তারবীহর রাকায়াত সংখ্যা ৮ না ২০

তারবীহর রাকায়াত সংখ্যা ৮ না ২০?
আল্লামা উসাইমীন রহ. এর একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা

অনুবাদ: আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

সম্মানিত শাইখ মোহাম্মাদ সালেহ আল উছাইমীন রহ. বলেন:

সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব জগতের প্রভু আল্লাহ তায়ালার জন্য। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বশেষ নবী মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর পরিবার এবং তাঁর সকল সাহাবীর উপর।
অতঃপর আমি তারাবীর নামায বিষয়ে একটি লিফলেট দেখতে পেলাম, যা মুসলমানদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। আমি আরও জানতে পারলাম যে, প্রবন্ধটি কতিপয় মসজিদে পাঠ করা হয়েছে। প্রবন্ধ বা লিফলেটটি খুবই মূল্যবান। কেননা লেখক তাতে তারাবীর নামাযে খুশু-খুযু এবং ধীর স্থিরা অবলম্বনের উপর উৎসাহ দিয়েছেন। আল্লাহ তাকে ভাল কাজের বিনিময়ে ভাল পুরস্কার দান করুন।
তবে প্রবন্ধটির মধ্যে বেশ কিছু আপত্তি রয়েছে, যা বর্ণনা করা ওয়াজিব মনে করছি। লেখক সেখানে উল্লেখ করেছেন যে, ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাযান মাসে বিশ রাকাত তারাবি পড়তেন।
এর জবাব হচ্ছে এই হাদীছটি যঈফ। ইবনে হাজার আসকালানী সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যা ফতহুল বারীতে বলেন:

وأما ما رواه ابن أبي شيبة” من حديث ابن عباس كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلي في رمضان عشرين ركعة والوتر، فإسناده ضعيف، وقد عارضه حديث عائشة هذا الذي في الصحيحين مع كونها أعلم بحال النبي صلى الله عليه وسلم ليلاً من غيرها.

“যে হাদীছটি ইবনে আবী শায়বা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাযান মাসে বিশ রাকাত তারাবি ও বিতর পড়তেন-তার সনদ দুর্বল। আর এটি বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আয়েশা (রা:)এর হাদীছের বিরোধী। আয়েশা (রা:) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রাতের অবস্থা অন্যদের চেয়ে বেশী জানতেন।”
আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত যে হাদীছটির প্রতি ফতহুল বারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসকালানী (রাহ:) ইঙ্গিত করেছেন, তা ইমাম বুখারী এবং মুসলিম স্বীয় কিতাব দ্বয়ে উল্লেখ করেছেন। আবু সালামা আব্দুর রাহমান আয়েশা (রা:)কে জিজ্ঞেস করলেন: রামাযান মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর নামায কেমন ছিল? উত্তরে তিনি বললেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান কিংবা অন্য মাসে রাতের নামায ১১ রাকআতের বেশী পড়তেন না। (বুখারী) মুসলিমের শব্দে বর্ণিত হয়েছে, তিনি প্রথমে আট রাকআত পড়তেন। অতঃপর বিতর পড়তেন।
আয়েশা (রা:)এর হাদীছে জোরালো ভাবে এই সংখ্যার উপর যে কোন সংখ্যা অতিরিক্ত করার প্রতিবাদ করা হয়েছে।
ইবনে আব্বাস (রা:) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রাতের নামাযের ধরণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, তিনি দুই রাকআত নামায পড়তেন, অতঃপর আরও দুই রাকআত পড়তেন। তারপর আরও দুই রাকআত, এভাবে ১২ রাকআত পূর্ণ করে বিতর পড়তেন। (সহীহ মুসলিম) এতে পরিষ্কার হয়ে গেল যে তাঁর রাতের নামায ১১ রাকআত বা ১৩ রাকআতের মধ্যেই ঘূর্ণ্যমান ছিল।

