বিয়ে বিচ্ছেদ হওয়ায় আল্লাহর প্রতি এক নারীর আক্ষেপ এবং তার প্রতি উপদেশ ও দিকনির্দেশনা

প্রশ্ন: আমার আপুর স্বামী আর শাশুড়ি খারাপ মানুষ হওয়ায় ছয় মাস আগে ডিভোর্স হয়। চলতি মাসে আমারও ডিভোর্স হয়। কারণ আমার মধ্যে শুচিবায়ু রোগ থাকায় তারা আমাকে ‘পাগল’ বলে আখ্যা দেয়! এখন লোকজন আমাকে অনেক খারাপ ও নিচুমানের কথাবার্তা বলছে। দু বোনের জন্য মা-বাবাও অসুস্থ হয়ে গেছে। আমার প্রশ্ন হলো, আল্লাহ কি আছেন? আল্লাহ থাকলে সাহায্য করছেন না কেন? বিয়ে যদি আল্লাহর হুকুমে হয় তাহলে বিয়ে ভঙ্গ হওয়াটা আল্লাহ আটকাতে পারেননি কেন? আমাদেরতো কেউ বিয়ে করবে না। এখন কী করবো? সমাজের কেউ কথা বলছে না। আপনজনরা অনেক অপমান করছে। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করছেন না কেন?

উত্তর: আমরা আপনাদের দুই ডিভোর্সি বোনের জন্য অনেক অনেক সমবেদনা জানাচ্ছি এবং দুআ করছি, তিনি যেন আপনাদেরকে ধৈর্য ধারণের তাওফিক দেন ও কল্যাণের উপরে মৃত্যু অবধি প্রতিষ্ঠিত রাখেন। আমিন।

অতঃপর আপনাদের বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটেছে এ জন্য ‘আল্লাহ আছেন কিনা’ এমন সংশয় প্রকাশ করা কি কোন ইমানদারের জন্য শোভনীয়? পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার বিয়ে বিচ্ছেদ হচ্ছে। অতীতেও হয়েছে।‌ ভবিষ্যতেও হবে। এসবের পেছনে অবশ্যই কিছু কারণ থাকে। সেজন্য কি আল্লাহকে দোষারোপ করা যায়?

▪️ মানুষের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহর বাণী:

মানুষকে আল্লাহ কত চমৎকার দেহবায়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন! অতঃপর তাকে খাদ্য-পানীয় ও আলো-বাতাস ও অসংখ্য-অগণিত নেয়ামত দ্বারা প্রতিপালন করেছেন।‌ তাঁর অবাধ্যতা করার পরেও তিনি বান্দার অসংখ্য পাপাচার ক্ষমা করে দেন‌ এবং তাকে দয়া ও মমতা দিয়ে পরিবেষ্টন করে রাখেন। তারপরেও মানুষ ‌নিজেদের কৃতকর্মকে আল্লাহর দোষ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়! এর থেকে বড় অকৃতজ্ঞতা ও ধৃষ্টতা আর কী হতে পারে?

আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَأَمَّا ٱلۡإِنسَٰنُ إِذَا مَا ٱبۡتَلَىٰهُ رَبُّهُۥ فَأَكۡرَمَهُۥ وَنَعَّمَهُۥ فَيَقُولُ رَبِّيٓ أَكۡرَمَنِ وَأَمَّآ إِذَا مَا ٱبۡتَلَىٰهُ فَقَدَرَ عَلَيۡهِ رِزۡقَهُۥ فَيَقُولُ رَبِّيٓ أَهَٰنَنِ

“মানুষ তো এরূপ যে, তার রব যখন তাকে পরীক্ষা করেন এবং সম্মান ও অনুগ্রহ দান করে তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন।‌ আর যখন তাকে পরীক্ষা করেন এবং তার রিজিক সংকুচিত করেন তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে হীন করেছেন!” [সূরা আল ফজর: ১৫ ও ১৬]

তিনি আরো বলেন,

إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ خُلِقَ هَلُوعًا- إِذَا مَسَّهُ ٱلشَّرُّ جَزُوعٗا – وَإِذَا مَسَّهُ ٱلۡخَيۡرُ مَنُوعًا

