যদি হিন্দুরা মুসলিমদেরকে ‘জয় শ্রীরাম’ ‘জয় হনুমান’ ইত্যাদি বাক্য বলতে বাধ্য করে তাহলে কী করণীয়

প্রশ্ন: আমি ইমানুদ্দিন। ইন্ডিয়া থেকে বলছি। আমার প্রশ্ন হল, নিশ্চয় আপনি বর্তমানে ভারতীয় মুসলিমদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত আছেন। যেখানে উগ্র হিন্দুরা মুসলিমদেরকে জোর পূর্বক ‘জয় শ্রীরাম, ‘জয় হনুমান’ ইত্যাদি কুফরি বাক্য বলতে বাধ্য করছে এবং না বলার জন্য তাদের মেরে ফেলা হচ্ছে (অবশ্য বলার পরও মেরে ফেলছে)!
এখন আমার প্রশ্ন বিপদ থেকে বাঁচার জন্য কি মুসলিমরা এই শব্দ মুখে নিতে পারবে বা এতে তারা ঈমান কি হারিয়ে ফেলবে?

উত্তর:
কারো অজানা নয় যে, বর্তমানে কতিপয় উগ্র সাম্প্রদায়িক এবং অসভ্য-বর্বর হিন্দু সংগঠন অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে প্রকাশ্যে মুসলিমদেরকে ‘জয় শ্রীরাম’, ‘জয় হনুমান’বলতে বাধ্য করছে। কোনো মুসলিম তাদের কথা না শুনলে অথবা তাদের কথা অনুযায়ী এ সব কুফুরি বাক্য উচ্চারণ করার পরও তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। কখনো মুসলিমদেরকে জোর করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে। গরু জবেহ করার অপরাধে (!) গণ পিটুতে মুসলিম হত্যা করা হচ্ছে, চলন্ত ট্রেন থেকে লাথি মেরে ফেলে দেয়া হচ্ছে, কোনো কোনো অসভ্য হিন্দু নেতা মুসলিম মা-বোনদেরকে গণধর্ষণ করার মত নির্লজ্জ আহ্বান জানাচ্ছে আবার কোনো কোনো অপরিনামদর্শী মূর্খ হিন্দু ধর্মগুরুর মুখ থেকে ভারতকে মুসলিম শুণ্য করার ধৃষ্টতাপূর্ণ বাণী শোনা যাচ্ছ…। এভাবে ভারতে প্রতিনিয়ত মুসলিমদের প্রতি জুলুম-অত্যাচারের সীমা অতিক্রম করছে।

গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী ভারতে এ সব ঘটনা বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ও বিশ্ব মিডিয়ায় বারবার প্রকাশিত হওয়ার পরও সরকার এ সকল হিন্দু জঙ্গিদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে বরং পুলিশ-প্রশাসন উল্টো জঙ্গিদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। এহেন ন্যক্কার জনক ঘটনার জন্য আমরা এ সকল অপরাধে জড়িত ব্যক্তি, সংগঠন এবং সন্ত্রাস লালন কারী প্রশাসনের প্রতি জানাচ্ছি ঘৃণা ও ধিক্কার। বহু ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও ভাষাভাষী মানুষের মিলন ভূমি ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি এ ধরণের জঘন্য অন্যায় আচরণ চরম লজ্জা জনক।
আমরা আশা করব, ভারত সরকার অনতিবিলম্বে এ সকল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করবে এবং সংখ্যালঘু মুসলিমদের সুরক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নিবে। অন্যথায় নির্যাতিত মুসলিমদের উত্থান ভারত সরকারের জন্য ভয়ানক অশনি সংকেত হিসেবে দেখা দিতে পারে।

যা হোক, উগ্র হিন্দুরা যদি মুসলিমদেরকে ‘জয় শ্রীরাম’, ‘জয় হনুমান’ ইত্যাদি বাক্য বলতে বাধ্য করে অর্থাৎ জোর করে এ সকল বাক্য উচ্চারণ করতে বলে আর না করলে জুলুম অত্যাচার করার আশঙ্কা করে তাহলে তাদের ক্ষয়-ক্ষতি ও জুলুম-অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য অন্তরে ঈমান ঠিক রেখে মুখে এ সকল বাক্য উচ্চারণ করায় কোনো আপত্তি নাই। এতে করে তার ঈমানে কোনো প্রভাব ফেলবে না ইনশাআল্লাহ।

🌀 এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন:
مَن كَفَرَ بِاللَّـهِ مِن بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَـٰكِن مَّن شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِّنَ اللَّـهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
“যার উপর জবরদস্তি করা হয় এবং তার অন্তর ঈমান (বিশ্বাস) এর উপর অটল থাকে সে ব্যতীত যে কেউ বিশ্বাসী হওয়ার পর আল্লাহতে অবিশ্বাসী হয় এবং কুফরির জন্য মন উন্মুক্ত করে দেয় তাদের উপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তাদের জন্যে রয়েছে শাস্তি।” (সূরা আন নহল: ১০৬)
তাফসীরকারকগণ বলেন, উক্ত আয়াতটি প্রখ্যাত সাহাবী আম্মার বিন ইয়াসার রা.কে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হয়।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
“মুশরিকরা একবার আম্মার বিন ইয়াসির রা. কে ধরেছিল এবং তারা জবরদস্তি করে তাদের দেবদেবীর প্রশংসা করতে এবং নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দিতে। তারা এমন বল প্রয়োগ করে যে, আম্মার বিন ইয়াসির রা. তাদের কথা অনুযায়ী কাজ করে। অতঃপর যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে আম্মার রা. সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন।
অত:পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন যে ‘তুমি মনের মধ্যে কেমন অনুভব করেছিলে’?
আম্মার রা. বললেন: ‘ঈমানের প্রতি আমার মনে পূর্ণ আস্থা ছিল’।
এতে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ‘যদি মুশরিকরা তোমাকে আবার এই রকম বলতে বলে তবে তুমি আবার বলো’। অতঃপর উপরোক্ত আয়াত নাজিল হল”। (তাফসিরে দুররুল মানসুর)

প্রখ্যাত তাফসীর বিদ আবু বকর আল জাসসাস বলেন:
هذا أصل في جواز إظهار كلمة الكفر في حال الإكراه
বাধ্যতামূলকভাবে কুফরি বাক্য উচ্চারণ জায়েয হওয়ার পক্ষে এই আয়াতটি মূল দলিল।“ (আহকামুল কুরআন ৩/১৯২)

🌀 হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
عُفِيَ لأمَّتي عن الخطأِ والنِّسيانِ وما استُكرِهوا عليهِ
“আমার উম্মতের হঠাৎ ঘটে যাওয়া ভুল, স্মরণ না থাকার কারণে ঘটে যাওয়া অন্যায় এবং জোরজবরদস্তি করে কৃত অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।” (ইবনে হাযম রা. রচিত আল মুহাল্লা, তিনি এটিকে সহীহ বলেছেন)

বিশিষ্ট মুফাসসির ইমাম বাগভি রহ. তার তাফসীর গ্রন্থে বলেন:
وأجمع العلماء على: أن من أكره على كلمة الكفر، يجوز له أن يقول بلسانه
“এটি আলেমদের সর্বসম্মত অভিমত যে, কাউকে যদি কুফরি কথা বলার জন্য জবরদস্তী করা হয় তার জন্য তা মুখে উচ্চারণ করা জায়েয।“ [তাফসীর বাগভি ( মা’আলিমুত তানযিল) ৫/৪৬]

ইবনে হজম তার ‘আল মুহালা গ্রন্থে বলেন:
سَمِعْت عَبْدَ اللَّهِ بْنَ مَسْعُودٍ يَقُولُ: مَا مِنْ ذِي سُلْطَانٍ يُرِيدُ أَنْ يُكَلِّفَنِي كَلاَمًا يَدْرَأُ عَنِّي سَوْطًا أَوْ سَوْطَيْنِ إِلاَّ كُنْت مُتَكَلِّمًا بِه
“আবদুল্লাহ ইবনে মাস’উদ বলেছেন:
“যদি সুলতান (শাসক) জবরদস্তী করে যে, আমি যদি এমন কিছু বলি যাতে আমাকে একটি বা দুটি বেত্রাঘাত থেকে ছাড় দেবে তবে আমি অবশ্যই আমি তা বলব।”। (আল মুহালা ৮/৩৩৬)

অবশ্য কোনো ব্যক্তি যদি মুশরিকদের দাবীর মুখেও ঈমানী দৃঢ়তার পরিচয় দেয় এবং কুফরী কথা উচ্চারণ থেকে বিরত থাকে- যার কারণে তাকে তারা হত্যা হয় তাহলে আশা করা যায়, সে আখিরাতে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবে।

তবে কেউ যদি জীবন বাঁচানোর স্বাার্থে অন্তরে আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস রেখে শুধু মুখে কুফরি বাক্য উচ্চারণ করে তাহলে তা জায়েয আছে-যেমনটি সাহাবী আম্মার বিন ইয়াসের রা. এর ঘটনা, এ প্রসঙ্গে অবতীর্ণ আয়াত এবং রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস (যেমনটি উপরে উল্লেখ করা হয়েছে) থেকে প্রমাণিত হয়।

পরিশেষে দুআ করি, মহান আল্লাহ তাআলা ভারত সহ পৃথিবীর সর্বত্র মুসলিমদেরকে সকল অন্যায়-অত্যাচার থেকে হেফাজত করুন। আল্লাহুম্মা আমীন।
▬▬▬💠🌀💠 ▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।।