• এখন যদি বলা হয় রাতের নামায (তাহাজ্জুদ) আর তারাবীর নামায এক নয়। কেননা তারাবী হচ্ছে উমর (রা:)এর সুন্নাত। তাহলে উত্তর কি হবে?
এ কথার উত্তর হচ্ছে, রামাযান মাসে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর রাতের নামাযই ছিল তারাবী। সাহাবীগণ এটিকে তারাবীহ নাম দিয়েছেন। কেননা তারা এটা খুব দীর্ঘ করে পড়তেন। অতঃপর তারা প্রত্যেক দুই সালামের পর বিশ্রাম নিতেন। তারাবীহ অর্থ বিশ্রাম নেওয়া। তারাবীহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরই সুন্নাত ছিল।
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, কোন এক রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নামায পড়লেন। তাঁর নামাযকে অনুসরণ করে কিছু লোক নামায পড়ল। অতঃপর দ্বিতীয় রাতেও নামায পড়লেন। এতে লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। অতঃপর তৃতীয় বা চতুর্থ রাতে প্রচুর লোকের সমাগম হল। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবার ঘর থেকে বের হয়ে তাদের কাছে আসলেন না। সকাল হলে তিনি বললেন: আমি তোমাদের কাজ-কর্ম প্রত্যক্ষ করেছি। আমাকে তোমাদের কাছে বের হয়ে আসতে কোন কিছুই বারণ করে নি, কিন্তু আমি ভয় করলাম যে, তা তোমাদের উপর ফরজ করে দেয়া হয় কি না? আর এটি ছিল রামাযান মাসে। (বুখারী ও মুসলিম)

• আর যদি বলা হয়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১১ রাকআত পড়েছেন। তার চেয়ে বেশী পড়তে নিষেধ করেন নি। সুতরাং রাকআত বাড়ানোর মধ্যে বাড়তি ছাওয়াব ও কল্যাণ রয়েছে।

তার উত্তরে আমরা বলবো যে, কল্যাণ ও ছাওয়াব হয়ত ১১ রাকআতের মধ্যেই সীমিত। কারণ এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর আমল দ্বারা প্রমাণিত। আর সর্বোত্তম হেদায়েত হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হেদায়েত। সুতরাং তাই যদি হয় তাহলে কল্যাণ ও বরকত ১১ রাকআতের মধ্যেই। আর যদি বিশ্বাস করেন যে বাড়ানোর মধ্যেই কল্যাণ, তাহলে বুঝা যাচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কল্যাণ অর্জনে ত্রুটি করেছেন এবং উত্তম বিষয়টি তার উম্মতের জন্য গোপন করেছেন। নাউযুবিল্লাহ। এ ধরণের বিশ্বাস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ক্ষেত্রে অসম্ভব।
• যদি বলা হয় ইমাম মালিক তার মুআত্তা গ্রন্থে ইয়াজিদ বিন রুমান থেকে বর্ণনা করেছেন যে,

عن يزيد بن رومان قال: كَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ فِي زَمَانِ عُمَرَ بنِ الخَطَّابِ فِي رَمَضَانَ بِثَلاثٍ وَعِشرِينَ رَكعةً

ইয়াজিদ বিন রুমান থেকে বর্ণিত, লোকেরা উমর বিন খাত্তাব (রা:)এর আমলে রামাযান মাসে কিয়ামুল লাইল (বিতরসহ) ২৩ রাকআত আদায় করতেন। এই হাদীছের জবাবে কি বলবেন?
এর জবাব হচ্ছে, হাদীছটি দুর্বল ও সহীহ হাদীছের বিরোধী।
দুর্বল হওয়ার কারণ হচ্ছে:

(১) তার সনদে ইনকিতা রয়েছে। অর্থাৎ কোন একজন রাবী বাদ পড়েছে। কারণ ইয়াজিদ বিন রুমান উমর (রা:) এর যুগ পায় নি। যেমন ইমাম নববী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ ঘোষণা করেছেন।
(২) ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদীছটি ইমাম মালিক (র:) তাঁর মুআত্তা গ্রন্থে নির্ভরযোগ্য রাবী মোহাম্মাদ বিন ইউসুফ সায়েব বিন ইয়াজিদ থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীছের বিরোধী। সায়েব বিন ইয়াজিদ বলেন:
أمر عمر بن الخطاب أبي بن كعب وتميماً الداري أن يقوما للناس بإحدى عشرة ركعة

