প্রচণ্ড গরমের সময় নামাজ সংক্রান্ত ১০টি জরুরি মাসায়েল

দেশব্যাপী স্মরণকালের ভয়াবহ দাবদাহ চলছে। প্রচণ্ড উত্তাপের কারণে মানুষ ও পশুপাখি অতিষ্ঠ। প্রখর সূর্যের কিরণ এবং লু হাওয়ায় জনজীবনের বেহালদশা। (আল্লাহ হেফাজত করুন।‌ আমিন)। এমতবস্থায় সালাত আদায় সম্পর্কে, বিশেষভাবে দ্বিপ্রহরের জোহর সালাত আদায় করার ব্যাপারে ইসলাম কী দিকনির্দেশনা দিয়েছে সেটি আমরা জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

নিম্নে এ সংক্রান্ত জরুরি কিছু মাসায়েল উল্লেখ করা হলো:

▪️১. হাদিসে কি প্রচণ্ড গরমের সময় কি বেশি করে নামাজ পড়তে বলা হয়েছে?
উত্তর: প্রচণ্ড গরমের সময় বেশি বেশি নামাজ পড়ার ব্যাপারে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা হাদিস ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, হাদিস গ্রন্থ সমূহে এমন কোনও হাদিস নেই। অন্য কোনও হাদিসের মমার্থ থেকেও তা প্রমাণিত হয় না। বরং কিছু মানুষ একটি হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এমনটি বলছে।
উক্ত হাদিসটি হলো, আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا اشْتَدَّ الْحَرُّ فَأَبْرِدُوا بِالصَّلَاةِ, فَإِنَّ شِدَّةَ الْحَرِّ مِنْ فَيْحِ جَهَنَّمَ»
“যখন প্রচণ্ড গরম পড়ে তখন সালাতকে ঠাণ্ডা করবে। কেননা প্রচণ্ড গরম জাহান্নামের আগুনের নিঃশ্বাস থেকে আসে।” [বুখারি ও মুসলিম]

এ হাদিস অনুযায়ী কেউ কেউ বলছে যে, যখন খুব গরম পড়ে তখন সালাতের মাধ্যমে গরমকে ঠাণ্ডা করো। অর্থাৎ বেশি করে সালাত আদায় করো! কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা। হাদিসের ভাষাগত দিক খেয়াল করলেও এমন অর্থ বুঝা যায় না।
কারণ এখানে বলা হয়নি, فَأَبْرِدُوه بِالصَّلَاةِ “তোমরা গরমকে সালাতের মাধ্যমে ঠাণ্ডা করো।”

▪️২. তাহলে উক্ত হাদিসে উল্লেখিত হাদিসে সালাতকে ঠাণ্ডা করার অর্থ কী?
উত্তর:
– ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি রাহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন,
( فأبردوا ) بقطع الهمزة وكسر الراء ، أي أخروا إلى أن يبرد الوقت
”ঠাণ্ডা করো” অর্থ: সময়টা ঠাণ্ডা হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব করো।” [ফাতহুল বারি]
– তিনি অন্যত্র বলেন,
«الإبراد» تأخير صلاة الظهر إلى أن يبرد الوقت
ইবরাদ «الإبراد» শব্দের অর্থ, “সময় ঠাণ্ডা হওয়া পর্যন্ত জোহর সালাত বিলম্ব করা।” [বুলুগুল মারাম]
এ ব্যাখ্যাটি সঠিক।‌ কেননা তা অন্য হাদিস থেকে স্পষ্ট হয়। তা হলো, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“أَبْرِدُوا بِالظُّهْرِ فَإِنَّ شِدَّةَ الْحَرِّ مِنْ فَيْحِ جَهَنَّمَ
“জোহরের সালাতকে ঠাণ্ডা করে আদায় করো। কেননা প্রচণ্ড গরম জাহান্নামের নিঃশ্বাস।” [সহীহ মুসলিম]

তাহলে এখান থেকে প্রমাণিত হলো যে, হাদিসে মূলত প্রচণ্ড গরমের সময় জোহরের সালাত বিলম্ব করার কথা বলা হয়েছে।
এই হাদিসের মর্মার্থ অনুযায়ী,‌ প্রচণ্ড গরমের সময় অধিক পরিমাণ সালাত পড়ার কথা পূর্ববর্তী আলেমগণ কেউ বলেছেন বলে জানা নেই।

▪️৩. প্রচণ্ড গরমের সময় জোহরের সালাত বিলম্ব করে পড়ার বিধান কী?

এ ব্যাপারে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন,

جمهور أهل العلم يستحب تأخير الظهر في شدة الحر إلى أن يبرد الوقت وينكسر الوهج
“বেশির ভাগ আহলে ইলমের মতে, প্রচণ্ড গরমের সময় জোহরের সালাত দেরিতে আদায় করা উত্তম যতক্ষণ না সময় ঠাণ্ডা হয় এবং সূর্যের কিরণের তিব্রতা কমে যায়।” [ফাতহুল বারী)

▪️৪. উক্ত হাদিসের আলোকে প্রচণ্ড গরমের কারণে কেবল জোহরের সালাত বিলম্ব করা যাবে; আসর, মাগরিব, ইশা, ফজর ইত্যাদি অন্য কোনো সালাত নয়। কেননা হাদিসে ষ্পষ্টভাবে কেবল জোহরের সালাতের কথা এসেছে।
অতএব অন্যান্য সালাত যথাসময়ে আদায় করতে হবে।

▪️ ৫. অনুরূপভাবে এ হাদিস কেবল গ্রীষ্মকালেই প্রযোজ্য; শীতকালে নয়।‌যেমটি বলেছেন ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহ.
تؤخر في الصيف دون الشتاء
“গ্রীষ্মকালে বিলম্ব করা যাবে; শীতকালে নয়।”‌ [ফাতফুল বারি]

▪️৬. পুরুষগণ মসজিদে জামাতে সালাত পড়ুক কিংবা মহিলারা বাড়িতে পড়ুক সর্বাবস্থায় গ্রীস্মকালে যদি প্রচণ্ড দাবাদহ পড়ে তবে জোহরের সালাত বিলম্ব করা মুস্তাহাব (মতান্তরে ওয়াজিব)। কেননা হাদিসটি আম বা ব্যাপক যা নারী-পুরুষ উভয়কেই শামিল করে। এটি অধিক বিশুদ্ধ মত।

▪️৭. মসজিদে বা বাড়িতে ফ্যান বা এয়ার কন্ডিশন থাকলেও উক্ত বিধানের পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ হাদিস পালনার্থে এ ক্ষেত্রেও বিলম্বে জোহরের সালাত আদায় করা উচিত।

▪️৮. প্রচণ্ড গরম না থাকলে বা স্বাভাবিক অবস্থায় কিংবা শীত মওসুমে আওয়াল ওয়াক্তে তথা সালাতের সময় হওয়ার পর কাল বিলম্ব না করে আদায় করবে। কেননা তখন সালাত বিলম্ব করার মূল কারণ অনুপস্থিত।
আর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বাভাবিক অবস্থায় আওয়াল ওয়াক্তে জোহরের সালাত আদায় করতেন। যেমন: আয়েশা রা. বলেন,

ما رأيت أحدا كان أشد تعجيلا للظهر من رسول الله صلى الله عليه وسلم، ولا من أبي بكر، ولا من عمر

“আগেভাগে‌ (আওয়াল ওয়াক্তে) জোহরের সালাত আদায় করার ক্ষেত্রে আমি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আর কাউকে এতটা তাড়াহুড়া করতে দেখিনি। আবু বকর ওমর রা. থেকেও নয় (অর্থাৎ তাদের থেকেও তিনি আগেভাগে জোহরের সালাত আদায় করতেন)। ” [তিরমিজী হাদিস নম্বর: ১৫৫ (আল মাদানী প্রকাশনী)]

▪️৯. যে সব অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে আবহাওয়া খুব বেশি উত্তপ্ত হয় না বা নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় উক্ত হাদিস প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ সে সব অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে যথাসময়েই জোহরের সালাত আদায় করবে; বিলম্ব করবে না।

▪️১০. প্রচণ্ড গরমের সময়েও যদি কোথাও যথাসময়েই আজান দেওয়া হয় (বিলম্ব না করা হয়) তাহলে কষ্ট হলেও পুরুষগণ জামাতের সাথে সালাত আদায় করার উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করবে। শরিয়ত সম্মত ওজর ছাড়া জামাত পরিত্যাগ করবে না। কেননা ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন যাপন করা ফরজ। বিচ্ছিন্নতা ও দ্বিমত করা হারাম। [সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড]। আল্লাহ আমাদেরকে তার রহমতের বারিধারায় সিক্ত করুন এবং জাহান্নামের আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। আমিন। আল্লাহু আলম।
– আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল –