নবি-রাসুল, শহিদ, ওলি-আওলিয়া প্রমূখগণ কি কবরে জীবিত আছেন

নবি-রাসুল, শহিদ, ওলি-আওলিয়া প্রমূখগণ কি কবরে জীবিত আছেন? এ ব্যাপারে আমাদের আকিদা-বিশ্বাস কেমন হওয়া উচিৎ?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

নিম্নে আমরা এ বিষয়টি কুরআন-সুন্নাহ ও বিশ্বখ্যাত আলেমদের অভিমতের আলোকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। وبالله التوفيق

❑ জীবনের পরে আরেক জীবন:

আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার জীবন সমাপান্তে নতুন এক জীবনের কথা বলেছেন। সেটা হল, আখিরাতের জীবন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ ۚ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ
“আখিরাতের গৃহই প্রকৃত জীবন যদি তারা জানত।” [সূরা আনকাবুত: ৬৪]

এ জীবনের সূচনা হয় মৃত্যুর পর থেকেই। কবর হলো আখিরাতের প্রথম স্টেজ। এটিকে বলা হয়, বারজাখি জীবন। বারজাখ (البَرْزَخ) শব্দের অর্থ প্রাচীর বা আড়। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রকৃত অবস্থা জীবিত মানুষদের চোখ থেকে আড় করে রাখা হয়েছে। আখিরাতের জীবন এবং দুনিয়ার জীবনের মাঝখানে একটা প্রাচীর তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই জীবন এক বাস্তব মহাসত্য। সে জীবন অনন্তকালের জন্য-যার কোন সমাপ্তি নেই। মৃত্যু বরণের মাধ্যমে নবি-রসূল, শহিদ, আল্লাহর প্রিয়ভাজন অলি-আউলিয়া, সাধারণ মুমিন-মুসলিমগণ, পাপিষ্ঠ ও ফাসেক মুসলিমগণ, এমনকি মোনাফেক, মুশরিক, কা/ফে/র, নাস্তিক ইত্যাদি সকল মানুষ সে নতুন জীবনে পদার্পণ করে।
এর প্রমাণ হল, অসংখ্য বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, মৃত্যুর পরে ফেরেশতা মণ্ডলী মৃত ব্যক্তিকে উঠিয়ে বসান এবং তিনটি প্রশ্ন করেন। সেই প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে পারলে তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক মহা সুখময় জীবনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। তারা সেখানে আল্লাহর হুকুমে জান্নাতের সুঘ্রাণ পায় এবং জান্নাতি বিছানায় আরামে ঘুমায়‌। সেখানে নবি-রসুল, শহিদ এবং আল্লাহর প্রিয়ভাজন ব্যক্তিগণ আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত দ্বারা সম্মানিত হন। বিশেষভাবে আল্লাহর পথের শহিদগণ রিজিক প্রাপ্ত হন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا- بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ
“আর যারা আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত মনে করো না। বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত। তারা (সেখানে) রিজিক প্রাপ্ত হয়।” [সূরা আলে ইমরান: ১৬৯]
পক্ষান্তরে কা/ফে/র, মুশরিক, মুনাফিক, নাস্তিকদের জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ আজাব। এই আজাবে তারা কেয়ামত পর্যন্ত নিপতিত থাকে। পাপিষ্ঠ ইমানদারেরাও তাদের পাপাচারিতা অনুযায়ী কম বেশি শাস্তির সম্মুখীন হয়।

✪ কবরে মুনকার-নাকির ফেরেশতা দ্বয় কর্তৃক মৃতদেরকে প্রশ্ন করা সংক্রান্ত নিম্নোক্ত হাদিসটি প্রসিদ্ধ:
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণি, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“‏ إِذَا قُبِرَ الْمَيِّتُ – أَوْ قَالَ أَحَدُكُمْ أَتَاهُ مَلَكَانِ أَسْوَدَانِ أَزْرَقَانِ يُقَالُ لأَحَدِهِمَا الْمُنْكَرُ وَالآخَرُ النَّكِيرُ فَيَقُولاَنِ مَا كُنْتَ تَقُولُ فِي هَذَا الرَّجُلِ فَيَقُولُ مَا كَانَ يَقُولُ هُوَ عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ

“মৃত মানুষকে অথবা তিনি বলেছেন, তোমাদের কাউকে যখন কব রাখা হয় তখন কালো বর্ণের এবং নীল চোখ বিশিষ্ট দু জন ফেরেশতা আসেন তার নিকট। তাদের মধ্যে একজনকে মুনকার এবং অন্যজনকে নাকির বলা হয়। তারা উভয়ে (মৃত ব্যক্তিকে) প্রশ্ন করেন, তুমি এ ব্যক্তির (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) প্রসঙ্গে কী বলতে? মৃত ব্যক্তিটি (যদি মুমিন হয় তাহলে) পূর্বে যা বলত তাই বলবে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও তার রসূল। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তাআলা ব্যতীত সত্য কোন মাবুদ (উপাস্য) নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বান্দা ও রসূল…। (লম্বা হাদিসের অংশ বিশেষ)। [সুনান আত তিরমিজী (তাহকীক কৃত), অধ্যায়: ৮/ জানাজা, পরিচ্ছেদ: ৭০. কবরের শাস্তি প্রসঙ্গে-হাসান]
এ ছাড়াও সহিহ বুখারি-মুসলিম সহ বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে কবরের মৃত ব্যক্তির সাথে কী করা হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। কোনও কোনও হাদিসে এসেছে, দাফন করার পর মৃত ব্যক্তিগণ দাফন কারীদের স্যান্ডেলের আওয়াজ শুনতে পায় ইত্যাদি।

❑ সকল নবি-রাসূল মৃত্যু বরণ করেছেন (ঈসা আ. ছাড়া):

মৃত্যু এক অবধারিত সত্যের নাম। এর থেকে কেউ পালাতে পারবে না। দুনিয়ার জীবনের নির্দিষ্ট সময়কাল অতিবাহিত হওয়ার পর সকল মানুষকে আখিরাতের অনন্ত জীবনের দিকে পাড়ি জমাতে হবে। সেই অলঙ্ঘনীয় সিস্টেমের আলোকে প্রথম মানুষ আদম আ. থেকে শুরু কর সকল নবি-রসূল সহ যুগযুগান্তরের অসংখ্য বনি আদম দুনিয়া ছেড়ে সেই অনন্তের পথে পাড়ি জমিয়েছে। এখনো যারা জীবিত আছে তাদেরকেও সেই পথেরই পথিক হতে হবে। এর মধ্যে কোনও সন্দেহ নেই

◈ আল্লাহ তাআলা বলেন,
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ۖ ثُمَّ إِلَيْنَا تُرْجَعُونَ
“প্রতিটি আত্মা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। অতঃপর তোমরা আমারই কাছেই প্রত্যাবর্তিত হবে।” [সূরা আনকাবুত: ৭৯]

◈ সকল নবী-রসূল মৃত্যু বরণ করেছেন (একমাত্র ঈসা আলাইহিস সালাম ছাড়া): আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِ الرُّسُلُ
“আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ তো নয়! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন।” [সূরা আলে ইমরান: ১৪৪]
তবে ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা ইহুদিদের হত্যা ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে অলৌকিকভাবে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। [দেখুন: সূরা নিসা-এর ১৫৭ ও ১৫৮ নাম্বার আয়াতের তাফসির] সেখানে তিনি জীবিত অবস্থায় আছেন। কিয়ামতের পূর্বে ইমাম মাহদির শাসনামলে পুনরায় দুনিয়ার বুকে আবির্ভূত হবেন এবং স্বাভাবিক জীবন ধারণ করে অবশেষে তিনিও মৃত্যু বরণ করবেন।

◈ আল্লাহ তাআলা নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মৃত্যুর কথা বলেছেন,
إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ
“(হে নবি) নিশ্চয় আপনারও মৃত্যু হবে এবং তাদেরও মৃত্যু হবে।” [সূরা যুমার: ৩০]

