ফতোয়া কী এবং ফতোয়া কার কাছ থেকে নেওয়া যাবে আর আর কাছ থেকে নেওয়া যাবে না

ফতোয়া কী? ফতোয়া কার কাছ থেকে নেওয়া যাবে আর আর কাছ থেকে নেওয়া যাবে না (ফতোয়া প্রদানের শর্তাবলী)

প্রশ্ন: একজন ব্যক্তি আলেম নন কিন্তু তার আকিদা সহিহ। তিনি সব বিষয়ে মানুষকে ফতোয়া দেন। তার থেকে ফতোয়া নেওয়া যাবে কি? আর ব্রাদার্সদের থেকে কি ফতোয়া গ্রহণ করা যাবে?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: নিম্নে ফতোয়ার পরিচয়, ফতোয়া প্রদানের শর্তাবলী, আমাদের দেশের মুফতিদের অবস্থা, ইলম বিহীন ফতোয়া প্রদানের ভয়াবহতা এবং সালাফদের ফতোয়া ভীতি ইত্যাদি সর্ম্পকে অতি সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল। وبالله التوفيق

ফতোয়া শব্দের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ:

ফতোয়া (الفتوي) শব্দের অর্থ: মতামত, রায়, মত ও সিদ্ধান্ত ইত্যাদি। [আরবি-বাংলা অভিধান। ড. ফজলুর রহমান]
– ব্যাখ্যা দেওয়া। যেমন: আল্লাহর তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ أَفْتُونِي فِي رُؤْيَايَ إِن كُنتُمْ لِلرُّؤْيَا تَعْبُرُونَ
“হে পরিষদবর্গ! তোমরা আমাকে আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা বল, যদি তোমরা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় পারদর্শী হয়ে থাক।” [সূরা ইউসুফ: ৪৩]
– পরামর্শ দেওয়া। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
قَالَتْ يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ أَفْتُونِي فِي أَمْرِي مَا كُنتُ قَاطِعَةً أَمْرًا حَتَّىٰ تَشْهَدُونِ
“বিলকিস বলল, হে পরিষদবর্গ, আমাকে আমার কাজে পরামর্শ দাও। তোমাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমি কোন কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না।” [সূরা নামল: ৩২]

আর পরিভাষায় ফতোয়া বলা হয়,
ذِكْرُ الحُكْم المسؤول عنه للسَّائل
“প্রশ্নকারীর নিকট তার প্রশ্ন কৃত বিষয়ের বিধান উল্লেখ করা।” [ফায়জুল কাদির-মুনাবি ১/১৫৮, আল মিসবাহুল মুনির পৃষ্ঠা: ২৩৯]

কোনও কোনও আলেম বলেন,
الإخبار بحكم الشرع، لا على وجه الإلزام
“শরিয়তের হুকুম জানানো-বাধ্য করার ভিত্তিতে নয়।” [ফাতায়া লিল ইমাম শাতেবি, পৃষ্ঠা: ৬৮] (বাধ্য করার অধিকার রাখে কেবল কাজি বা বিচারক; মুফতি নয়)

ফতোয়ার প্রয়োজনীয়তা, আমাদের দেশের মুফতিগণের অবস্থা এবং ফতোয়ার শর্তাবলি:

ফতোয়া ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ জীবন চলার পথে মানুষ নিত্য নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয়, জীবনের বাঁকে বাঁকে মানুষ নানা ধরণের সংশয় ও জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হয়। দেশ, সমাজ, পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সমস্যায় ভিন্নতা থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে সে সব সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদেরকে আলেমদের শরণাপন্ন হতে হয়। বিজ্ঞ আলেমরা কুরআন-সুন্নাহর নির্যাস থেকে আমাদেরকে সমস্যার সমাধান এবং সে ক্ষেত্রে করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেন। ফলে আমরা জটিলতা থেকে মুক্তি পাই এবং সহজে ইসলামের বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে পারি।

অতএব, জীবনের নানা সমস্যার সঠিক ইসলামিক সমাধান পেতে হলে আমাদের কর্তব্য, নির্ভরযোগ্য ও কুরআন-সুন্নাহর গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন আলেমদেরকে নিকট থেকে ফতোয়া গ্রহণ করা। তাই তো আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ‎
“অতএব তোমরা (কিতাব-সন্নাহর জ্ঞানে সুসজ্জিত) জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তোমাদের জানা না থাকে।” [সূরা নাহল: ৪৩ ও সূর আম্বিয়া: ৭] আল্লাহ তাআলা এখানে বিজ্ঞ আলেমদেরকে জিজ্ঞাসা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর যারা ইসলামের আলোকে মানুষের নানা সমস্যার সমাধান ও দিক নির্দেশনা দিবেন তাদের জন্য আবশ্যক হল, পূর্বসূরিদের বুঝ ও ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন-হাদিসের নির্যাস থেকে ফতোয়া প্রদান করা। ভাসাভাসা, অস্পষ্ট ও‌ দুর্বল জ্ঞান দ্বারা ফতোয়া প্রদান করা বৈধ নয়।

কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক হলেও বাস্তব কথা হলো, আমাদের দেশে যাদেরকে আমরা ‘আলেম’ বলে চিনি তাদের অধিকাংশের মধ্যেই ফতোয়া দেওয়ার মতো যোগ্যতা নেই‌ ব্রাদার্স, সাধারণ তালেবুল ইলম কিংবা সাধারণ দ্বীন চর্চা কারী ব্যক্তি তো দূরের কথা।

ফতোয়ার শর্তাবলী:

আলেমগণ ফতোয়া দেওয়ার জন্য বেশ কিছু শর্ত উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো, ইলমুল কুরআন (নাসেখ-মনসুখ, মুহকাম-মুতাশাবিহ, আম-খাস, মুতলাক-মুকাইয়াদ, শানে নুজুল ইত্যাদি), তাফসির, হাদিস, উসুলে হাদিস (হাদিসের সহিহ-জয়ীফ মান নির্ণয়, রিজাল শাস্ত্র ইত্যাদি), আরবি ভাষা সাহিত্য (ইলমুল বালাগাহ বা অলঙ্কার শাস্ত্র, কবিতা ও গভীর ভাষাজ্ঞান) ও ব্যাকরণ (নাহু-সরফ), ফিকহ, উসুলে ফিকহ, সালাফদের ফতোয়া, মতামত, মতবিরোধ ও ইজমা এবং বিশুদ্ধ আকিদা-এর পাশাপাশি ফিকহুল ওয়াকে (পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট) ইত্যাদি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকা। পাশাপাশি একজন মুফতি হবেন, তাকওয়াবান বা পরহেজগার-আল্লাহ ভীরু, আমানতদার বা বিশ্বস্ত, ব্যক্তিত্ববান, সুস্থ বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন এবং বিচক্ষণ ইত্যাদি। আলেমগণ এ বিষয়গুলো বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

ইমাম শাফেয়ী রাহ. খতিব বাগদাদি থেকে সংক্ষেপে মুফতির শর্তাবলী উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,
”لا يحل لأحد يفتي في دين الله إلا رجلا عارفا بكتاب الله : بناسخه ومنسوخه ، وبمحكمه ومتشابهه ، وتأويله وتنزيله ، ومكيه ومدنيه ، وما أريد به ، وفيما أنزل ، ثم يكون بعد ذلك بصيرا بحديث رسول الله – صلى الله عليه وسلم – ، وبالناسخ والمنسوخ ، ويعرف من الحديث مثل ما عرف من القرآن ، ويكون بصيرا باللغة ، بصيرا بالشعر ، وما يحتاج إليه للعلم والقرآن ، ويستعمل مع هذا الإنصاف ، وقلة الكلام ، ويكون بعد هذا مشرفا على اختلاف أهل الأمصار ، ويكون له قريحة بعد هذا ، فإذا كان هذا هكذا فله أن يتكلم ويفتي في الحلال والحرام ، وإذا لم يكن هكذا فله أن يتكلم في العلم ولا يفتي

“আল্লাহর দ্বীনের বিষয়ে এমন ব্যক্তি ছাড়া কারও ফতোয়া দেওয়া বৈধ নয় যে, আল্লাহর কিতাবের নাসেখ-মনসুখ, মুহকাম-মুতাশাবিহ, ব্যাখ্যা, শানে নুজুল, মক্কি-মাদানি, এর উদ্দেশ্য কী, কোন বিষয়ে নাজিল হয়েছে ইত্যাদি বিষয় জানে। পাশাপাশি আল্লাহর রসুলের হাদিসের নাসেখ-মনসুখ বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান রাখে, হাদিস বিষয়ে তেমন জ্ঞান রাখে যেমন জ্ঞান রাখে কুরআনের বিষয়ে, আরবি ভাষা, আরবি কবিতা এবং কুরআন ও প্রয়োজনীয় বিষয়ে সম্যক জ্ঞান রাখে। এর সাথে সে ন্যায়-ইনসাফকে ব্যবহার করবে, কম কথা বলবে, তৎসঙ্গে বিভিন্ন দেশে আলেমদের মতবিরোধ বিষয়ে দৃষ্টি রাখবে। তাহলে তার মধ্যে ফতোয়া প্রদানের পরিপক্বতা ও যোগ্যতা সৃষ্টি হবে। এমন হলে তার জন্য হালাল-হারাম বিষয়ে কথা বলা ও ফতোয়া দেওয়া অনুমতি রয়েছে। অন্যথায় সে ইলমি কথাবার্তা বলতে পারে কিন্তু ফতোয়া দিবে না।” [আল ফাকিহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ-খতিব বাগদাদি ২/২৩৪]

তাই সাধারণ মানুষের উচিত, দেখেশুনে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আলেমদেরকে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে ইলমের জগতে সুপরিচিত বিদগ্ধ ও বড় আলেমদেরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যার তার কাছে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা দ্বীনের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়।

ইলম বিহীন ফতোয়া প্রদানের ভয়াবহতা এবং সালাফদের ফতোয়া ভীতি:

যারা ইচ্ছেমত ফতোয়া দেয় তাদের উচিত, আল্লাহকে ভয় করা। কেননা এটা অনেক বড় আমানত।‌ ইলম বিহীন ফতোয়া দেওয়ার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। (আল্লাহ ক্ষমা করুন। আমিন)

◆ ইমাম নওবি রাহ. বলেন,
اعلم أن الإفتاءَ عظيمُ الخطر، كبيرُ الموقع، كثيرُ الفضل؛ لأن المفتيَ وارثُ الأنبياء صلواتُ الله وسلامه عليهم، وقائمٌ بفرض الكفاية، لكنه مُعَرَّضٌ للخطأ؛ ولهذا قالوا: المفتي مُوَقِّعٌ عن الله تعالى

“জেনে রাখুন, ফতোয়া দেওয়ার বিষয়টি বড় বিপদ জনক এবং ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী। কিন্তু বিশাল মর্যাদারও বিষয়। কারণ মুফতি (ফতোয়া প্রদানকারী) নবি-রসুলদের উত্তরাধিকারী এবং ফরজে কেফায়ার দায়িত্ব পালনকারী কিন্তু ভুল সিদ্ধান্ত প্রদানের আশঙ্কাজনক অবস্থার সম্মুখীন। এ কারণে আলেমগণ বলেন যে, মুফতি হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে সাক্ষর দান কারী।” [আদাবুল ফতোয়া, পৃষ্ঠা নম্বর: ১৩]

এ জন্য সালাফগণ ফতোয়া প্রদানের ব্যাপারে খুবই ভীত থাকতেন এবং যথাসম্ভব এ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতেন।

◆ আব্দুর রাহমান ইবনে আবি লায়লা বলেন,
أدركتُ عشرين ومئةً من الأنصارِ مِن أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم يُسأل أحدُهم عن المسألةِ، فيردُّها هذا إلى هذا، وهذا إلى هذا، حتى ترجعَ إلى الأوَّلِ
“আমি একশ বিশ জন আল্লাহর রসুলের আনসারি সাহাবিকে পেয়েছি যাদের কাছে, কোনও মাসআলা জিজ্ঞাসা করা হলে একজন অন্য জনের নিকট পাঠাতেন, তিনি আরেক জনের কাছে পাঠাতেন…এভাবে বিষয়টি আবার প্রথম জনের কাছে ফিরে আসতো।” [তারিখে বাগদাদ-খতিব আল বাগদাদি ১৩/৪১২, আল মারিফাতু ওয়াত তারিখ ৩/১১৫]

◆ আবু হুসাইন উসমান ইবনে আসিম বলেন,
إنّ أحدَهم ليُفْتي في المسألةِ، ولو وَرَدَتْ على عمرَ بن الخطَّاب رضي الله عنه لجَمَع لها أهلَ بدرٍ!
“তোমাদের কেউ কেউ এমন মাসআলায় ফতোয়া দিয়ে দাও যে, সেটা যদি উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর কাছে পেশ করা হত তাহলে তিনি (এ মাসআলার সঠিক জবাব পাওয়ার জন্য) বদরি সাহাবিদেরকে জমা করে ফেলতেন।” [আল মাদখাল ইলাস সুনান লিল বায়হাকি, পৃষ্ঠা নাম্বার: ৮০৩]

তবে সাধারণ আলেম, বক্তা, ওয়ায়েজ, মসজিদের ইমামগণ-খতিব ও ব্রাদার্স প্রমুখগণ যদি বিজ্ঞ আলেমদের দলিল সমৃদ্ধ ফতোয়াগুলো মানুষের কাছে নকল করে তাহলে তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজের অনেকেই ফতোয়া নকল করার ক্ষেত্রেও আমানতদারিতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয় অথবা আদেতেই আলেমদের ফতোয়াকে সঠিকভাবে বুঝা একং তা সঠিক জায়গায় উপস্থাপন করার মত যোগ্যতাটুকুও তার নিকট নেই। (আল্লাহ হেফাজত করুন। আমিন। যাহোক, এই জাতীয় ফতোয়াগুলো সতর্কতার সাথে গ্রহণ করতে বাধা নেই ইনশাআল্লাহ। কিন্তু তা ভুল প্রমাণিত হলে তা প্রত্যাখ্যান করা আবশ্যক। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন। মহান আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন-সুন্নাহ নির্ভর যোগ্য আলেমদের নিকট থেকে ইসলামের নানা সমস্যায় ফতোয়া জিজ্ঞাসা করার এবং মুফতিদেরকে কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক সঠিক দিক ফতোয়া প্রদানের তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।