উমর বিন খাত্তাব (রা:) উবাই বিন কা’ব এবং তামীম দারীকে মানুষের জন্য ১১ রাকআত তারাবীর নামায পড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন। দেখুন: (দেখুন শরহুয যুরকানী ১/১৩৮)

সুতরাং সায়েব বিন ইয়াজিদের হাদীছ তিনটি কারণে ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদীছের চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য।

ক) সায়েব বিন ইয়াজিদের হাদীছ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীছের মোতাবেক। উমর (রা:) এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাত জানা সত্ত্বে কখনই তা বাদ দিয়ে অন্যটি নির্বাচন করতে পারেন না।
খ) ১১ রাকআতের ব্যাপারে সায়েব বিন ইয়াজিদের হাদীছটি সরাসরি উমর (রা:)এর আদেশের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আর ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদীছটি উমর (রা:)এর জামানার দিকে নিসবত করা হয়েছে। সুতরাং ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদীছে বর্ণিত ২০ রাকআতের উপর উমর (রা:)এর সমর্থন বুঝায়। আর আদেশ সমর্থনের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়। কেননা ১১ রাকআত তাঁর সরাসরি আদেশ দ্বারা প্রমাণিত। আর সমর্থন কখনও বৈধ বিষয়ের ক্ষেত্রেও হতে পারে, যদিও তা পছন্দের বাইরে হয়।
সুতরাং উমর (রা:) ২৩ রাকআতের প্রতি সমর্থন দিয়ে থাকতে পারেন। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ ব্যাপারে নিষিদ্ধতা পাওয়া যায় না। সাহাবীগণ এ ব্যাপারে ইজতেহাদ করেছিলেন। আর তিনি তাদের ইজতেহাদকে সমর্থন করেছেন। অথচ তিনি ১১ রাকআতই নির্বাচন করে তা আদায় করার আদেশ দিয়েছিলেন।

গ) ১১ রাকআতের ব্যাপারে সায়েব বিন ইয়াজিদের হাদীছটি দোষ থেকে মুক্ত। তার সনদ মুত্তাসিল। আর ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদীছ দুর্বল। সায়েব বিন ইয়াজিদ থেকে বর্ণনা করেছেন মুহম্মাদ বিন ইউসুফ। তিনি ইয়াজিদ বিন রুমান থেকে অধিক নির্ভর যোগ্য। কেননা মোহাম্মাদ বিন ইউসুফ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তিনি ছিলেন ثقة ثبت (ছিকাহ ছাবেত)। আর ইয়াজিদ বিন রুমান সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ বলেছেন যে, তিনি শুধু ثقة (ছিকাহ)। আর
উসুলে হাদীছের পরিভাষায় ছিকাহ ছাবেত রাবীর বর্ণনা শুধু ছিকাহ রাবীর বর্ণনা থেকে অধিক গ্রহণযোগ্য।

الذي قيل فيه ثقة ثبت مرجح على الذي قيل فيه ثقة فقط كما في مصطلح الحديث

আর যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, ২৩ রাকআতের ব্যাপারে ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদিছটি প্রমাণিত এবং সায়েব বিন ইয়াজিদের বিরোধী নয়, তারপরও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত ১১ রাকআতের উপর ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদীছে বর্ণিত ২৩ রাকআতকে প্রাধান্য দেয়া কোন ভাবেই সম্ভব নয়। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান কিংবা অন্য মাসে রাতের নামায ১১ রাকআতের বেশী কখনই পড়েন নি।
সর্বোপরি বিষয়টি নিয়ে যেহেতু আমাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়ে গেছে, তাই মত বিরোধপূর্ণ বিষয়ে আমাদের করণীয় কি? অবশ্যই আল্লাহ তাআলা এরূপ বিষয়ে আমাদের জন্য সমাধানের ব্যবস্থা করেছেন এবং আমাদেরকে তার কিতাবের দিকে ফেরত যেতে বলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّـهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّـهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّـهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا

“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্‌র নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ্‌ ও তার রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর- যদি তোমরা আল্লাহ্‌ ও কেয়ামত দিবসের ওপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।” (সূরা নিসাঃ ৫৯)
সুতরাং মতবিরোধের সময় আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের দিকে ফিরে যাওয়া আবশ্যক করে দিয়েছেন এবং রাসূলের জীবদ্দশায় তাঁর কাছে এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সুন্নতের দিকে ফিরে আসতে বলেছেন। আর এটাকেই তিনি কল্যাণ এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তআলা আরও বলেন:

فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجاً مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيماً

“অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে নেবে।” (সূরা নিসাঃ ৬৫)
এখানে আল্লাহ তাআলা মানুষের পারস্পরিক বিরোধের সময় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের হুকুমের দিকে ফিরে যাওয়াকে ঈমানের দাবী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর আল্লাহ কসম করে বলেছেন যে, যারা রাসূলের হুকুমের সামনে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ না করবে এবং খুশী মনে তা না মানবে, নিঃসন্দেহে তাদের ঈমান চলে যাবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর খুতবা সমূহে সবসময় বলতেন: “সর্বোত্তম কালাম হচ্ছে আল্লাহর কিতাব আর সর্বোত্তম সুন্নাত হচ্ছে রাসূলরে সুন্নাত।” মুসলমানগণ এ ব্যাপারে একমত যে মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাত হচ্ছে সর্বোত্তম পথ। মানুষ জ্ঞানে ও আমলে যতই বড় হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই তার কথাকে রাসূলের কথার উপর প্রাধান্য দেয়া যাবে না এবং তার কথাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কথার চেয়ে উত্তম মনে করা যাবে না।
সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কথার বিরোধিতা করতে কঠোর ভাষায় নিষেধ করতেন। এ ব্যাপারে ইবনে আব্বাস (রা:)এর কথাটি কতই না বলিষ্ঠ। তিনি বলেন: আমি বলছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আর তোমরা আমার কথার বিরোধিতা করে বলছ আবু বকর ও উমর বলেছেন। আমার আশঙ্কা হচ্ছে তোমাদের এই কথার কারণে আকাশ থেকে প্রস্তর বর্ষণ করে তোমাদেরকে ধ্বংস করা হয় কি না। (দেখুন: যাদুল মাআদঃ ২/১৯৫)
এখন যদি কোন মুসলিমকে বলা হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে নিয়ে ১১ রাকআত তারাবী পড়তেন। আর উমুক ইমাম মানুষকে নিয়ে ২৩ রাকআত পড়াচ্ছেন, তার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত বাদ দিয়ে কোন ক্রমেই অন্যের সুন্নাত গ্রহণ করা বৈধ হবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত মোতাবেক আমল করাই অধিক উত্তম। আর অধিক উত্তম আমলের জন্যই মানুষ, আসমান-যমীন এবং সকল বস্তু সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً

“যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন- কে তোমাদের মধ্যে কর্মে অধিক উত্তম?” (সূরা মূলক: ২)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:

وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً

“তিনিই আসমান ও যমীন ছয় দিনে তৈরি করেছেন, তার আরশ ছিল পানির উপরে, তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান যে, তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে ভাল কাজ করে।” (সূরা হুদ: ৭)
আল্লাহ তাআলা এ কথা বলেন নি যে, তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান যে, তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশী আমল করে? এটি জানা কথা যে, আমলের মধ্যে ইখলাস অর্থাৎ একনিষ্ঠতা যত বেশী হবে এবং সুন্নতের অনুসরণ যত বেশী করা হবে, আমলটি তত বেশী উত্তম হবে।
সুতরাং ১১ রাকআত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নতের মোতাবেক হওয়ার কারণে বাড়ানোর চেয়ে ১১ রাকআত পড়াই উত্তম। বিশেষ করে যখন ধীর স্থীরভাবে, ইখলাসের সাথে এবং খুশু-খুযুর সাথে এই ১১ রাকআত পড়া হবে। যাতে ইমাম ও মুক্তাদী সকলেই দুআ এবং জিকিরগুলো সুন্দরভাবে পড়তে পারবে।

যদি বলা হয় ২৩ রাকআত পড়া তো আমীরুল মুমিনীন খলীফা উমর (রা:)এর সুন্নাত। তিনি খোলাফায়ে রাশেদার একজন। তাদের অনুসরণ করার জন্য আমাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: তোমরা আমার পরে আমার সুন্নাত ও সঠিক পথপ্রান্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের অনুসরণ করবে।
এ কথার জবাবে বলবো যে, ঠিক আছে। উমর (রা:) খোলাফায়ে রাশেদার অন্তর্ভুক্ত। তাদের অনুসরণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে আমাদের ভালভাবে জানতে হবে তারাবীর রাকআত সংখ্যার ব্যাপারে উমর (রা:) এর সুন্নতটি কি?
অনুসন্ধান করে আমরা যা জানতে পারলাম, তা হচ্ছে ২৩ রাকআতের বর্ণাগুলো দুর্বল ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত সহীহ হাদীছের বিরোধী। বরং সহীহ সনদে উমর (রা:) উবাই বিন কা’ব ও তামীম দারীকে ১১ রাকআত পড়ানোর আদেশ দিয়েছেন বলেই প্রমাণ পাওয়া যায়।
আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে উমর (রা:)২৩ রাকআত নির্ধারণ করেছেন, তারপরও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর আমলের বিরুদ্ধে তাঁর কথা দলীল হতে পারে না। আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত, সাহাবীদের কথা এবং মুসলমানদের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত যে, কারও কথা রাসূলের সুন্নতের সমান হতে পারে না। সে যত বড়ই হোক না কেন? কারও কথা টেনে এনে রাসূলের সুন্নতের বিরুদ্ধে দাঁড় করা যাবে না।
ইমাম শাফেয়ী (র:) বলেন:

أجمع المسلمون على أن من استبانت له سنة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يحل له أن يدعها لقول أحد

“মুসলমানদের সর্বসম্মতিক্রমে কারও কাছে রাসূলের সুন্নাত সুস্পষ্ট হয়ে যাওযার পর তা ছেড়ে দিয়ে অন্যের কথা গ্রহণ করা জায়েজ নয়।”

যারা বলেন, সাহাবীদের জামানা থেকে আজ পর্যন্ত মুসলমানগণ ২৩ রাকআত পড়ে আসছেন। সুতরাং তা ইজমার মত হয়ে গেছে।
তাদের এই কথা সঠিক নয়। সাহাবীদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মুসলমানদের মাঝে তারাবীর রাকআত সংখ্যার ব্যাপারে খেলাফ (মতবিরোধ) চলেই আসছে। হাফেজ ইমাম ইবনে হাজার আসকালী (র:) ফতহুল বারীতে এ ব্যাপারে মতপার্থক্যের কথা আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন: আবান বিন উসমান এবং উমর বিন আব্দুল আজীজের আমলে মদীনাতে ৩৩ রাকআত তারাবী পড়া হতো। ইমাম মালিক (র:) বলেন একশ বছরেরও বেশী সময় পর্যন্ত চলমান ছিল। (দেখুন ফতহুল বারী আলমাকতাবা সালাফীয়া ৪/২৫৩)
সুতরাং যেহেতু মুসলমানদের মধ্যে এ ব্যাপারে মতভেদ চলে আসছে, তাই কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে আসাতেই রয়েছে এর সমাধান। আল্লাহ তাআলা বলেন:

فإن تنازعتم في شيء فردوه إلى الله والرسول إن كنتم تؤمنون بالله واليوم الآخر ذلك خير وأحسن تأويلا

“তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ্‌ ও তার রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর- যদি তোমরা আল্লাহ্‌ ও কেয়ামত দিবসের ওপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।” (সূরা নিসাঃ ৫৯)
সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব জগতের প্রভু আল্লাহ তায়ালার জন্য। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বশেষ নবী, তার পরিবার এবং সকল সাহাবীর উপর।
মোহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উছাইমীনঃ ০৮/০৯/১৩৯৫ হিজরী।
—————-
একটি সংযোজন:

হানাফী মাজহাবের যে সমস্ত বিজ্ঞ আলেম ২০ রাকআত তারাবী পড়ার পক্ষের হাদীছগুলাকে যঈফ বলেছেন, তাদের নামের একটি বিশাল তালিকাঃ
১) মুআত্তা ইমাম মুহাম্মাদ, অধ্যায়ঃ কিয়ামে শাহরে রামাযান, পৃষ্ঠা নং-১৩৮। মুস্তফায়ী ছাপা, ১২৯৭ হিঃ।
২) নাসবুর রায়া, (২/১৫৩)আল্লামা যায়লাঈ হানাফী,মাজলিসুল ইলমী ছাপা, ভারত।
৩) মিরকাতুল মাফাতীহ,(৩/১৯৪) মোল্লা আলী কারী হানাফী, এমদাদীয়া লাইব্রেরী, মুলতান, ভারত।
৪) উমদাতুল কারী শরহে সহীহ আল-বুখারী,(৭/১৭৭)প্রণেতা আল্লামা বদরুদ দীন আইনী হানাফী মিশরী ছাপা।
৫) ফতহুল কাদীর শরহে বেদায়া (১/৩৩৪) প্রণেতা ইমাম ইবনুল হুমাম হানাফী।
৬) হাশিয়ায়ে সহীহ বুখারী (১/১৫৪) প্রণেতা মাওলানা আহমাদ আলী সাহরানপুরী।
৭) আল-বাহরুর রায়েক (২/৭২) প্রণেতা ইমাম ইবনে নুজাইম হানাফী।
৮)হাশিয়ায়ে দুররে মুখতার (১/২৯৫) প্রণেতা আল্লামা তাহাভী (রঃ)হানাফী।
৯) দুররুল মুখতার (ফতোয়া শামী)(১/৪৯৫) প্রণেতা আল্লামা ইবনে আবেদীন হানাফী।
১০) হাশিয়াতুল আশবাহ পৃষ্ঠা নং-৯ প্রণেতা সায়্যেদ আহমাদ হামুভী হানাফী।
১১) হাশিয়ায়ে কানযুদ দাকায়েক পৃষ্ঠা নং-২৬, প্রণেতা মাওলানা মুহাম্মাদ আহমাদ নানুতুভী।
১২) মারাকীউল ফালাহ শরহে নুরুল ইজাহ পৃষ্ঠা নং- ২৪৭, প্রণেতা আবুল হাসান শরানবালালী।
১৩) মা ছাবাতা ফিস সুন্নাহ,পৃষ্ঠ নং- ২৯২, প্রণেতা শাইখ আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী।
১৪) মাওলানা আব্দুল হাই লাখনুভী হানাফী বিভিন্ন কিতাবের হাশিয়াতে ২০ রাকআতের হাদীছগুলোকে যঈফ বলেছেন। উদাহরণ স্বরূপ দেখুন উমদাতুর রেআয়া (১/২০৭)।
১৫) তালীকুল মুমাজ্জাদ, পৃষ্ঠা নং-১৩৮।
১৬) তুহফাতুল আখয়ার পৃষ্ঠা নং-২৮,লাখনু ছাপা।
১৭)হাশিয়ায়ে হেদায়া (১/১৫১) কুরআন মহল, করাচী ছাপা।
১৮) ফাইযুল বারী,(১/৪২০) প্রণেতা মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশমীরী।
১৯) আলউরফুয্ শাযী পৃষ্ঠা নং- ৩০৯।
২০) কাশফুস সিতর আন সালাতিল বিতর পৃষ্ঠা নং- ২৭।
২১) শরহে মুআত্তা ফারসী,(১/১৭৭) প্রণেতা শাহ অলীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী। কুতুব খান রাহীমিয়া, দিল্লী, ১৩৪৬ হিঃ।
উপরোক্ত আলেমগণ ছাড়া আরও অনেকেই ২০ রাকআত তারাবীর হাদীছগুলোকে যঈফ বলেছেন। আশা করি উপরোক্ত তথ্যগুলো জানার পর কেউ ২০ রাকআত তারবীর পক্ষের হাদীছগুলো সহীহ বলা থেকে সকলেই বিরত থাকবেন এবং অন্যদেরকেও বিরত রাখার চেষ্টা করবেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে সহীহ হাদীছের উপর আমল করার এবং জাল ও যঈফ হাদীছ বর্জন করার তাওফীক দিন। আমীন।।