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তিরোধান সংক্রান্ত লম্বা হাদিসে তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সাহাবি আবু বকর রা. প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মৃত্যুর খরব পেয়ে বাহির থেকে এসে আয়েশা রা. এর ঘরে প্রবেশ করে তাঁর পবিত্র মুখের উপর থেকে কাপড় উত্তোলন করলেন। অতপর তাঁর কপালে ভালবাসার চুম্বন এঁকে দিয়ে বললেন,
.‏ بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي طِبْتَ حَيًّا وَمَيِّتًا
“(হে আল্লাহর রসুল,) আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কুরবান হোক। আপনি জীবিত অবস্থায় যেমন পূত-পবিত্র তেমনি মৃত অবস্থায়ও পূত-পবিত্র।” অত:পর তিনি ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মৃত্যু শোকে হতবিহ্ববল উমর রা.-এর সামনে সে ঐতিহাসিক বক্তব্যটি দেন যেটা শুনে তিনি শান্ত হয়ে যান। সে বক্তব্যের মধ্যে তিনি বলেছেন,
أَلاَ مَنْ كَانَ يَعْبُدُ مُحَمَّدًا صلى الله عليه وسلم فَإِنَّ مُحَمَّدًا قَدْ مَاتَ، وَمَنْ كَانَ يَعْبُدُ اللَّهَ فَإِنَّ اللَّهَ حَىٌّ لاَ يَمُوتُ
“যে মুহাম্মদের ইবাদত করতো (সে জেনে রাখুক যে,) মুহাম্মদ মৃত্যু বরণ করেছেন। আর যে আল্লাহর ইবাদত করতো (সে জেনে রাখুক যে), আল্লাহ চিরঞ্জীব-তিনি মৃত্যু বরণ করবেন না।” [সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৫০/ আম্বিয়া কিরাম, পরিচ্ছেদ: ২০৮৪]

এছাড়াও বহু বিশুদ্ধ হাদিসে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মৃত্যুর ঘটনা বিবৃত হয়েছে।

❑ নবি-রাসুলগণ কবরে জীবতি আছেন-এর ব্যাখ্যা কী?

বহু বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা এটিও প্রমাণিত হয়েছে যে, শুধু আমাদের নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নয় বরং সকল নবি-রসুলগণ কবরে জীবিত অবস্থায় আছেন এবং তারা সেখানে কখনো সালাত আদায় করেন। এসব হাদিসের ব্যাখ্যা জানার জন্য প্রথমে এ সংক্রান্ত কিছু হাদিস উল্লেখ করে নবি-রসুলদের কবরের জীবিত থাকা প্রসঙ্গে মতামত ও ফতোয়া উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ।

এ মর্মে কতিপয় সহিহ হাদিস নিম্নরূপ:

✪ ১. আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে,
إنَّ الأنبياءَ أحياءٌ في قُبورِهم يُصَلُّونَ
“নবীগণ কবরে জীবিত অবস্থায় সালাত আদায় করছেন।” [মুসনাদে বাযযার, সিলসিলা সহিহা ২/১৮৭]
✪ ২. আরেকটি হাদিসে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসা আ. কে তাঁর কবরে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে দেখেছেন। যেমন: আনাস রা. থেকে বর্ণিত যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‏ مَرَرْتُ عَلَى مُوسَى وَهُوَ يُصَلِّي فِي قَبْرِهِ ‏‏
“আমি মুসা (আলাইহিস সালাম) এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম, তখন তিনি তার কবরে সালাত আদায় করছিলেন।” আলি রহ. এর শায়খ ঈসা রহ. এর হাদিসে অতিরিক্ত শব্দ রয়েছে, “আমাকে যে রাতে মিরাজে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সে রাতে আমি (তার কবরের নিকট দিয়ে) অতিক্রম করছিলাম-অর্থাৎ এটি মিরাজের রাতের ঘটনা।” [সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৪৫/ ফজিলত, পরিচ্ছেদ: ৩৮. মুসা আলাইহিস সালাম এর ফজিলত।”]
✪ ৩. এ বিষয়টি অন্য হাদিসে এসেছে,
مَرَرْتُ – عَلَى مُوسَى لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِي عِنْدَ الْكَثِيبِ الأَحْمَرِ وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي فِي قَبْرِهِ
“রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে রাতে আমার মিরাজ হয়েছিল, সে রাতে আমি মুসা (আলাইহিস সালাম) এর পাশ দিয়ে গেলাম। তখন তিনি লাল বালুকা স্তূপের কাছে তাঁর কবরের মধ্যে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন।” [সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৪৫/ ফজিলত, পরিচ্ছেদ: ৩৮. মুসা রা.-এর ফজিলত]
✪ ৪. আবু হুরায়রা রা. বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজের ঘটনার বিবরণ প্রসঙ্গে বলেন,
وَقَدْ رَأَيْتُنِي فِي جَمَاعَةٍ مِنَ الأَنْبِيَاءِ فَإِذَا مُوسَى قَائِمٌ يُصَلِّي فَإِذَا رَجُلٌ ضَرْبٌ جَعْدٌ كَأَنَّهُ مِنْ رِجَالِ شَنُوءَةَ وَإِذَا عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ – عَلَيْهِ السَّلاَمُ – قَائِمٌ يُصَلِّي أَقْرَبُ النَّاسِ بِهِ شَبَهًا عُرْوَةُ بْنُ مَسْعُودٍ الثَّقَفِيُّ وَإِذَا إِبْرَاهِيمُ – عَلَيْهِ السَّلاَمُ – قَائِمٌ يُصَلِّي أَشْبَهُ النَّاسِ بِهِ صَاحِبُكُمْ – يَعْنِي نَفْسَهُ – فَحَانَتِ الصَّلاَةُ فَأَمَمْتُهُمْ فَلَمَّا فَرَغْتُ مِنَ الصَّلاَةِ قَالَ قَائِلٌ يَا مُحَمَّدُ هَذَا مَالِكٌ صَاحِبُ النَّارِ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ ‏.‏ فَالْتَفَتُّ إِلَيْهِ فَبَدَأَنِي بِالسَّلاَمِ

“এরপর নবীদের এক জামাতেও আমি নিজেকে দেখতে পেলাম। মুসা আ. কে সালাতে দণ্ডায়মান দেখলাম। তিনি শানুয়াহ গোত্রের লোকদের ন্যায় মধ্যম আকৃতি। তার চুল ছিল কোঁকড়ানো। ঈসা আ. কেও সালাতে দাঁড়ানো দেখলাম। তিনি তোমাদের এ সাথীর মতোই দেখতে অর্থাৎ মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তারপর সালাতের সময় হল, আমি তাদের ইমামতি করলাম। সালাত শেষে এক ব্যক্তি আমাকে বললেন, হে মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! ইনি জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক মালিক। তাকে সালাম করুন। আমি তার দিকে তাকালাম। তিনি আমাকে আগেই সালাম করলেন।” [সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১। ঈমান, পরিচ্ছেদ: ৭৫. মরিয়ম পুত্র ঈসা আ. ও মাসিহুদ দজ্জাল-এর বর্ণনা]

✪ ৫. প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবরের নিকটে যখন কেউ সালাম দেয় তখন তার রূহ ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং তিনি সালামের জবাব দেন। আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَا مِنْ أَحَدٍ يُسَلِّمُ عَلَيَّ إِلاَّ رَدَّ اللهُ عَلَيَّ رُوحِي حَتَّى أَرُدَّ عَلَيْهِ السَّلاَمَ
“যে কোনও ব্যক্তি যখন আমার উপর সালাম পেশ করে, তখন আল্লাহ আমার মধ্যে আমার আত্মা ফিরিয়ে দেন, ফলে আমি তার সালামের জবাব দিই।” [আবু দাউদ-বিশুদ্ধ সহিহ]
এসব হাদিস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, নবী-রসুলগণ কবরে জীবিত।

❑ নবি-রসূলগণ কবরে জীবিত থাকা বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমদের অভিমত:

◈ ১. ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহ. [২৪১ হিজরি] এর অন্যতম একটি আকিদা হল,
إنَّ الأنبياءَ أحياءٌ في قُبورِهم يُصَلُّونَ
“নবীগণ কবরে জীবিত অবস্থায় সালাত আদায় করেন।” [আবু বকর আল খাল্লাল বর্ণিত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রচিত আল আকিদা]

◈ ২. ইবনে তায়মিয়া রাহ. [মৃত্যু: ৭২৮ হিজরি] বলেন,
(الأنبياءُ أحياءٌ في قُبورِهم، وقد يُصَلُّون كما رأى مُحَمَّدٌ موسى -صَلَواتُ اللهِ وسلامُه عليهما وعلى سائِرِ الأنبياءِ- في قَبْرِه ليلةَ الإسراءِ)
“নবীগণ তাদের কবরে জীবিত এবং তারা কখনো সালাত আদায় করেন- যেমনটি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিরাজের রাতে মুসা আলাইহিস সালাম এবং অন্যান্য সকল নবি-রসুলকে তাদের কবরে সালাত আদায় করতে দেখেছেন।” [আল মুসতাদরাক আল মাজমুউল ফাতাওয়া ১/১০১]

