মহান আল্লাহর আরশে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ লেখা থাকা সংক্রান্ত কোনও হাদিসই বিশুদ্ধ নয়

প্রশ্ন: আরশে লেখা আছে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু-মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।”-এ কথা কি সঠিক?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর:
এ বিষয়ে একাধিক হাদিস বলা হয়ে থাকে। তবে সেগুলো কোনটি সহিহ নয়। নিম্নে এ জাতীয় ৪টি হাদিস তুলে ধরে বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণের মতামতের আলোকে সেগুলোর মান সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল: وبالله التوفيق

◆ ১. নিম্নোক্ত হাদিসটি প্রসিদ্ধ:

لما اقترف آدم الخطيئة، قال: يا ربِّ، أسألك بحق محمَّد لَمَا غفرتَ لي، فقال الله: يا آدم، وكيف عرفت محمدًا ولم أخلقْه؟ قال: يا رب، لأنَّك لما خلقتني بيدك، ونفخت فيَّ من رُوحك، رفعت رأسي، فرأيت على قوائم العرش مكتوبًا: لا إله إلا الله، محمد رسول الله، فعلمت أنك لم تضِفْ إلى اسمك إلا أحبَّ الخلق إليك، فقال الله: صدقتَ يا آدم، إنه لأحب الخلق إلي، ادعني بحقِّه، فقد غفرت لك، ولولا محمَّد ما خلقتك

“আদম আ. যখন (নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে) ভুল করে ফেলেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন: হে আমার প্রতিপালক, আমি মুহাম্মাদের ওসিলা দিয়ে আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।
তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি কিভাবে মুহাম্মাদকে চিনলে? আমি তো এখনো তাঁকে সৃষ্টিই করি নি? তিনি বলেন, হে আমার রব, আপনি যখন নিজ হাতে আমাকে সৃষ্টি করেন এবং আমার মধ্যে আপনার রূহ ফুঁ দিয়ে প্রবেশ করান তখন আমি মাথা তুলে দেখলাম আরশের খুঁটি সমূহের উপর লিখা রয়েছে: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। এতে আমি জানতে পারলাম যে, আপনার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি বলেই আপনি আপনার নামের সাথে তাঁর নামকে সংযুক্ত করেছেন।

তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি ঠিকই বলেছ। তিনিই আমার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি। তুমি আমার কাছে তার ওসিলা দিয়ে চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। মুহাম্মদ না হলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না।’’[হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৭২]

❑ এ হাদিসটি বানোয়াট:

❂ এ হাদিসটিকে ইমাম হাকিম সহিহ বললেও একদল বিজ্ঞ মুহাদ্দিস তার সামালোচনা করে বলেছেন, সঠিক কথা হল, এটি বানোয়াট ও ভ্রান্ত হাদিস।

❂ ইমাম যাহাবি বলেন, এটি خبر باطل “এটি ভ্রান্ত হাদিস।” [মিযানুল ইতিদাল]
❂ ইবনে হাজার আসকালানি, ইমাম জাহাবির মতকে সমর্থন করেছেন। [লিসানুল মিযান]

এ হাদিসের বর্ণনা সূত্রে আব্দুর রহমান বিন যায়েদ (عبد الرحمن بن زيد) নামক একজন বর্ণনাকারী আছে। ইমাম হাকিম নিজেই তাকে তার আল মাদখাল (المدخل إلى معرفة الصحيح من السقيم) কিতাবে হাদিস বানানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। সুতরাং তা কীভাবে সহিহ হতে পারে? অত:এব ইমাম হাকেমের কথার মধ্যে বৈপরিত্য স্পষ্ট।
قال شيخ الإسلام ابن تيمية في “القاعدة الجليلة في التوسل والوسيلة” (ص 69) :
ورواية الحاكم لهذا الحديث مما أنكر عليه ، فإنه نفسه قد قال في كتاب “المدخل إلى معرفة الصحيح من السقيم” : عبد الرحمن بن زيد بن أسلم روى عن أبيه أحاديث موضوعة لا يخفى على من تأملها من أهل الصنعة أن الحمل فيها عليه ، قلت : وعبد الرحمن بن زيد بن أسلم ضعيف باتفاقهم يغلط كثيراً اهـ .
انظر سلسلة الأحاديث الضعيفة للألباني (1/38-47

❂ শাইখ আলবানি বলেন, এ হাদিসটি বানোয়াট। [সিলসিলা যাইফাহ/২৫]

—————

◆ ২. এ প্রসঙ্গে আরেকটি হাদিস বলা হয়। তা হল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
ليلةَ أُسري بي رأيتُ على العرشِ مكتوبًا : لا إلهَ إلَّا اللهُ محمَّدٌ رسولُ اللهِ ، أبو بكرٍ الصِّدِّيقُ ، عمرُ الفاروقُ ، عثمانُ ذو النُّورَيْن يُقتلُ مظلومًا

“মিরাজের রাতে আমি দেখলাম, আরশের গায়ে লেখা আছে,
لا إلهَ إلَّا اللهُ محمَّدٌ رسولُ اللهِ
“লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ-মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। আবু বকর সিদ্দিক, উমর ফারুক এবং উসমান যিন নুরাইন জুলুমের শিকার হয়ে শহিদি মৃত্যু বরণ করবে।”

