“মৃত্যুর পর ভাই-বোনের আর কখনো দেখা হবে না” এমন একটি কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নিতান্তই ভিত্তিহীন ও দলিল বহির্ভূত কথা। কুরআন-হাদিসের এ কথার কোনও সত্যতা নেই। বিজ্ঞ আলেমগণ এমনটাই বলেছেন। নিম্নে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
✪ কুরআন-হাদিসের আলোকে কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে ভাইদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া সম্ভব। তবে তা জরুরি নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
فَإِذَا جَاءَتِ الصَّاخَّةُ -يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ – وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ – وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ – لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ
“অতঃপর যখন আসবে মহা শব্দকারী (বিকট আওয়াজ), যেদিন মানুষ পলায়ন করবে তার ভাইয়ের কাছ থেকে, তার মা ও বাবার কাছ থেকে এবং তার স্ত্রী ও তার সন্তানদের কাছ থেকে। সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন এক গুরুতর অবস্থা থাকবে যা তাকে অন্য সব কিছু থেকে উদাসীন করে দেবে।” [সূরা আবাসা: ৩৩-৩৭]। এই আয়াতগুলোতে কিয়ামতের দিনের ভয়াবহতার বর্ণনা করা হয়েছে। “الصَّاخَّةُ” (আস-সাখ্খাহ) বলতে কিয়ামতের সেই বিকট শব্দকে বোঝায় যা সব কিছুকে স্তব্ধ করে দেবে। সেই ভয়ংকর দিনে মানুষ এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত থাকবে যে, তারা তাদের সবচেয়ে প্রিয়জন, যেমন: ভাই-বোন, মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তানগণ দূরে পালাবে। কারণ সেদিন প্রত্যেকেই কেবল নিজের মুক্তির চিন্তায় মগ্ন থাকবে এবং নিজের আমল নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। অন্য কারো দিকে তাকানোর বা সাহায্য করার সুযোগ পাবে না। সেদিন প্রত্যেকের নিজস্ব এক গুরুতর চিন্তা ও ব্যস্ততা থাকবে যা তাকে অন্য সবকিছু থেকে উদাসীন করে দেবে।
আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেন না যে, সেদিন পালানো তখনই সম্ভব যখন সে তাকে চিনতে পারবে অথবা তার সাথে দেখা হবে।
মোটকথা, আখিরাতে ভাই-বোন, মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকেরই একে অপরের সাথে দেখা হবে এবং তা সবাই সবাইকে চিনতে পারবে কিন্তু ভয় ও আতঙ্কের কারণে কেউ কারও দিকে ফিরেও তাকাবে না বা সাহায্য করবে না।
এ ছাড়াও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
المَرْءُ مع مَن أحَبَّ
“(আখিরাতে) মানুষ থাকবে তার প্রিয়জনদের সঙ্গে।” [বুখারি, মুসলিম]। এ হাদিসের আলোকে বুঝা যায়, দুনিয়াতে যে যাকে ভালোবাসতো কিয়ামতের দিন সে তার সাথে অবস্থান করবে। ভাই-বোনও এ কথার অন্তর্ভূক্ত।
❑ জান্নাতে ভাইবোনদের সাক্ষাৎ সম্পর্কে ফতোয়া:
প্রশ্ন: জান্নাতে কি ভাইবোনেরা একে অপরের সাথে দেখা করতে পারবে? জাযাকাল্লাহু খাইরান-আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।
উত্তর: সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, এবং সালাত ও সালাম রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবায়ে কেরামের ওপর। অতঃপর: আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে মুমিনদেরকে তাদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সাথে একত্রিত করবেন। এটি তাদের জন্য একটি সম্মান এবং তাদের নিয়ামত বৃদ্ধির উপায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُونَهَا وَمَن صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ
অর্থ: “স্থায়ী জান্নাত, যাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে যারা সৎকর্ম শীল, তারাও তাদের সাথে প্রবেশ করবে।” [আর-রাদ: ২৩]। ইমাম ইবনে কাসির এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন: “অর্থাৎ জান্নাতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে তাদের প্রিয়জনদের–পিতা-মাতা, স্ত্রী এবং সন্তানদের–মধ্যে যারা জান্নাতে প্রবেশের যোগ্য, তাদের সাথে একত্রিত করবেন, যাতে তাদের চোখ জুড়িয়ে যায়। এমনকি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণায়, নিচের স্তরের ব্যক্তিকে উপরের স্তরের ব্যক্তির মর্যাদায় উন্নীত করা হবে, উপরের ব্যক্তির মর্যাদা কমানো ছাড়াই।” যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُم بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ
“আর যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের সন্তান-সন্ততি ঈমানের সাথে তাদের অনুসরণ করেছে, আমি তাদের সাথে তাদের সন্তান-সন্ততিকে একত্রিত করে দেবো।” [আত-তূর: ২১]। জালাল উদ্দিন সুয়ূতী রচিত “আদ-দুররুল মানসূর ফি তাফসীর বিল মা’ছূর” গ্রন্থে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আবু মিজলিজ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন: “আল্লাহ তাআলা জানতেন যে, মুমিন ব্যক্তি দুনিয়াতে তার পরিবার-পরিজনকে একত্রিত করতে ভালোবাসে। তাই তিনি আখেরাতেও তাদের জন্য একত্রিত করতে পছন্দ করেছেন।” আল্লাহু আলাম। আল্লাহই ভালো জানেন। [সোর্স: ইসলাম ওয়েব]।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতিয়মান হল যে, “মৃত্যুর পর ভাই-বোনের আর কখনো দেখা হবে না” প্রচলিত এ কথাটি সঠিক নয়। বরং যদি উভয়েই মুমিন হয় এবং জান্নাত লাভ করে তাহলে তারা জান্নাতে মিলিত হবে। তখন সম্পর্ক আরও সুন্দর হবে। কারণ সেখানে হিংসা, কষ্ট, ঝগড়া কিছুই থাকবে না। কিন্তু যদি তাদের একজন জান্নাতে আরেকজন জাহান্নামে যায় তখন আর দেখা নাও হতে পারে।
এমনকি হাশরের ময়দানেও বিচারের আগে তাদের মাঝে সাক্ষাত ঘটবে। কিন্তু তারা একে অপর থেকে পলায়ন করবে। অর্থাৎ ভাই-বোন কেউ কাউকে সাহায্য করবে না।
মোটকথা, কিয়ামতের দিন ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, মা-বাবা ইত্যাদি একে অপরকে চিনতে পারবে। কিন্তু বিচারফলের আগে সবাই নিজের চিন্তায় মগ্ন থাকবে। ভাই-বোন উভয়েই যদি জান্নাতে যায় তবে তারা দেখা-সাক্ষাত করবে, নানা ধরণের খোশ গল্প করবে এটাই মুমিনের জন্য চূড়ান্ত সুখ। তবে যদি একজন জান্নাতি আরেকজন জাহান্নামি হয় তখন দেখা হতেও পারে নাও পারে। তবে কুরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, জান্নাতবাসী ও জাহান্নামবাসীদের মাঝেও কখনো দেখা ও কথোপকথন হবে। ফলে জান্নাতবাসীদের আনন্দ এবং জাহান্নামিদের কষ্ট আরও বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।