রাসুলুল্লাহ কর্তৃক এক বৃদ্ধ মহিলাকে বোঝা বহনে সাহায্য করা এবং তার ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে প্রসিদ্ধ গল্পটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট

❑ প্রচলিত গল্পটি নিম্নরূপ:
মক্কার প্রখর রোদ ও উত্তপ্ত বালির উপর দিয়ে এক বৃদ্ধা মহিলা অতি কষ্টে কাঠের একটি ভারী বোঝা বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
তাঁকে দেখে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (নাম উল্লেখ না করে) এগিয়ে গেলেন এবং বিনয়ের সাথে তাঁকে সাহায্য করার প্রস্তাব দিলেন। তিনি বৃদ্ধার কাঁধ থেকে ভারী বোঝাটি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন এবং নীরবে তাঁর বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। দীর্ঘ পথে যেতে যেতে বৃদ্ধাটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে কুৎসা রটনা করতে লাগলেন। তিনি লোকটিকে সাবধান করে বললেন যে মক্কায় ‘মুহাম্মাদ’ নামে এক জাদুকর আছে, যে খারাপ চরিত্রের মানুষ এবং তার কথা যেন তিনি ভুলেও না শোনেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নীরবে সব কথা শুনলেন এবং কোনও প্রতিবাদ না করে বোঝা বহন করতে থাকলেন। অবশেষে তাঁরা বৃদ্ধার বাড়িতে পৌঁছালেন। কাঠ নামিয়ে দেওয়ার পর কৃতজ্ঞ বৃদ্ধাটি তাঁকে কোনও প্রতিদান দিতে না পেরে পুনরায় সেই ‘জাদুকর’ মুহাম্মাদ থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিলেন।
তখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “যদি আমিই সেই মুহাম্মাদ হই, তাহলে কি তখনও তুমি আমাকে অবিশ্বাস করবে?” তাঁকে এমন বিনয়ী, ধৈর্যশীল ও দয়ালু হিসেবে দেখে বৃদ্ধা মহিলা চমকে উঠলেন এবং তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন যে, যাকে তিনি খারাপ বলছিলেন, তাঁর চরিত্র আসলে কত মহৎ। মুহূর্তেই তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন এবং শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
(قصة الرسول صلى الله عليه وسلم مع امرأة عجوز: رأى رجل امرأة عجوزًا في مكة تحاول أن تحمل حزمة من الحطب، ولما رآها عجوزًا اتجه نحوها، وقال: أنا أحملها عنك، دُليني على دارك، وكان الطريق طويلًا، والرمال ملتهبة، والشمس حارقة، والهواء لافحًا، والبيت بعيدًا، والحمل ثقيلًا، فلما وصل إلى منزل تلك العجوز قالت له: يا بني، ليس لدي ما أكافئك به، ولكني سأُسدي إليك نصيحة، إذا رجعتَ إلى قومك في مكة، فهناك رجلٌ ساحر يدَّعي النبوة، يقال له محمد، إذا رأيته لا تصدِّقه، وإياك أن تتبعه، فقال: لماذا؟ قالت: لأنه سيِّئ الخُلق، قال: حتى وإن كنت أنا محمدًا الرسول؟ فقالت تلك
العجوز: إنْ كنت أنت محمدًا فأشهد أن لا إله إلا الله، وأنَّك رسول الله)).
الدرجة: لا أصل لها
[dorar..net]
এ গল্পটি কেউ কেউ এভাবে বলে যে━মক্কা বিজয়ের সময় এক বৃদ্ধ মহিলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভয়ে প্রাণপণে পালিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় তিনি তাকে সাহায্য করে তার বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। অতঃপর সেই মহিলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- নিকট তার পরিচয় জানতে পেরে কালিমা শাহাদাত পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
❑ হাদিসটির মান: (বানোয়াট বা ভিত্তিহীন)
উক্ত গল্পগুলো আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ওয়াজ মাহফিলে অনেক বক্তা, মসজিদের মেম্বরে অনেক খতিব বা কেউ যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মহান চরিত্র মাধুরীর উদাহরণ পেশ করতে চায় তখন তারা এ জাতীয় গল্প পেশ করে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হল, এই গল্প কোনও নির্ভরযোগ্য হাদিস বা সিরাতের কিতাবে আসেনি। অর্থাৎ এটি একটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন গল্প-যা হাদিসের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্র মাধুরী এবং নিঃস্বার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে একজন সমালোচনা কারীর হৃদয়ে ইসলামের আলো প্রজ্বলিত করার প্রমাণ হিসেবে এসব বানোয়াট ও ভিত্তিহীন গল্পের আদৌ প্রয়োজন নাই। কেননা এ সংক্রান্ত বিশুদ্ধ হাদিসের অভাব নেই। আমাদের কর্তব্য, সে সকল বিশুদ্ধ হাদিস পেশ করা। দুঃখজনক বিষয় হল, আমাদের সমাজের অনেক বক্তা, ইমাম, খতিব, দাঈ, ইসলামি সংগঠনের নেতা সহ অনেক মানুষ হাদিস যাচাই-বাছাই ছাড়া অনেক ভিত্তিহীন ও অপ্রমাণিত হাদিস বা হাদিসের গল্প পেশ করে থাকে! কিন্তু এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। ইসলামের দৃষ্টিতে এ কাজটি কবিরা গুনাহ। কেননা হাদিসে এসেছে, কেউ জেনে-বুঝে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে মিথ্যাচার করলে তার পরিণতি জাহান্নাম। মনে রাখা কর্তব্য যে, মানুষের সাথে সাধারণ মিথ্যা কথা এবং আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে মিথ্যা কথা এক নয়। সাধারণ মিথ্যা কথা হারাম, কবিরা গুনাহ এবং মুনাফেকির বৈশিষ্ট্য। কিন্তু হাদিসের নামে মিথ্যাচার করার পরিণতি এর থেকেও ভয়াবহ।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إنَّ كَذِبًا عَلَيَّ ليسَ كَكَذِبٍ علَى أَحَدٍ، مَن كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا، فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
“আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, আমার প্রতি মিথ্যারোপ করা তোমাদের কারো প্রতি মিথ্যারোপ করার মত নয়। যে ব্যক্তি জেনেশুনে ইচ্ছাকৃত ভাবে আমার প্রতি মিথ্যারোপ করে সে যেন জাহান্নামে তার বাসস্থান নির্ধারণ করে নেয়।” [সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)। মুকাদ্দামাহ (ভূমিকা), পরিচ্ছেদ: ২. রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর মিথ্যারোপ গুরুতর অপরাধ]
আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের নামে সব ধরণের মিথ্যা তথ্য পরিবেশন, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট গল্প ও হাদিস প্রচারের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।
Share: