে পাশ্চাত্য সভ্যতায় ঠিক ট্যাটু বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।

ইসলামের দৃষ্টিতেও এগুলো হাদিসে নিষিদ্ধ প্রকৃত উল্কি বা ট্যাটু না হলেও অমুসলিমদের সাদৃশ্য অবলম্বনের কারণে তা ব্যবহার করা হারাম।

যাহোক, যদি কেবল তুলির রঙ ব্যবহার করে শরীরে ট্যাটু আঁকানো হয় আর তাতে চামড়ার উপর প্রলেপ না পড়ে তাহলে তাতে ওজু-গোসল শুদ্ধ হবে। কেননা, মেহদি বা সাধারণ রঙ শরীরে থাকলেও চামড়া পর্যন্ত পানি পৌঁছে। কিন্তু যদি রঙ ব্যবহারের কারণে চামড়ার উপর আবরণ পড়ে ফলে চামড়ায় পানি পৌছতে বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে তা গরম পানি, সাবান, কেমিক্যাল ইত্যাদি ব্যবহার করে কাপড় বা অন্য কিছু দ্বারা ধীরে ধীরে ঘোষে তুলে ফেলা আবশ্যক। অন্যথায় ওজু-গোসল ও সালাত শুদ্ধ হবে না।

আর শক্ত আঠা দিয়ে শরীরে স্টিকার লাগানো হলে তার ভেতর দিয়ে কখনোই চামড়ায় পানি পৌছবে না। সুতরাং এই অবস্থায় অজু গোসলও শুদ্ধ হবে না। তাই অনতিবিলম্বে স্টিকার ট্যাটু উঠিয়ে ফেলা আবশ্যক।

➧ শাইখ আল্লামা আব্দুল আযিয বিন বায বহ. বলেন,

“শরীরে উল্কি অংকন করা হারাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম থেকে এ ব্যাপারে হাদিস সাব্যস্ত হয়েছে,
أنه لعن الْوَاصِلَةِ وَالْمُسْتَوْصِلَةِ وَالْوَاشِمَةِ وَالْمُسْتَوْشِمَةِ
‘‘যে ব্যক্তি নিজে পরচুলা লাগায় এবং যে অন্যের কাছে লাগিয়ে নেয় এবং যে নিজে উল্কি আঁকে এবং উল্কি লাগিয়ে নেয় আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেন।’’ (সহিহুল বুখারী, পোশাক অধ্যায়, হাদিস নং ৫৪৭৭)
তবে কোনও মুসলিম যদি এটি হারাম হওয়া সম্পর্কে না জানার কারণে এমনটি করে অথবা বাল্যকালে শরীরে উল্কি আঁকায় তাহলে তা হারাম সম্পর্কে জানার পরে অবশ্যই তা শরীর থেকে দূর করতে হবে। কিন্তু এতে যদি কষ্ট বা ক্ষতি হয় তাহলে কেবল তওবা-ইস্তিগফার করাই যথেষ্ট। তারপর তা শরীরে থাকলেও ক্ষতি নেই।”
(মজমু ফতোয়া, আল্লামা বিন বাজ. ১০/৪৪)

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে অমুসলিমদের অন্ধ অনুকরণ, হারাম ও আল্লাহর অসন্তুষ্টি মূলক কার্যক্রম থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

——————————-

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।