বেনামাজি কি কাফের এবং তার কুরবানি কি বাতিল

বিংশ শতকের অন্যতম যুগশ্রেষ্ঠ ফকিহ আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ.-এর ফতোয়া এবং তার ব্যাখ্যা:

বেনামাজির কুরবানি প্রসঙ্গে শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ. বলেন,
فإذا أراد تارك الصلاة أن يضحي فعليه أن يتوب إلى الله أولاً من تركه الصلاة ، فإن لم يفعل وأصر على ما هو عليه ، فإنه لا يثاب على تلك الأضحية ، ولا تقبل منه ، وإذا تولى ذبحها بنفسه فهي ميتة ، لا يجوز الأكل منها ، لأن ذبيحة المرتد ميتة حرام

“অতএব যদি সালাত পরিত্যাগকারী কুরবানি করার ইচ্ছা পোষণ করে তাহলে তার উচিত হলো, সালাত পরিত্যাগ করার জন্য প্রথমত আল্লাহ তাআলার কাছে তওবা করা। যদি সে তওবা না করে এবং তার উপরেই সে অটল থাকে অর্থাৎ সালাত আদায় না করে তাহলে তার ওই কুরবানিতে নেকি হবে না এবং কুরবানি কবুলও হবে না। যদি সে সালাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজেই জবাই করে তাহলে তা হবে মৃত প্রাণির ন্যায়। আর মৃত প্রাণি খাওয়া হালাল নয়। কারণ মুরতাদ (ইসলাম থেকে বিচ্যুত) কর্তৃক জবাই করা গোশত খাওয়া হারাম।” [সৌদি আরবের ফতোয়া বিষয়ক রেডিও প্রোগ্রাম ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব, ৩২/১২৪]।

শাইখের সালাত পরিত্যাগ করার বিধান এবং তার কুরবানি বাতিল হওয়া সংক্রান্ত ফতোয়া অনেকেই ভুল বুঝেছেন। যার কারনে তারা শাইখের ফতোয়া উল্লেখ পূর্বক তার সঠিক ব্যাখ্যা ছাড়াই সালাত পরিত্যাগকারীকে কাফের-মুরতাদ এবং তার কুরবানি বাতিল বলে ফতোয়া দিচ্ছেন!

তাহলে আসুন, শাইখের ফতোয়ার সঠিক ব্যাখ্যা জানা যাক।

শাইখের এ ফতোয়াটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। তা হল, কুরবানি বাতিল হওয়া-না হওয়া নির্ভর করছে সালাত পরিত্যাগকারীর হুকুমের উপর যে, সে ইসলাম থেকে বহিস্কৃত কাফির-মুরতাদ কি না। যদি সে কাফের-মুরতাদ হয় তাহলে তার কুরবানি বাতিল।‌ আর কাফের-মুরতাদ না হলে বাতিল নয়।

মূলত তিনি ঐ সালাত পরিত্যাগকারীকে কাফের বলেছেন যে মোটেও সালাত পড়ে না। অর্থাৎ শাইখের মতে পরিপূর্ণভাবে সালাত পরিত্যাগকারী কাফের। সুতরাং এমন ব্যক্তি যদি কুরবানি দেয় তাহলে তার কুরবানি বাতিল‌ বলে গণ্য হবে এবং তার জবাই করা প্রাণির গোশত খাওয়াও জায়েজ নেই। কেননা সে মুসলিম নয়।
কিন্তু যে যে ব্যক্তি মাঝেমধ্যে সালাত আদায় করে আর মাঝেমধ্যে ছাড়ে তাকে তিনি কাফের বলেননি বরং ফাসেক (পাপিষ্ঠ) ও কবিরা গুনাহকারী বলেছেন। আর ফাসেক (পাপিষ্ঠ) ও কাবিরা গুনাহকারী ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত কাফের-মুরতাদ নয়। এটাই শাইখের ফতোয়ার সঠিক ব্যাখ্যা। সুতরাং তার জবাই কৃত পশুর গোশত খাওয়াকে হারাম বলা যাবে না।

