পিতামাতা যদি স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার নির্দেশ দেয় তাহলে তা কি মান্য করা আবশ্যক

উত্তর: কুরআন-হাদিসে পিতামাতার সীমাহীন মর্যাদার কথা এসেছে। তাদের সাথে সদাচরণ করা এবং শরিয়ত সম্মত ভাবে তাদেরকে খুশি রাখার চেষ্টা করা সন্তানের জন্য ফরজ।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا

“আর আপনার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর।”

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

رَضَىَ الرَّبِّ فِىْ رِضَى الْوَالِدِ وَسُخْطُ الرَّبِّ فِىْ سُخْطِ الْوَالِدِ

“প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং প্রতিপালকের অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে।” [তিরমিযি-সহিহ]

✪ শরিয়ত সম্মত কারণ ছাড়া তাদের অবাধ্যতা করা হারাম ও কবিরা গুনাহ। যেমন হাদিসে এসেছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সব চেয়ে বড় পাপ কোন টি তা কি তোমাদেরকে বলব না? তা হল:

الإشْرَاكُ باللَّهِ، وعُقُوقُ الوَالِدَيْنِ، وقَتْلُ النَّفْسِ، وشَهَادَةُ الزُّورِ

“আল্লাহর সাথে শিরক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, মানুষ হত্যা করা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।” [সহিহ মুসলিম]

❑ কিন্তু পিতামাতা যদি তাদের ছেলেকে এ নির্দেশ দেয় যে, তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দাও তাহলে কি তাদের আনুগত্য করা আবশ্যক?

উত্তর: পিতা-মাতা যদি শরিয়ত সম্মত ও বাস্তব সম্মত যৌক্তিক কারণে এ নির্দেশ দেয় তাহলে তাদের আনুগত্য করা আবশ্যক। কিন্তু যদি শরিয়ত সম্মত কারণ ছাড়া এ নির্দেশ দেয় কিংবা নির্দেশ পালক করতে গিয়ে নিজের ও স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির ক্ষতি হয় তাহলে তাদের আনুগত্য করা আবশ্যক নয়। কারণ হাদিসে এসেছে,
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لا طَاعَةَ في مَعْصِيَةٍ، إنَّما الطَّاعَةُ في المَعروفِ

“আল্লাহর নাফরমানিতে কোন আনুগত্য নেই।‌ আনুগত্য হবে কেবল ভালো কাজে।” [সহীহুল বুখারি]

◈ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়া রাহ. বলেন,

يلزم الإنسان طاعة والديه في غير المعصية، وإن كانا فاسقين ‏وهذا فيما فيه منفعة لهما ، ولا ضرر عليه

“যে ক্ষেত্রে আল্লাহর নাফরমানি নেই সে ক্ষেত্রে পিতামাতার আনুগত্য করা সন্তানের জন্য আবশ্যক যদিও তারা নিজেরা ফাসেক হয়। এটা ঐ ক্ষেত্রে যেখানে তাদের উপকার আছে কিন্তু সন্তানের কোনও ক্ষতি নেই।” [আল এখতিয়ারাত, পৃষ্ঠা: ১৪]

◈ ইমাম আহমদ রাহ. এর নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল, আমার পিতা নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমি যেন, আমার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেই। (আমি কি তালাক দিব?)

ইমাম আহমদ রাহ. বললেন,

لا تطلقها ، قال : أليس النبي صلى الله عليه وسلم قد أمر ابن عمر أن يطلق زوجته حين أمره عمر بذلك ؟ قال : وهل أبوك مثل عمر؟

“তালাক দিও না।”

প্রশ্ন কারী বললেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি ইবনে উমর রা.কে তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার নির্দেশ দেননি যখন তাকে তার পিতা উমর রা. তালাক দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন?
তিনি তখন বললেন, “তোমার পিতা কি উমর রা.-এর মত?”
[মুহাম্মদ বিন মুফলিহ রচিত-আল আদাবুশ শারঈয়্যাহ, অনুচ্ছেদ: স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে পিতামাতার আনুগত্য করা আবশ্যক নয়।]

✪✪ এ মর্মে বর্ণিত হাদিসটি নিম্নরূপ:

ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قَالَ كَانَتْ تَحْتِي امْرَأَةٌ أُحِبُّهَا وَكَانَ أَبِي يَكْرَهُهَا فَأَمَرَنِي أَبِي أَنْ أُطَلِّقَهَا فَأَبَيْتُ فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ‏ “‏ يَا عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ طَلِّقِ امْرَأَتَكَ

“আমার এক স্ত্রী ছিল। তাকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার পিতা (উমর রা.) তাকে অপছন্দ করতেন। তাই তিনি আমাকে আমার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু আমি তা করতে অস্বীকার করি। পরে আমি বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে উল্লেখ করলে তিনি বললেন, হে আবদুল্লাহ ইবনে উমর, তোমার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দাও।” [সুনান আত তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ১৩/ তালাক ও লি’আন, পরিচ্ছেদ: পিতা যদি কাউকে তার স্ত্রীকে তালাক দিতে বলে]

ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.- এর মতো ন্যায় পরায়ণ এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহাম প্রাপ্ত কোনও পিতা যদি তার ছেলেকে বলে, তোমার স্ত্রীকে তালাক দাও তাহলে বুঝতে হবে, এর পেছনে অবশ্যই উপযুক্ত ও শরিয়ত সম্মত কারণ রয়েছে। এমন পিতার আনুগত্য করতে কোন বাধা নেই। তিনি তো এমন প্রজ্ঞাবান মানুষ ছিলেন যে, তার মতামত ও প্রস্তাবের আলোকে মহান আল্লাহ তাআলা সাত আসমান থেকে কয়েকটি কুরআনের আয়াত নাজিল করেছেন। সুবহানাল্লাহ!

