ফিতনা-ফ্যাসাদের সময় নির্জনতা অবলম্বনের গুরুত্ব এবং অদূর ভবিষ্যতে ছাগল হবে মুসলিমের উত্তম সম্পদ এ হাদিসের ব্যাখ্যা

প্রশ্ন: একটি হাদিসে এসেছে, “অদূর ভবিষ্যতে ছাগল হবে মুসলিমের উত্তম সম্পদ।” এই হাদিসটিতে কী বুঝানো হয়েছে?
উত্তর:
এটি ফিতনা-ফ্যাসাদের সময় লোকালয় থেকে দূরে কোথাও নির্জনতা অবলম্বন করা প্রসঙ্গে হাদিস। এ বিষয়ে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন:

◉ আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে,
يُوشِكُ أَنْ يَكُونَ خَيْرَ مَالِ الْمُسْلِمِ غَنَمٌ يَتْبَعُ بِهَا شَعَفَ الْجِبَالِ وَمَوَاقِعَ الْقَطْرِ، يَفِرُّ بِدِينِهِ مِنَ الْفِتَنِ
“অদূর ভবিষ্যতে ছাগল হবে মুসলিমের উত্তম সম্পদ। সে ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে নিজের দীন রক্ষার্থে তা নিয়ে পর্বতের চূড়া অথবা উপত্যকায় পলায়ন করবে।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ২/ ঈমান, পরিচ্ছেদ: ১২/ ফিতনা থেকে পলায়ন দ্বীনের অংশ]

◈ শাইখ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল উসাইমিন রহ. বলেন, “ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে নিজের দীন রক্ষার্থে তা নিয়ে পর্বতের চূড়া অথবা উপত্যকায় পলায়ন করবে।” এ কথার ব্যাখ্যায় বলেন, “ঈমানদার ব্যক্তি যখন গ্রাম ও শহরগুলোতে নিজের দীনের ব্যাপারে ভয় করবে তখন ফিতনা থেকে বাঁচতে তার ছাগল নিয়ে পাহাড়ের চূড়া এবং বৃষ্টির স্থান (উপত্যকা, মরুভূমি, সমতল ভূমি, বাগ-বাগিচা ইত্যাদি) স্থানে চলে যাবে।”

◈ তিনি আরও বলেন, “এমনটি ঘটেছে। যখন আলি রা. ও মুয়াবিয়া রা. এবং তৎপরবর্তী সময় বিভিন্ন ফিতনা-ফ্যাসাদ সংঘটিত হয়েছিল তখন কিছু মানুষ এ সব ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে দূরে সরে নির্জন স্থানে চলে গিয়েছিল।” [alathar]

◉ ফিতনা-ফ্যাসাদের সময় নির্জনতা অবলম্বন প্রসঙ্গে আরেকটি হাদিস:

সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত। এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বলল, সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বললেন,
رَجُلٌ يُجَاهِدُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِمَالِهِ وَنَفْسِهِ
“সে মুমিন যে তার জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে।”
সে ব্যক্তি বলল, তারপর কে?
তিনি বললেন,
‏ مُؤْمِنٌ فِي شِعْبٍ مِنَ الشِّعَابِ يَعْبُدُ اللَّهَ رَبَّهُ وَيَدَعُ النَّاسَ مِنْ شَرِّهِ
“যে মুমিন কোন পাহাড়ি উপত্যকায় নির্জনে বসে তার প্রতিপালকের ইবাদত করে এবং স্বীয় অনিষ্ট থেকে লোকজনকে রক্ষা করে।” [সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ৩৪। প্রশাসন ও নেতৃত্ব, পরিচ্ছেদ: ৩৪. জিহাদ ও রিবাত (শত্রুর মুকাবিলায় বিনিদ্র প্রহরা) এর ফজিলত]

❑ ব্যখ্যা:

◍ ইমাম নওবী এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন,
وَلَيْسَ الْمُرَاد نَفْس الشِّعْب خُصُوصًا ; بَلْ الْمُرَاد الانْفِرَاد وَالاعْتِزَال , وَذَكَرَ الشِّعْب مِثَالا لأَنَّهُ خَالٍ عَنْ النَّاس غَالِبًا اهـ
“এখানে ‘পাহাড়ি উপত্যকা’ দ্বারা নির্দিষ্টভাবে তা উদ্দেশ্য নয় বরং উদ্দেশ্য হল, একাকীত্ব ও নির্জনতা অবলম্বন। পাহাড়ি উপত্যকা উল্লেখ করেছেন উদাহরণ হিসেবে। কারণ তা সাধারণত: জন মানবহীন হয়ে থাকে।” [শারহু সহিহ মুসলিম, ১৩/৩৪]

