যে ব্যক্তি একাকী রমজান মাসের নতুন চাঁদ দেখেছে তার জন্য কি সিয়াম পালন করা অনিবার্য?

প্রশ্ন: যে ব্যক্তি একাকী রমজান মাসের নতুন চাঁদ দেখেছে তার জন্য কি সিয়াম পালন করা অনিবার্য? যদি তা অনিবার্য হয় এর সপক্ষে দলীল কী?

উত্তর :

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।

যে ব্যক্তি রমজান মাসের নতুন চাঁদ অথবা শাওয়াল মাসের নতুন চাঁদ একাই দেখেছে এবং এ ব্যাপারে বিচারককে অথবা স্থানীয় লোকজনকে অবহিত করেছে কিন্তু তারা তার সাক্ষ্য গ্রহণ করেনি তবে কি সে একাই রোজা পালন করবে? নাকি সবার সাথে রোজা পালন করবে-এ ব্যাপারে আলেমগণের মাঝে তিনটি অভিমত রয়েছে:

প্রথম মত:

সে ব্যক্তি মাসের শুরু ও সমাপ্তি উভয় ক্ষেত্রে তার নিজের দেখা অনুসারে একাকী আমল করবে। মাসের শুরুতে তিনি একাকী রোজা শুরু করবেন এবং মাসের শেষে নিজের দেখা অনুযায়ী রোজা ছাড়বেন। এটি ইমাম শাফেয়ীর অভিমত।

তবে তিনি তা গোপনে করবেন। প্রকাশ্যে মানুষের বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত হবেন না। যাতে মানুষ তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা না করে। কারণ এক্ষেত্রে রোজাদারগণ তাকে বে-রোজদার মনে করবে।

দ্বিতীয় মত :

সে ব্যক্তি নিজের দেখা অনুসারে মাসের শুরুতে আমল করবেন এবং একাকী রোজা রাখা শুরু করবেন। তবে মাসের শেষে নিজের দেখা অনুসারে আমল করবেন না। বরং অন্য সবার সাথে রোজা ছাড়বেন করবে। এটি অধিকাংশ আলেমের মত। এদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদ রাহিমাহুমুল্লাহ।

আর এ মতটি গ্রহণ করেছেন শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ। তিনি বলেছেন: “এটি সাবধানতামূলক অভিমত। এ মত গ্রহণের মাধ্যমে আমরা রোজা থাকা ও ছাড়া উভয় ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করেছি। রোজা পালনের ক্ষেত্রে আমরা তাকে বলব: আপনি রোজা রাখুন। কিন্তু রোজা ছাড়ার ব্যাপারে আমরা তাকে বলব: আপনি রোজা ছাড়বেন না; বরং রোজা রাখতে থাকুন।” সমাপ্ত [আশ-শারহুল মুমতি (৬/৩৩০)]

তৃতীয় মত :

সে ব্যক্তি মাসের শুরু অথবা সমাপ্তি কোন ক্ষেত্রে তার নিজের দেখা অনুসারে আমল করবে না। বরং সবার সাথে রোজা রাখবে এবং সবার সাথে রোজা ছাড়বে।

এক বর্ণনামতে এ অভিমতের পক্ষে রয়েছেন ইমাম আহমাদ। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ এ মতটিকে সমর্থন করেছেন এবং এর সপক্ষে অনেক দলীল পেশ করেছেন। তিনি বলেন: “আর তৃতীয় মত হচ্ছে- সে ব্যক্তি অন্য সব মানুষের সাথে রোজা রাখবেন এবং সবার সাথে রোজা ছাড়বেন। উল্লেখিত মতগুলোর মধ্যে এ মতটি বেশি শক্তিশালী। এর পক্ষে দলীল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী: “আপনাদের রোজা হবে সেদিন, যেদিন আপনারা সকলে রোজা রাখেন এবং আপনাদের ঈদ হবে সেদিন যেদিন আপনারা সকলে ঈদ উদযাপন করেন। আর আপনাদের ঈদুল আযহা হবে সেদিন যেদিন আপনারা সকলে পশু কোরবানী করেন।’’[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তিরমিযী এবং তিনি বলেছেন: হাদিসটি হাসান-গরীব, এটি আরও বর্ণনা করেছেন আবু দাউদ এবং ইবনে মাজাহ। তিনি শুধু ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। এবং ইমাম তিরমিযী আব্দুল্লাহ ইবনে জাফরের সূত্রে উসমান ইবনে মুহাম্মদ হতে, তিনি আলমাকবুরি হতে, তিনি আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “রোজা হল সেদিন যেদিন আপনারা সকলে রোজা পালন করেন। ঈদুল ফিতর (রোজা ভঙ্গের ঈদ) হল সেদিন যেদিন আপনারা সকলে রোজা ভঙ্গ করেন। আর ঈদুল আযহা হল সেদিন যেদিন আপনারা সকলে পশু কোরবানী করেন।’’ তিরমিযী বলেন: এই হাদিসটি হাসান-গরীব। তিনি আরো বলেন: ‘আলেমগণের মধ্যে অনেকে এই হাদিসটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন: এর অর্থ হল- রোজা শুরু করতে হবে ও ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে হবে সম্মিলিতভাবে, সকল মানুষের সাথে।” সমাপ্ত [মাজমূউল ফাতাওয়া (২৫/১১৪)]