◈ ৩. ইবনে আব্দুল হাদি [মৃত্যু: ৭৪৪ হি.] বলেন,

“رد الروح على الميت في البرزخ ، ورد السلام على من يسلم عليه لا يستلزم الحياة التي يظنها بعض الغالطين ، وإن كان نوع حياة برزخية وقول من زعم أها نظير الحياة المعهودة مخالف للمنقول والمعقول ”

“বারজাখে (কবরে) মৃত্যুকে রূহ ফিরিয়ে দেওয়া এবং যে তাকে সালাম দিবে তার সালামের জবাব দেওয়া দ্বারা সেই জীবন আবশ্যক হয় না যেটা কিছু ভুল কারীরা ধারণা করে থাকে। যদিও তা এক প্রকার বারজাখি জীবন। যে বলে যে, তা দুনিয়ার পরিচিত জীবনের অনুরূপ তার কথা দলিল ও যুক্তি বিরুদ্ধ কথা।” [আস সারিম আল মুনকি]

◈ ৪. ইমাম সাখাবি [মৃত্যু: ৯০২ হিজরি] বলেন,

نحن نؤمِنُ ونُصَدِّقُ بأنَّه صلَّى اللهُ عليه وسلَّم حيٌّ يُرزَقُ في قبرِه، وأنَّ جَسَدَه الشَّريفَ لا تأكُلُه الأرضُ، والإجماعُ على هذا

“আমরা ইমান রাখি এবং সত্য বলে বিশ্বাস করি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কবরে জীবিত অবস্থায় রিজিক প্রাপ্ত হচ্ছেন এবং তার দেহ শরিফকে মাটি খেতে পারবে না। এ বিষয়ে ইজমা রয়েছে।” [আল কাউলুল বাদি, পৃষ্ঠা নম্বর: ১৭]

◈ ৫. সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড:

” حياة الأنبياء والشهداء وسائر الأولياء : حياة برزخية لا يعلم حقيقتها إلا الله ، وليست كالحياة التي كانت لهم في الدنيا
“নবী, শহিদ এবং অপরাপর ওলি-আওলিয়াদের জীবন হল, বরজাখি জীবন-যার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। তা তাদের দুনিয়ার জীবনের অনুরূপ নয়।” [ফাতাওয়া লাজদাহ দায়েমা, ১ম গ্রুপ, ১/১৭৩ ও ১৭৪]

◈ ৬. শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. [১৩৩০ হি./১৯১২ খৃ.] বলেন,

قد صرَّح الكثيرون من أهلِ السُّنَّةِ بأنَّ النَّبِيَّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم حيٌّ في قبرِه حياةً برزخيَّةً لا يَعْلَمُ كُنْهَها وكيفيَّتَها إلَّا اللهُ سُبحانَه، وليست من جنسِ حياةِ أهلِ الدُّنيا، بل هي نوعٌ آخَرُ يَحصُلُ بها له صلَّى اللهُ عليه وسلَّم الإحساسُ بالنعيمِ، ويَسمَعُ بها سلامَ المُسلِّمِ عليه عندما يرُدُّ اللهُ عليه رُوحَه ذلك الوَقتَ

“অনেক আহলুস সুন্নাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কবরে জীবিত আছেন। কিন্তু সেটা হল, বারজাখি জীবন। যার ধরণ ও প্রকৃত অবস্থা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। তা দুনিয়ার জীবনের মত নয়। বরং তা এক ভিন্ন ধরণের জীবন-যার মাধ্যমে সে সুখ অনুভব করে, কোন ব্যক্তি সালাম দিলে তার সালাম শুনতে পায় যখন সে সময় আল্লাহর তার রূহকে ফিরিয়ে দেন।”

◈ ৭. আল্লামা আলবানি রাহ. [১৯৯৯ খৃ.] বলেন,

” اعلم أن الحياة التي أثبتها هذا الحديث للأنبياء عليهم الصلاة والسلام ، إنما هي حياة برزخية ، ليست من حياة الدنيا في شيء ، ولذلك وجب الإيمان بها ، دون ضرب الأمثال لها ومحاولة تكييفها وتشبيهها بما هو المعروف عندنا في حياة الدنيا
“জেনে রাখুন যে, এই হাদিসটি নবি-রসুলদের যে জীবন সাব্যস্ত করেছে তা হল, বারজাখি জীবন। দুনিয়ার জীবনের সাথে এর কোনও মিল নই। এই জন্য এর প্রতি বিশ্বাস রাখা ওয়াজিব। কিন্তু এটিকে দুনিয়ার জীবনে আমাদের জানাশোনা কোনও কিছুর সাদৃশ্য বা উপমা পেশ করা যাবে না।” এ ব্যাপারে আরও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের জগত বিখ্যাত আলেমদের মতামত রয়েছে-আল হামদুলিল্লাহ।

❑ কবর ও আখিরাতের জীবন সম্পর্কে আমাদের আকিদা-বিশ্বাস কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয়?

কুরআনের আয়াত ও বহু হাদিস দ্বারা কবরে ও আখিরাতের জীবন প্রমাণিত। আলেমগণও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কথা বলেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এ বিষয়ে মুসলিমদের জন্য যে বিশ্বাস রাখা অপরিহার্য তা হলো, দুনিয়ার জীবনের সাথে আখিরাতের জীবনের কোন সাদৃশ্য নেই। কবরের জীবনের ধরন ও প্রকৃতি কি তা মানুষের অজানা। তার ধরন ও প্রকৃতি কেমন হবে তা একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন। অর্থাৎ এটি ইলমে গায়েব দৃশ্য জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। তাই এ কথা বলা যাবে না যে, তারা কবরের জীবনে দুনিয়ার জীবনের মতই খাওয়া-দাওয়া করে, বাজার-ঘাট করে, ঘুমায়, বিয়ে-শাদি করে ইত্যাদি। এ বিষয়ে মাথা ঘামানোর জন্য আমরা নির্দেশিত নই। আমাদের করণীয় হল, যেভাবে হাদিসে এসেছে হুবহু সেভাবে বিশ্বাস করা। এই বিশ্বাস ঈমানের ছয়টি রোকন এর মধ্যে অন্যতম।

❑ কিয়ামত পরবর্তী জীবন:

কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে কবরের জীবনের সমাপ্ত হবে এবং এ পরে আখিরাতের জীবনের দ্বিতীয় স্টেজ শুরু হবে এবং মানুষের ব্যাপারে জান্নাত ও জাহান্নামের ফায়সালা হওয়ার পরে তার পরিধি চলবে অনন্তকাল ধরে। তবে তাওহিদপন্থী জাহান্নামিগণ এক পর্যায়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে মহান আল্লাহর বিশেষ দয়া এবং সুপারিশ কারীদের সুপারিশের মাধ্যমে।
তারপরে হাশরের ময়দানে হিসাব-নিকাশ এবং বিচারের মাধ্যমে যারা চিরস্থায়ী জাহান্নামি তাদেরকে স্থায়ীভাবে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয় আর যারা বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি পাবে তাদেরকে হয়তো ক্ষমা করে দেওয়া হয় অথবা জাহান্নামে গুনাহ মোচন সমপরিমাণ শাস্তি দেওয়ার পরে অবশেষে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়।

মোটকথা, নবি-রসূল, শহিদ, অলি-আউলিয়া সহ পৃথিবীর সকল মানুষ মৃত্যু যবনিকার ওপারে আখিরাতের অনন্ত জীবনের অধিকারী হয়। তবে নবি-রসূল শহিদ এবং অন্যান্য আল্লাহর প্রিয় ভাজন ব্যক্তিগণ আলমে বারজাখে বিশেষভাবে নেয়ামত প্রাপ্ত হয়। আরও বিশ্বাস রাখতে হবে যে, বারজাখি জীবন দুনিয়ার জীবনের অনুরূপ নয়। এটি গায়েব বা অদৃশ্য বিষয় সমূহের অন্তর্ভুক্ত। যা কেবল বিশ্বাস করতে হবে। এর প্রকৃত অবস্থা ও প্রকৃতি আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। এটি হচ্ছে এ বিষয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত-এর আকিদার সারাংশ। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।