❑ এ হাদিসটিও বানোয়াট:

❂ ইবনুল জাওযি তার বিখ্যাত বানোয়াট হাদিস সংকলন আল মাউযুআত (الموضوعات) শীর্ষক গ্রন্থে এ হাদিসটি উল্লেখ করার পর বলেন, لا يصح “সহিহ নয়।” [আল মাউযুআত ২/৯১]

❂ শাইখ আলবানি বলেন, “এটি বানোয়াট।” [সূত্র: সিলসিলা যইফাহ, হা/ ৫৬১৭]

—————-

◆৩. অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, যে মেরাজের রাতে আমি দেখলাম, আরশের পায়ায় (খুঁটিতে) লেখা আছে,
لا إلهَ إلا اللهُ محمَّدٌ رسولُ اللهِ، أبو بَكرٍ الصِّدِّيقُ، وعُمَرُ الفاروقُ، وعُثمانُ ذو النُّورينِ
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। আবু বকর সিদ্দিক, উমর ফারুক এবং উসমান যিন নুরাইন।”

❑ এ হাদিসটিও বানোয়াট:

❂ ইবনে আদী তার বিখ্যাত ‘আল কামিল ফিয যুয়াফা’ (الكامل في الضعفاء) গ্রন্থে এ সম্পর্কে বলেন, ليس بصحيح “সহিহ নয়।” [৬/৬৩]

❂ শাইখ আলবানি বলেন, “এ হাদিসটি মওযু বা বানোয়াট।” [সূত্র: সিলসিলা যইফা/২৫]
——————–

◆◆ ৪. এ মর্মে আরেকটি যইফ হাদিস আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর কথা হিসাবে হাকিম সংকলন করেছেন। তিনি জানদাল ইবনে ওয়ালিক-এর সূত্রে বলেন, তাকে আমর ইবনে আউস আনসারি নামক দ্বিতীয় শতকের এক ব্যক্তি বলেছেন, তাকে তাবি-তাবিয়ী সাঈদ ইবনে আবু আরূবাহ (১৫৭ হি.) বলেছেন, তাকে তাবিয়ী কাতাদা ইবনে দিআমাহ আস-সাদুসী (১১৫ হি.) বলেছেন, তাকে তাবিয়ী সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব (৯১ হি.) বলেছেন, তাকে ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন,

أَوْحَى اللهُ إِلَى عِيْسَى يَا عِيْسَى آَمِنْ بِمُحَمَّدٍ وَأْمُرْ مَنْ أَدْرَكَهُ مِنْ أُمَّتِكَ أَنْ يُؤْمِنُوْا بِهِ فَلَوْلاَ مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ آَدَمَ وَلَوْلاَ مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلاَ النَّارَ وَلَقَدْ خَلَقْتُ الْعَرْشَ عَلَى الْمَاءِ فَاضْطَرَبَ فَكَتَبْتُ عَلَيْهِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ فَسَكَنَ.
‘‘মহান আল্লাহ ঈসা আ. -এর প্রতি ওহী প্রেরণ করে বলেন, তুমি মুহাম্মাদের উপরে ঈমান আনয়ন কর এবং তোমার উম্মাতের যারা তাঁকে পাবে তাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নের নির্দেশ প্রদান কর। মুহাম্মাদ না হলে আদমকে সৃষ্টি করতাম না। মুহাম্মাদ না হলে জান্নাত ও জাহান্নামও সৃষ্টি করতাম না। আমি পানির উপরে আরশ সৃষ্টি করেছিলাম। তখন আরশ কাঁপতে শুরু করে। তখন আমি তার উপরে লিখলাম: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’; ফলে তা শান্ত হয়ে যায়।’’ [হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৭১।]

ইমাম হাকিম হাদিসটি উল্লেখ করে বলেন, হাদিসটির সনদ সহিহ। কিন্তু ইমাম যাহাবী প্রতিবাদ করে বলেন, ‘‘বরং হাদীসটি মাউযু (বানোয়াট) বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ এর একমাত্র বর্ণনাকারী এ ‘আমর ইবনে আউস আল-আনসারি’ নামক ব্যক্তি। সে প্রসিদ্ধ কয়েকজন মুহাদ্দিসের নামে হাদিসটি বর্ণনা করেছে। অথচ তাঁদের অন্য কোনও ছাত্র এ হাদিসটি তাঁদের থেকে বর্ণনা করে নি। এ লোকটি মূলত একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তার কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না। এ জানদাল ইবনে ওয়ালিক ছাড়া অন্য কোনও রাবী (বর্ণনাকারী) তার নাম বলেন নি বা তার কোনও পরিচয়ও জানা যায় না। এজন্য যাহাবি ও ইবনে হাজার আসকালানি বলেন, “এটি ইবনে আববাসের নামে বানানো জাল হাদিস। [যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/২৯৯; ইবনে হাজার, লিসানুল মীযান ৪/৩৫৪।]
এই অর্থবোধক আরও একাধিক জাল হাদিস মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন।
[hdith ও hadithbd-থেকে সংকলিত ও সামান্য পরিমার্জিত]

আল্লাহ আমাদেরকে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হাদিসের ব্যাপারে সচেতন হওয়ার তাওফিক দান করুন এবং ইসলাম সম্পর্কে সৃষ্ট সব ধরণের বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
▬▬▬🔹♦🔹▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।