 

তিনি আরও দলীল হিসেবে পেশ করেন যে, কেউ যদি জিলহজ্ব মাসের নতুন চাঁদ একাকী দেখে তবে আলেমগণের কেউ একথা বলেননি যে, (হজ্জ পালনের ক্ষেত্রে) সে একাকী আরাফাতে অবস্থান করবে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, এই মাসয়ালার মূলভিত্তি হচ্ছে- আল্লাহ তাআলা এই হুকুমকে নতুন চাঁদ ও মাসের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। তিনি বলেন:

( يسألونك عن الأهلة قل هي مواقيت للناس والحج )

“লোকেরা আপনাকে নতুন মাসের চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি তাদেরকে বলে দিন এটা মানুষের (বিভিন্ন কাজ-কর্মের) এবং হজ্জের সময় নির্ধারণ করার জন্য।”[২ সূরা আল-বাক্বারা:১৮৯] আয়াতে কারীমাতে আহিল্লাহ (أهلة) শব্দটি হিলাল  (هلال) শব্দের বহুবচন। হিলাল বলতে বুঝায়- যা দিয়ে কোন ঘোষণা দেয়া হয় বা কোন কিছু প্রচার করা হয়। তাই আকাশে যদি চাঁদ উদিত হয় আর মানুষ সে সম্পর্কে না জানে এবং তা দিয়ে মাস গণনা শুরু না করে তবে তো তা হিলাল হলো না। অনুরূপভাবে  شهر(শাহর বা মাস) শব্দটি شهرة (শুহরত বা প্রসিদ্ধি) শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সুতরাং মানুষের মাঝে যদি প্রসিদ্ধি না পায় তবে তো নতুন মাস শুরু হয়েছে বলে গণ্য করা হবে না। অনেক মানুষ এই  মাসয়ালাতে ভুল করেন এই ধারণার কারণে যে, তারা মনে করেন আকাশে নতুন চাঁদ উদিত হলেই তো তা মাসের প্রথম রাত্রি হিসেবে ধরা হবে- চাই সেটা মানুষের মাঝে প্রচার লাভ করুন অথবা না করুক, তারা এর দ্বারা নতুন মাস গণনা আরম্ভ করুক বা না করুক। কিন্তু ব্যাপারটি এমন নয়; বরং মানুষের কাছে নতুন চাঁদ প্রকাশিত হওয়া এবং এর দ্বারা তাদের নতুন মাস শুরু করা আবশ্যক। এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

( صومكم يوم تصومون ، وفطركم يوم تفطرون ، وأضحاكم يوم تضحون )

“আপনাদের রোজা হবে সেদিন যেদিন আপনারা সকলে রোজা পালন শুরু করেন। আপনাদের ঈদ হবে সেদিন যেদিন আপনারা সকলে রোজা ভঙ্গ করেন। আর আপনাদের ঈদুল আযহা হবে সেদিন যেদিন আপনারা সকলে পশু কোরবানী করেন।’’ অর্থাৎ যেদিনটিকে আপনারা রোজা পালন, ঈদুল ফিতর উদযাপন এবং ঈদুল আযহা উদযাপনের দিন হিসেবে জানতে পেরেছেন। আর যদি আপনারা তা না-জানতে পারেন তবে এ কারণে আপনাদের উপর কোন হুকুম বর্তাবে না।” সমাপ্ত [মাজমূল ফাতাওয়া (২৫/২০২)]

এই মতানুযায়ী ফতোয়া দিয়েছেন শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায [মাজমূ ফাতাওয়া আশ-শাইখ (১৫/৭২)]

وحديث : ( الصوم يوم تصومون…) صححه الألباني رحمه الله في صحيح سنن الترمذي برقم (561)

“রোজা হবে সেদিন যেদিন আপনারা সকলে রোজা পালন শুরু করেন…’’ হাদিসটিকে আলবানী সহীহ সুনানে তিরমিযি গ্রন্থে সহীহ বলে চিহ্নিত করেছেন (৫৬১)।

আরও দেখুন ফিকাহবিদগণের মতামত- আল মূগনী (৩/৪৭, ৪৯), আল মাজমূ (৬/২৯০), আল-মাওসুআ আল-ফিক্বহিয়্যাহ (১৮/২৮)]

আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব।।