“নিশ্চয় মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে অতিশয় অস্থিরচিত্তরূপে। যখন বিপদ তাকে স্পর্শ করে সে হয় হা-হুতাশকারী। আর যখন কল্যাণ তাকে স্পর্শ করে সে হয় অতি কৃপণ।” [সূরা মাআরিজ ১৯, ২০, ২১]

▪️এখন করণীয়:

মনে রাখতে হবে, বিয়ে করা যেমন আল্লাহর হুকুম তেমনি উভয় পক্ষের মিলমিশ না হলে ডিভোর্স দেওয়াও আল্লাহর বিধান। সুতরাং কেউ যদি আল্লাহর বিধান মেনে শরিয়তসম্মত কারণে ডিভোর্স দেয় তাহলে তো কোন সমস্যা নেই। কিন্তু যদি জুলুম করে তবে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই জালিমের বিচার করবেন। নিশ্চয়ই তিনি সব চেয়ে বড় ন্যায়বিচারক। আপনাদের পূর্ব স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন থাকলে হয়তোবা আপনাদের জীবনের জন্য আরও বড় ক্ষতির কারণ হতো। আপনারা আরও বড় ফিতনায় পতিত হতেন। সে কারণে আল্লাহ আপনাদেরকে সেখান থেকে রক্ষা করেছেন এবং আপনাদের জন্য যা কল্যাণকর তিনি তাই করবেন ইনশাআল্লাহ। প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহর পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা কেউই অবহিত নই।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَن تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

“আর তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয় অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না। [সূরা বাকারা: ২১৬]

ভুলে গেলে চলবে না যে, মানব জীবনের ভালো-মন্দ সব কিছু‌ আল্লাহর তকদিরের ভিত্তিতে সংঘটিত হয়-এর উপরে বিশ্বাস করা ঈমানের ছয়টি রোকন বা স্তম্ভের একটি। সুতরাং আল্লাহর ফায়সালার উপর বিশ্বাস রাখা এবং তাতে একজন মুক্তিকামী মুসলিমের জন্য আবশ্যক। তাই আপনাদের দুঃখজনক এই পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করুন। ধৈর্যের মধ্যেই মানুষের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

عَجَباً لأمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ لَهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَلِكَ لأِحَدٍ إِلاَّ للْمُؤْمِن: إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْراً لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خيْراً لَهُ.
“ইমানদারের বিষয়টি বিস্ময়কর। তার সবকিছুই তার জন্য কল্যাণকর। মুমিন ব্যতিত অন্য কারো জন্য এমনটি নেই। সে সুখকর কিছু লাভ করলে শুকরিয়া আদায় করে যা তার জন্য কল্যাণকর। আর বেদনাদায়ক কিছু ঘটলে ধৈর্য ধারণ করে। এটাও তার জন্য কল্যাণকর।” [সহিহ মুসলিম অধ্যায়: ৫৬/ যুহুদ ও দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণহীনতা সম্পর্কিত বর্ণনা, পরিচ্ছেদ: ১২. মুমিন ব্যক্তি একই গর্তে দু বার দংশিত হয় না]

বিপদে ধৈর্য হারাবেন না, হতাশ হবেন না, সাহস হারাবেন না। মুমিন কখনো হতাশ হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَا۟یۡـَٔسُوا۟ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ لَا یَا۟یۡـَٔسُ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡقَوۡمُ ٱلۡكَـٰفِرُونَ

“এবং আল্লাহর রহমত হতে তোমরা নিরাশ হয়ো না। কারণ আল্লাহর রহমত হতে কেউই নিরাশ হয় না, কাফির সম্প্রদায় ছাড়া। [সূরা ইউসুফ: ৮৬]

ইমানদার ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য হলো, সে সর্বাবস্থায় আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকে এবং তাঁর প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হয় এবং নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে। এ ভাবে সে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে এগিয়ে যায়। আল্লাহ তৌফিক দান করুন। আমিন।

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।