প্রকৃতপক্ষে এটাই অধিক নির্ভরযোগ্য ও মধ্যমপন্থী অবস্থান।

▪️যে ব্যক্তি মাঝেমধ্যে সালাত পরিত্যাগ করে তার ব্যাপারে শাইখের ফতোয়া নিম্নরূপ:
الذي يظهر لي أنه لا يكفر إلا بالترك المطلق بحيث لا يصلي أبداً ، وأما من يصلي أحيانا فإنه لا يكفر لقول الرسول صلى الله عليه وسلم : ( بين الرجل وبين الشرك والكفر ترك الصلاة ) ولم يقل ترك صلاة ، بل قال : ” ترك الصلاة ” ، وهذا يقتضي أن يكون الترك المطلق ، وكذلك قال : ( العهد الذي بيننا وبينهم الصلاة فمن تركها ـ أي الصلاة ـ فقد كفر ) ، وبناء على هذا نقول : إن الذي يصلي أحيانا ويدع أحيانا ليس بكافر ” انتهى من “مجموع فتاوى ابن عثيمين ” ( 12 / 55 )
“আমার নিকট যেটা স্পষ্ট হয় তা হলো,‌ যে ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে সালাত পরিত্যাগ করে অর্থাৎ কখনোই সালাত আদায় করে‌ না কেবল তাকেই কাফের বলা যাবে। কিন্তু যে ব্যক্তি মাঝেমধ্যে সালাত পড়ে তাকে কাফের বলা যাবে না। কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
‏ إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلاَةِ
“বান্দা এবং শিরক ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সালাত পরিত্যাগ করা।” তিনি বলেননি যে, “এক ওয়াক্ত সালাত পরিত্যাগ করা করা” বরং বলেছেন, “সালাত পরিত্যাগ করা।” এ শব্দ প্রয়োগের দাবী হলো, পরিপূর্ণভাবে সালাত ত্যাগ করা। অনুরূপভাবে তিনি বলেছেন,
«العهد الذي بيننا وبينهم الصلاة فمن تركها فقد كفر»
“আমাদের ও তাদের (কাফেরদের) মধ্যে যে পার্থক্য হলো সালাত। অতএব, যে তা পরিত্যাগ করবে সে কুফুরি করবে।” এর উপর ভিত্তি করে আমরা বলব, যে ব্যক্তি মাঝেমধ্যে সালাত আদায় করে আর মাঝেমধ্যে ছাড়ে সে কাফের (ইসলাম থেকে পরিপূর্ণ বহিষ্কৃত কাফের-মুরতাদ) নয়।” [মাজমু ফাতাওয়া উসাইমিন ১২/৫৫]।

▪️তাকে আরো প্রশ্ন করা হয় যে, যে ব্যক্তি ফজর সালাতকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত বিলম্বিত করে তাকে কি কাফের হিসেবে গণ্য করা যাবে?

তিনি উত্তরে বলেন,
هذا لا يكفر لأنه لم يترك الصلاة لكن تهاون بها ولا يحل له أن يفعل ذلك
“তাকে কাফের বলা যাবে না। কারণ সে সালাত পরিত্যাগ করেনি। বরং সালাতে অবহেলা করেছে। এমনটি করা তার জন্য বৈধ নয়।” [ফাতাওয়া উসাইমিন ১২/৩১]

▪️অন্যত্র তিনি সালাত পরিত্যাগ কারী কাফের কিনা এ বিষয়ে দলিল ভিত্তিক আলোচনা করতে গিয়ে বলেন,
الأصل بقاء الإسلام ، فلا نخرجه منه إلا بيقين ؛ لأن ما ثبت بيقين لا يرتفع إلا بيقين ” انتهى من ” الشرح الممتع لابن عثيمين ” ( 2 / 27 – 28 ) .
“মূল হচ্ছে ইসলাম অবশিষ্ট থাকা। আমরা সুনিশ্চিত প্রমাণ ছাড়া তাকে ইসলাম থেকে বের করব না। কেননা যা সুনিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে সুনিশ্চিত প্রমাণ ছাড়া তা উঠবে না।” [শারহুল মুমতাজ ২/২৭-২৮]।

উল্লেখ্য যে, শাইখ আলবানি রাহ. যে সব হাদিসে সালাত পরিত্যাগ করাকে কুফরি বলা হয়েছে সেগুলোকে কর্মগত কুফরি (ছোট কুফরি) হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন (বিশ্বাসগত বা কুফরি বড় নয়)। যেমন: গাইরুল্লাহর নামে কসম খাওয়া, কোনও মুসলিমের সাথে লড়াই করা, মনিব থেকে গোলামের পলায়ন করা ইত্যাদি বিষয়কে হাদিসে কুফরি বলা হয়েছে। কিন্তু এগুলো বিশ্বাসগত (বড়) কুফরি নয় বরং কর্মগত (ছোট) কুফরি) যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না। সালাতের বিষয়টিও অনুরূপ। তবে সালাত পরিত্যাগ করার বিষয়টি আরো ভয়ানক। এর ফলে বড় কুফরিতে পতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাঁর মতে সালাত পরিত্যাগ করাকে হালাল মনে না করলে বা সালাতকে অস্বীকার না করলে তাকে ইসলাম থেকে বহিস্কৃকত কাফের-মুরতাদ বলা যাবে না।” [শাইখের ফতোয়ার সারসংক্ষেপ]
মূলত এটি ইসলামের সাধারণ মূলনীতির আলোকে খুবই যৌক্তিক ও চমৎকার ব্যাখ্যা।
তবে অনেক আলেমের মতে, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে এক ওয়াক্ত সালাত পরিত্যাগ করে তারা ইসলামের গণ্ডি থেকে বহিষ্কৃত কাফের-মুরতাদ। কিন্তু দলিলের আলোকে আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন এবং শায়খ আলবানির অভিমত অধিক শক্তিশালী বলে বিবেচিত হয়। আল্লাহু আলম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।