বাচ্চাদের মুখে ভাত দেওয়ার অনুষ্ঠান/অন্নপ্রাশন করা কি জায়েজ

প্রশ্ন: বাচ্চাদের যে মুখে ভাত দেওয়ার অনুষ্ঠান করা হয়। এটা কি জায়েজ?
উত্তর: শিশুর প্রথম ভাত খাওয়ার অনুষ্ঠানকে বলা হয় ‘অন্নপ্রাশন’।
এই অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানটি নিছক সামাজিক অনুষ্ঠান নয় বরং তা হিন্দুয়ানী রীতি-নীতি ও কালচারের সাথে সম্পৃক্ত। হিন্দু পরিবারগুলিতে পরম্পরাগত ভাবে অনুষ্ঠানটি উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষে একটি বড় জায়গায় বিরাট ভোজের আয়োজন করা হয় এবং অনুষ্ঠানটির জন্য একটা শুভক্ষণ বেছে নিয়ে পুরোহিতরা উপস্থিত থেকে অন্নপ্রাশনের মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন।
তাছাড়াও এ অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছে কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস ও কুসংস্কার। বিধায় তা পালন করা মুসলিমদের জন্য বৈধ নয়।
নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হল: [banglaparenting.firstcry ওয়েব সাইটে প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে:]
শিশুদের সাধারণত ছয় মাস বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানো হয়ে থাকে এবং এই সময়ের পর থেকে তাদের ধীরে ধীরে শক্ত খাবার দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।এটি এমন একটি সন্ধিক্ষণ যা স্মরণীয় করা রাখতে হিন্দু পরিবারগুলিতে পরম্পরাগত ভাবে এটিকে অন্নপ্রাশন নামক অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে উদযাপন করা হয়।
❑ অন্নপ্রাশন কি?
অন্নপ্রাশন হল হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত একটি জনপ্রিয় প্রথা।আক্ষরিক ভাবে এর অর্থ হল ‘প্রথম ভাত খাওয়া শুরু করা‘,এর মধ্য দিয়ে একটি শিশুকে শুধুমাত্র তরল খাদ্য থেকে কঠিন খাদ্য দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানটি সারা ভারতব্যাপী প্রচলিত,পশ্চিমবঙ্গে এটি মুখে ভাত, কেরলায় চরু,এবং হিমাচল প্রদেশের গাড়োয়াল অঞ্চলে ভাত খাওয়াই নামে পরিচিত।এই অনুষ্ঠানের পরবর্তীকাল থেকে বাচ্চাদের বুকের দুধ ছাড়িয়ে তাদের শুধুমাত্র শক্ত খাদ্য গ্রহণ অভ্যাস করানো শুরু করা হয়।
❑ অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানটি কেন পালন করা হয়?
অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানটি শিশুর বৃদ্ধির পরবর্তী ধাপকে সূচিত করে।যদি বৈদিক যুগে ফিরে যাওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে যে অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানটি তখন সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া, ইরান,এমনকি পারস্যের মানুষজনেরাও পালন করতেন।অভিভাবকদের সংস্কৃতি এবং তাদের বাসস্থানের ভৌগলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে এই অনুষ্ঠানটি শিশুদের পাঁচ থেকে নয় মাস বয়সের মধ্যে কোন না কোন সময়ে পালন করা যেতে পারে। ঐতিহ্য অনুযায়ী সাধারণত চার মাসের কম বা এক বছরের বেশি বয়সের শিশুদের অন্নপ্রাশন করা হয় না।এই অনুষ্ঠানের গুরুত্ব এতই বেশি যে সকল আত্মীয় স্বজনরা আমন্ত্রিত হন,যেখানে একটি বড় জায়গায় বিরাট ভোজের আয়োজন করা হয় এবং অনুষ্ঠানটির জন্য একটা শুভক্ষণ বেছে নিয়ে পুরোহিতরা উপস্থিত থেকে অন্নপ্রাশনের মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন।
❑ শিশুর প্রথম ভাত খাওয়ার অনুষ্ঠানটি কোথায় সম্পাদন করা হয়?
প্রথমদিকে অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানটি বাড়িতেই সম্পাদন করা হত।তবে এখনকার দিনে,মানুষ এই অনুষ্ঠানটির জন্য সাধারণত একটি ব্যাঙ্কোয়েট বা পার্টি দেওয়ার হলের মত কোনও বড় জায়গা ভাড়া নেওয়া পছন্দ করেন।পারিবারিক বিগ্রহের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য এই অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানটি আবার কোনও মন্দিরেও সম্পাদন করা যেতে পারে।এটি সাধারণত এক দিনের অনুষ্ঠান তবে বাচ্চার মা–বাবা যদি নানান ধরনের আনন্দ–মজা এবং খেলাধুলা যোগ করে অনুষ্ঠানটিকে আরও স্মরণীয় করে তুলতে তার বিস্তৃত উদযাপন করতে চান তবে সেটি একদিনের জায়গায় সম্প্রসারিত করে দু‘দিন করা যেতেই পারে।
❑ অন্নপ্রাশন বিধি:
অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান প্রক্রিয়াটির সূচনা করা হয় সাধারণত বাচ্চাকে তার মামার কোলের উপরে বসিয়ে দিয়ে,যিনি সম্ভবত বাচ্চার মুখে প্রথম ভাত তুলে দিয়ে তার তরল থেকে শক্ত খাবার খাওয়ার প্রক্রিয়াটির সূত্রপাত করে থাকেন।প্রথম পরিবেশনটি শিশুর মুখে দেওয়ার পর পরিবারের অন্যান্য সকলে একে একে বাচ্চার মুখে আরও খাবার তুলে দিয়ে উপহার সহযোগে তাকে আশীর্বাদ করে থাকেন।অবশেষে অন্নপ্রাশনের বিধিগুলি পালন করা হয়। বেশ কিছু জিনিস যেমন মাটির দলা,সোনার গয়না,পেন,বই এবং খাদ্য সামগ্রী বাচ্চার সামনে রাখা হয় এবং সেগুলির থেকে যেকোনো একটিকে বাচ্চাকে বেছে নিতে হয়।যদিও অবোধ শিশুর কোনও কিছুই বেছে নেওয়ার মত ক্ষমতা থাকে না তথাপি অজান্তেই সে যা কিছুই খাবলে তুলে ধরে তার উপর ভিত্তি করে তার ভবিষ্যৎ পথের ইঙ্গিতকে অর্থ করা হয়।
– যদি শিশু সোনার গয়না তুলে ধরে তার অর্থ হল সে ধনশালী হয়ে উঠবে।
– যদি সে পেন তোলে তার মানে সে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি হবে।
– আর যদি বই বেছে নেয় সেক্ষেত্রে সে শিক্ষিত হয়ে উঠবে।
– যদি সে মাটিকে স্পর্শ করে তবে সে ধন সম্পত্তির ব্যাপারে ভাগ্য শালী।
– খাবার বেছে নেওয়ার অর্থ হল সে ভবিষ্যতে একজন সহানুভূতিশীল এবং
– দয়ালু ব্যক্তিতে পরিণত হবে। (banglaparenting.firstcry)
সুতরাং উপরের আলোচনা থেকে প্রতিভাত হল যে, বাচ্চাদের ভাত খাওয়া বা অন্নপ্রশান নামক অনুষ্ঠানটি হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি এবং নানা কুসংস্কার পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত। তাই কোনও মুসলিমের জন্য তা পালন করা বৈধ নয়।
কোন মুসলিম যদি হিন্দুয়ানী কার্যক্রমগুলো বাদ দিয়েও এমন অনুষ্ঠান করে তবু তা বৈধ হবে না। কারণ এতে অমুসলিমদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়। অথচ হাদিসে এ ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
“যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য হবে।” [আবু দাউদ, সহীহুল জামি’ ৬১৪৯, ইরওয়া ২৬৯১]
❑ ইসলামি নিয়ম নবজাতক শিশুর মুখে তাহনিক করা:
❖ আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يُؤْتَى بِالصِّبْيَانِ فَيُبَرِّكُ عَلَيْهِمْ وَيُحَنِّكُهُمْ ‏‏
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খিদমতে (নবজাতক) শিশুদের নিয়ে আসা হতো। তিনি তাদের জন্য বরকতের দুআ করতেন এবং তাহনিক করে (খেজুর চিবিয়ে তাদের মুখে) দিতেন। [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]
❖ আনাস রা. বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আবু তালহা ভূমিষ্ঠ হলে আমি তাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে গেলাম, তিনি বললেন,
أَمَعَكَ شَيْءٌ ؟ قُلْتُ تَمَرَاتُ عَجْوَةٍ . فَأَخَذَ بَعْضَهُنَّ فَمَضَغَهُنَّ ثُمَّ جَمَعَ بُزَاقَهُ فَأَوْجَرَهُ إِيَّاهُ ، فَجَعَلَ يَتَلَمَّظُ فَقَالَ : حُبُّ الْأَنْصَارِ التَّمْرَ
তোমার সঙ্গে কি খেজুর আছে?
আমি বললাম: হ্যাঁ, কয়েকটা আজওয়া খেজুর আছে।
অত:পর তিন কিছু খেজুর চিবালেন। অতঃপর তা বের করে বাচ্চার মুখে দিলেন। বাচ্চাটি জিহ্বা দিয়ে চুষে চুষে ও ঠোটে লেগে থাকা অংশ চেটে খেতে লাগল।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দৃশ্য দেখে বললেন, দেখ! আনসারদের খেজুর কত প্রিয়!” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]
❖ আবু মুসা রা. বলেন, আমার এক সন্তানের জন্ম হলে, আমি তাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে যাই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নাম রাখেন ইবরাহিম। অতঃপর খেজুর দিয়ে তাহনিক করেন, তার জন্য বরকতের দোয়া করেন এবং আমার কাছে ফিরিয়ে দেন।’ [বুখারি ও মুসলিম]
যদিও অনেক আলেম মনে করেন, এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য খাস। অর্থাৎ তাঁর পবিত্র থুথু দ্বার বরকত গ্রহণের উদ্দেশ্যে এমনটি করা হত। তবে অধিকাংশ আলেমের মতে তা তাঁর জন্য খাস নয়। বরং বর্তমান যুগেও নবজাতক শিশুর মুখে তার বাবা, মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাই-বোন যে কেউ তাহনিক করতে পারে।
সুতরাং হিন্দুয়ানী প্রথায় অন্নপ্রশান পালন বর্জন করা জরুরি। এর পরিবর্তে নবজাতক শিশুর মুখে তাহনিক তথা খেজুর, মধু বা মিষ্টান্ন দ্রব্য দ্রব্য দেয়া উত্তম। আল্লাহ তাআলা আমাদের অমুসলিমদের সংস্কৃতি ও রীতি-নীতি অনুসরণ এবং সাদৃশ্য অবলম্বন থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।