নখ কাটা এবং শরীরের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার সংক্রান্ত ইসলামী বিধি-বিধান এবং কতিপয় ভ্রান্ত বিশ্বাস

নখ কাটা এবং শরীরের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার সংক্রান্ত ইসলামী বিধি-বিধান এবং কতিপয় ভ্রান্ত বিশ্বাস:
••••••••••••••••••••••
❑ ১) ৪০ দিনের মধ্যে শরীরের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার না করলে কি নামাজ-রোজা ইত্যাদি কোনও ইবাদত কবুল হবে না?
প্রশ্ন: শরীরের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করা সম্পর্কে ইসলামের বিধান কি? আমি জানি, ৪০ দিনের মধ্যে পরিষ্কার করতে হয়। তার মানে কি, যদি কোন কোন কারণে ৪০ দিন পার হয়ে যায় তাহলে কি নামাজ, রোজা, কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি কোনও ইবাদত কবুল হবে না?
উত্তর:
নি:সন্দেহে ইসলাম অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, শুদ্ধ ও পবিত্র জীবনাদর্শের নাম। পাক-পবিত্রতা ইসলামের এক অনন্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একে ঈমানে শাখা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাই ইসলামে, নখ কাটা এবং মোচ, বগল, নাভির নিচের পশম ইত্যাদি শরীরের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৪০ দিন নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যেই তা পরিষ্কার করা সুন্নত।
আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন,
وُقِّتَ لَنَا فِي قَصِّ الشَّارِبِ وَتَقْلِيمِ الأَظْفَارِ وَنَتْفِ الإِبْطِ وَحَلْقِ الْعَانَةِ أَنْ لاَ نَتْرُكَ أَكْثَرَ مِنْ أَرْبَعِينَ لَيْلَةً
“গোঁফ ছাটা, নখ কাঁটা, বগলের লোম উপড়িয়ে ফেলা এবং নাভির নিচের লোম ছেঁচে ফেলার জন্যে আমাদেরকে সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যেন আমরা তা করতে চল্লিশ দিনের অধিক দেরী না করি।” [মুসলিম, অধ্যায়: পাক-পবিত্রতা, হা/৪৮৭]
রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الْفِطْرَةُ خَمْسٌ : الْخِتَانُ وَالاِسْتِحْدَادُ وَنَتْفُ الإِبْطِ وَتَقْلِيمُ الأَظْفَارِ وَقَصُّ الشَّارِبِ».
‘পাঁচটি জিনিস মানুষের স্বভাবজাত বিষয়: খতনা করা, ক্ষৌরকার্য করা (নাভির নিম্নের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করা), বগলের চুল উপড়ানো, নখ কাটা ও গোঁফ ছোট করা।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]
সুতরাং কেউ যদি অবহেলা বশত: ইচ্ছাকৃত ভাবে এই মেয়াদ অতিক্রম করে তাহলে সে গুনাহগার হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, অলসতা, ব্যস্ততা, ভুলে যাওয়া ইত্যাদি কোনও কারণে ৪০ দিনের মধ্যে এগুলো পরিষ্কার করা না হলে নামাজ, রোজা, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি কোন এবাদত কবুল হবে না। বরং যথানিয়মে সঠিক পদ্ধতি ইবাদত করা হলে, আশা করা যায় আল্লাহ তাআলা তা কবুল করবেন ইনশাআল্লাহ। অবশ্য, ময়লা জমে পবিত্রতা অর্জনে বিঘ্ন সৃষ্টি করলে তাতে সালাত ও পবিত্রতা সংশ্লিষ্ট ইবাদতগুলো শুদ্ধ হবে না।
এ ক্ষেত্রে করণীয় হল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক নির্ধারিত মেয়াদ অতিক্রম করার কারণে আল্লাহর নিকট তওবা করা এবং অনতি বিলম্বে এসব নোংরামি থেকে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা। আল্লাহ তৌফিক দান করুন। আমীন
••••••••••••••••••••••
❑ ২) প্রশ্ন: নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করার সময় যদি ২/১ টা অবশিষ্ট থেকে যায় তাহলে কি নামাজ হবে?