কিন্তু বর্তমান যুগে অধিকাংশ পিতা-মাতার অবস্থা কী? অধিকাংশ পিতামাতার ইসলামের জ্ঞান তো নেই বরং তারা তাদের স্বার্থ ঠিক রাখতে অন্যায় আচরণ করতেও দ্বিধা করে না। এমন অনেক পিতা-মাতা আছে, যারা ছেলের স্ত্রীর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে, আবার কেউবা একান্তই নির্বুদ্ধিতার কারণে এমন নির্দেশ দিতে পারে।
সুতরাং এসব ক্ষেত্রে পিতা-মাতার আনুগত্য করা আবশ্যক নয়। অন্যথায় সমাজে অসংখ্য নারী জুলুমের শিকার হবে।

◈ শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া রাহ. কে প্রশ্ন করা হয়,

رجل متزوج وله أولاد ، ووالدته تكره زوجته ، وتشير عليه بطلاقها، هل يجوز له طلاقها؟

এক বিবাহিত ব্যক্তি। তার কয়েক জন সন্তান আছে। কিন্তু তার মা তার স্ত্রীকে অপছন্দ করে এবং তালাক দেওয়ার জন্য ইঙ্গিত করে। তাকে কি তার তালাক দেওয়া জায়েজ আছে?

তিনি বলেন,

لا يحل له أن يطلقها لقول أمه، بل عليه أن يبر أمه، وليس تطليق امرأته من بر أمه

“মায়ের কথায় স্ত্রীকে তালাক দেওয়া জায়েজ নয়। বরং সে তার মার সাথে সদাচরণ করবে। কিন্তু স্ত্রীকে তালাক দেওয়া মায়ের প্রতি সদাচরণের অন্তর্ভুক্ত নয়।” [মাজমু ফাতাওয়া-শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া ৩৩/১১২]

◈ সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া বোর্ডের নিকট প্রশ্ন করা হয় যে, মা তার ছেলেকে নির্দেশ দিয়েছে যে, সে যেন তার স্ত্রীকে তালাক দেয়। অথচ এর কোনও কারণ নেই। তার দ্বীন বা চরিত্রে কোনও সমস্যা নেই। শুধু ব্যক্তিগত অনিচ্ছায় এ নির্দেশ দিয়েছে।
এর উত্তরে তারা বলেন,

” إذا كان الواقع كما ذكر السائل من أن أحوال زوجته مستقيمة وأنه يحبها ، وغالية عنده ، وأنها لم تسئ إلى أمه وإنما كرهتها لحاجة شخصية ، وأمسك زوجته وأبقى على الحياة الزوجية معها ، فلا يلزمه طلاقها طاعة لأمه ، لما ثبت عن النبي عليه الصلاة والسلام أنه قال : ” إنما الطاعة في المعروف ” وعليه أن يبر أمه ويصلها بزيارتها والتلطف معها والإنفاق عليها ومواساتها بما تحتاجه وينشرح به صدرها ويرضيها بما يقوى عليه سوى طلاق زوجته ” . فتاوى اللجنة الدائمة 20/29

“প্রশ্নকারী যেমনটি উল্লেখ করেছে বাস্তবতা যদি তেমনটি হয় অর্থাৎ তার স্ত্রী দ্বীনদার হয়, সে তাকে ভালবাসে, সে তার কাছে মূল্যবান হয় এবং সে তার মার সাথে খারাপ ব্যবহারও করেনি বরং তার মা তাকে অপছন্দ করে ব্যক্তিগত কারণে আর সে স্ত্রীকে ধরে রাখে, তার সাথে দাম্পত্য জীবন অটুট রাখে তাহলে এ ক্ষেত্রে মায়ের আনুগত্য করা তার জন্য আবশ্যক নয়। কারণ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে, তিনি বলেছেন, “আনুগত্য হবে কেবল ভালো কাজে।”
তবে তার জন্য আবশ্যক হল, মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করা তথা তাকে দেখতে যাওয়া, তার প্রতি সদয় হওয়া, তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করা, তাকে সান্ত্বনা দেওয়া এবং তার অন্তরকে প্রফুল্ল রাখা। এর মাধ্যমে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া ছাড়াও তার মাকে খুশি রাখতে সামর্থ হবে।” [ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা, ২৯/২০]

মোটকথা, পিতামাতা অবশ্যই আমাদের সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও আনুগত্য পাওয়ার হকদার। তাদের কথার অবাধ্যতা করা বৈধ নয়। কিন্তু তারা যদি এমন নির্দেশ দেয় তা শরিয়ত অনুমোদিত নয় বা এতে সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে তাহলে তাদের আনুগত্য করা আবশ্যক নয়।
সুতরাং পিতামাতা যদি ন্যায়সঙ্গত ভাবে ও শরিয়ত সম্মত কারণে স্ত্রীকে তালাক দিতে বলে তাহলে তা অবশ্যই পালন করতে হবে। কিন্তু তারা যদি ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কিংবা শরিয়ত সম্মত কারণ ছাড়াই তালাক দিতে নির্দেশ দেয় তাহলে তাদের আনুগত্য করা আবশ্যক নয়। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।