◍ ইবনে হাজার আসকালানি বলেন,
وَالْخَبَر دَالّ عَلَى فَضِيلَة الْعُزْلَة لِمَنْ خَافَ عَلَى دِينه
“এ হাদিস প্রমাণ করে যে, যে ব্যক্তি তার দীনের বিষয়ে ফিতনায় পতিত হওয়ার আশঙ্কা করে তার জন্য নির্জনতা অবলম্বন করা উত্তম।” [ফাতহুল বারী ১৩/৪২]

◍ সিন্দি বলেন,
فِيهِ أَنَّهُ يَجُوز الْعُزْلَة بَلْ هِيَ أَفْضلُ أَيَّام الْفِتَن
“ফিতনার সময় নির্জনতা অবলম্বন করা শুধু জায়েজ নয় বরং উত্তম।” [হাশিয়ায়ে নাসাঈ, ৮/১২৪]

❑ কেমন ফিতনা-ফ্যাসাদের সময় নির্জনতা অবলম্বন করা উচিৎ এবং কখন উচিৎ নয়?

জুমহুর আলেমদের মতে, চতুর্দিকে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ফিতনা-ফ্যাসাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে পরিস্থিতি যদি এমন জটিল আকার ধারণ করে যে, মানুষের জন্য হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করতে অপারগ হওয়ার কারণে দীনের উপর টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে যায় তখন সব কিছু ছেড়ে নির্জনে গিয়ে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে আত্মনিয়োগ করতে হবে। এভাবে সে ফিতনা থেকে রক্ষা পাবে এবং দীনকে হেফাজত করতে পারবে।

কিন্তু পরিস্থিতি যদি এতটা জটিল না হয় বরং সমাজে দীনের জ্ঞান চর্চার ব্যবস্থা থাকে, মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে, মসজিদে মসজিদে জুমা ও জামাতে সালাত প্রতিষ্ঠিত হয়, ঈদের সালাত কায়েম হয়, মাদরাসা-মসজিদগুলো আবাদ থাকে, দাওয়াতি কার্যক্রম চালু থাকে, মানুষ আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করার সুযোগ পায়, সমাজে পাপাচার থাকলেও চেষ্টা করলে অনেক পাপ থেকে বাঁচা সম্ভব হয় তাহলে এমন পরিস্থিতিতে সমাজে বসবাস করা উত্তম। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

‏ إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا كَانَ مُخَالِطًا النَّاسَ وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ خَيْرٌ مِنَ الْمُسْلِمِ الَّذِي لاَ يُخَالِطُ النَّاسَ وَلاَ يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ

“মুসলিমদের মাঝে যে ব্যক্তি লোকজনের সাথে মেশে না এবং তাদের পক্ষ থেকে কষ্টদায়ক আচরণে ধৈর্য ধারণ করে না তার চেয়ে উত্তম হল ঐ ব্যক্তি, যে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে এবং তাদের কষ্টদায়ক আচরণে ধৈর্য ধারণ করে।” [সহীহ, ইবনে মাজাহ ৪০৩২, তিরমিজী, হা/ ২৫০]

এর ফলে সমাজে দীনের দাওয়াত অব্যাহত রাখা, মানুষকে কল্যাণের পথ দেখানো, সমাজ থেকে অন্যায় দুরীকরণে অবদান রাখা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ, অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, ঈমানদারের মৃত্যুতে তার জানাজায় অংশ গ্রহণ, রোগীর সেবা-শুশ্রূষা, ঈদ, জুমা ও জামাতে সালাত প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে অবারিত সওয়াব লাভ করা সম্ভব হবে।

ইমাম নওবি রাহ. বলেন, “নবীগণ এবং অধিকাংশ সাহাবি, তাবেঈ, আলেম এবং যাহেদগণ মানুষের সাথে মিশতেন।” [শরহে মুসলিম]

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সব ধরণের ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে রক্ষা করুন এবং আমরণ ইসলামের উপর টিকে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।