উত্তর:
হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ চল্লিশ দিনের মধ্যে ভালোভাবে নাভির নিচের লোম, বগলের পশম (পুরুষদের মোচ) ইত্যাদি পরিষ্কার করা জরুরি। অন্যথায় গুনাহগার হতে হবে। তবে কেউ যদি এ সময়ের মধ্যে অলসতা, ব্যস্ততা, ভুলে যাওয়া ইত্যাদি কোনও কারণে তা না পরিষ্কার করে বা অসতর্কতা বশত: কিছু লোম অবশিষ্ট থেকে যায় তাহলে এ অবস্থায় যথারীতি পবিত্রতা অর্জন করত: সালাত আদায় করলে তাতে সালাতের কোনও ক্ষতি হবে না। তবে ইচ্ছাকৃত যেন এমনটি না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা কর্তব্য।
••••••••••••••••••••••
❑ ৩) প্রশ্ন: নাভির নিচের লোম কি নাপাক?
উত্তর:
ইসলামে নাভির নিচের লোম, বগলের নিচের পশম, নখ ইত্যাদি পরিষ্কারের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং সর্বোচ্চ ৪০ দিন সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। এর অতিরিক্ত সময় নখ ও শরীরের অতিরিক্ত লোম পরিষ্কার না করা গুনাহ।
তবে নখ, চুল, পশম, অতিরিক্ত চামড়া এগুলো নাপাক নয় ইত্যাদি শরীরের উপরিভাগে থাকা জিনিসগুলো নাপাক নয়। কেননা হাদিসে এগুলোকে নাপাক বলা হয় নি। তবে পেশাব, পায়খানা, পুঁজ, প্রবাহিত রক্ত ইত্যাদি শরীরের ভেতর থেকে বাইরে বের হয়ে আসা বস্তু সমূহ নাপাক।
••••••••••••••••••••••
❑ ৪) প্রশ্ন: শনিবার ও বুধবার কি চুল কাটা কি নিষেধ?
উত্তর:
নখ কাটার জন্য বিশেষ কোন দিন, ক্ষণ বা পদ্ধতি সহিহ হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত নয়। হাদিসের নাম দিয়ে এ সংক্রান্ত কিছু কথা সমাজে প্রচলিত আছে। কিন্তু মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে এগুলো সব জাল-জঈফ কথা। সুতরাং তাতে বিশ্বাস করা বা সে আলোকে আমল করা বৈধ নয়।
বলা হয়ে থাকে, “শনি, ও বুধবার নখ ও চুল কাটা যাবে না। নিশ্চয়ই তা শ্বেত কুষ্ঠ হওয়ার কারণ।” কিন্তু হাদিসের নামে এটি সম্পূর্ণ বানোয়াট, মিথ্যাচার ও কুসংস্কার পূর্ণ কথা।
এ ছাড়াও উমুক দিন নখ কাটলে এই হবে-সেই হবে। উমুক দিন কাটলে এই রোগ-ব্যাধি বা ক্ষয়-ক্ষতি হবে। উমুক দিন কাটলে এই উপকার হবে-এ জাতীয় কথাবার্তা কুসংস্কার পূর্ণ হিন্দুয়াবী বিশ্বাস থেকে উৎসারিত। কোন মুসলিমের জন্য এ সব কথায় বিশ্বাস পোষণ করা জায়েজ নাই।
➧ কোন দিন নখ-চুল কাটলে কী হয়?
অনেক হিন্দুদের মধ্যে সপ্তহের দিন হিসেবে নখ-চুল কাটাকে শুভ-অশুভ মানা হয়। যেমন:
◆ শনিবারে চুল বা নখ কাটা অনেক বিপদ ডেকে আনতে পারে। এমনকি হঠাৎ মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে!
◆ রবিবারে চুল-নখ কাটাকে অশুভ বলে মনে করা হয়। সম্পত্তি, মানসিক স্থিতি এবং ধর্মের উপর প্রভাব পড়ে এই দিন চুল বা নখ কাটলে!
◆ সোমবারে চুল কাটলে মানুষের মানসিক অবস্থার উপর এবং শিশুর শারীরিক অবস্থার উপর এর উপর পড়ে!
◆ মঙ্গলবার চুল বা নখ কাটলে আয়ু কমে যায়!
◆ বুধবারে নখ বা চুল কাটলে দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদ পাওয়া যায়!
◆ বৃহস্পতিবার চুল-নখ কাটা মানে লক্ষ্মীকে অপমান করা হয়!
◆ শুক্রবার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। এদিন চুল বা নখ কাটলে সাফল্য আসে!
◆ সূর্যাস্তের পর নখ কাটলে ভয়াবহ বিপদ আসতে পারে!
(উৎস: dailyhunt in)
বলা বাহুল্য যে, ইসলামের দৃষ্টিতে নখ-চুল কাটার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও দিন বা ক্ষণকে শুভ-অশুভ মনে করা হারাম। ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও ভ্রান্ত কুসংস্কার ছাড়া অন্য কিছু নয়। (আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন)
মোটকথা, হাত বা পায়ের নখ লম্বা হলে বা কাটার প্রয়োজন অনুভব হলে যে কোন মুহূর্তে তা কাটা যাবে। তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নখ, মোচ, বগলের লোম পরিষ্কার ও নাভির নিচের লোম কাটার জন্য সর্বোচ্চ ৪০ দিন সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন-যেমনটি পূর্বোক্ত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং ইচ্ছাকৃতভাবে এর ব্যতিক্রম করা যাবে না।
••••••••••••••••••••••
❑ ৬) প্রশ্ন: আমি লন্ড্রিতে কাজ করি। সে ক্ষেত্রে হাতের নখ ছোট রাখলে আঙুলের সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে কি আমি কিছুটা বড় রাখতে পারবো?
উত্তর:
কাফির-মুশরিক এবং ফাসেক নায়ক-নায়িকাদের অনুকরণে নখ বড় রাখা জায়েজ নাই (যেমনটি অনেক যুবক-যুবতি আধুনিক ফ্যাশনের নামে করে থাকে)। বরং ইসলামের নির্দেশ হল, সর্বোচ্চ ৪০ দিনের মধ্যে নখ ও শরীরের অতিরিক্ত পশম কাটাতে হবে; অন্যথায় গুনাহগার হতে হবে। হাদিসে এসেছে:
আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন,
وُقِّتَ لَنَا فِي قَصِّ الشَّارِبِ وَتَقْلِيمِ الأَظْفَارِ وَنَتْفِ الإِبْطِ وَحَلْقِ الْعَانَةِ أَنْ لاَ نَتْرُكَ أَكْثَرَ مِنْ أَرْبَعِينَ لَيْلَةً
“গোঁফ ছাটা, নখ কাঁটা, বগলের লোম উপড়িয়ে ফেলা এবং নাভির নিচের লোম ছেঁচে ফেলার জন্যে আমাদেরকে সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যেন আমরা তা করতে চল্লিশ দিনের অধিক দেরী না করি।” [মুসলিম, অধ্যায়: পাক-পবিত্রতা, হা/৪৮৭]
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‏ “‏ الْفِطْرَةُ خَمْسٌ – أَوْ خَمْسٌ مِنَ الْفِطْرَةِ – الْخِتَانُ وَالاِسْتِحْدَادُ وَتَقْلِيمُ الأَظْفَارِ وَنَتْفُ الإِبِطِ وَقَصُّ الشَّارِبِ ‏”‏
“ফিতরাত (স্বভাবজাত ধর্ম) পাঁচটি অথবা পাঁচটি জিনিস স্বভাবজাত বিষয়:
● ক. খতনা করা,
● খ.নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করা,
● গ. নখ কাটা,
● ঘ. বগলের পশম তুলে ফেলা
● ঙ. এবং মোচ কাটা।” (বুখারি ৫৮৮৯, ৫৮৯১, ৬২৯৭; মুসলিম ২৫৭/১-২)
তবে-যেমনটি আপনি বলেছেন-বিশেষ দরকারে যদি নখ বড় রাখার প্রয়োজন হয় তাহলে ইনশাআল্লাহ গুনাহ হবে না। নিশ্চয় আল্লাহ বান্দার নিয়ত সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত।
দুআ করি, আল্লাহ আপনার ইনকামে বরকত দান করেন। আমীন।
▬▬▬▬◈◯◈▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল৷
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।