তাবিজের পক্ষাবলম্বন কারীদের দলিল খণ্ডন

যে সকল ভাইয়েরা কুরআন-হাদিসের দুআ থেকে বানানো তাবিজকে বৈধ বলেন তারা ইবনে তায়মিয়া রাহ. এর একটি ফতোয়া এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত দুটি আসার দ্বারা দলিল পেশ করে থাকেন।

নিম্নে তাদের এ সকল দলিল পর্যালোচনা ও খণ্ডণ করা হল:

❑ ইবেন তায়মিয়ার ফতোয়া এবং ইবনে আব্বাস রা. এর আসার:

তাবিজের পক্ষাবলম্বন কারীগণ শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া রহ. এর নিম্নোক্ত ফতোয়া উল্লেখ করেন।

ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেছেন,

وَيَجُوزُ أَنْ يَكْتُبَ لِلْمُصَابِ وَغَيْرِهِ مِنْ الْمَرْضَى شَيْئًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَذِكْرُهُ بِالْمِدَادِ الْمُبَاحِ وَيُغْسَلُ وَيُسْقَى كَمَا نَصَّ عَلَى ذَلِكَ أَحْمَد وَغَيْرُهُ قَالَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ أَحْمَد: قَرَأْت عَلَى أَبِي ثَنَا يَعْلَى بْنُ عُبَيْدٍ؛ ثَنَا سُفْيَانُ؛ عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ أَبِي لَيْلَى عَنْ الْحَكَمِ؛ عَنْ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ؛ عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: إذَا عَسِرَ عَلَى الْمَرْأَةِ وِلَادَتُهَا فَلْيَكْتُبْ: بِسْمِ اللَّهِ لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ الْحَلِيمُ الْكَرِيمُ سُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ((كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوا إلَّا عَشِيَّةً أَوْ ضُحَاهَا} {كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَ مَا يُوعَدُونَ لَمْ يَلْبَثُوا إلَّا سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ بَلَاغٌ فَهَلْ يُهْلَكُ إلَّا الْقَوْمُ الْفَاسِقُونَ ))
قَالَ أَبِي: ثَنَا أَسْوَدُ بْنُ عَامِرٍ بِإِسْنَادِهِ بِمَعْنَاهُ وَقَالَ: يُكْتَبُ فِي إنَاءٍ نَظِيفٍ فَيُسْقَى قَالَ أَبِي: وَزَادَ فِيهِ وَكِيعٌ فَتُسْقَى وَيُنْضَحُ
مَا دُونَ سُرَّتِهَا
قَالَ عَبْدُ اللَّهِ: رَأَيْت أَبِي يَكْتُبُ لِلْمَرْأَةِ فِي جَامٍ أَوْ شَيْءٍ نَظِيفٍ

“আর বিপদগ্রস্ত বা অসুস্থ লোকদের জন্য পবিত্র কালি দ্বারা আল্লাহর কিতাব ও আল্লাহর যিকর থেকে কিছু লিখে তা দ্বারা গোসল করা এবং ধুয়ে পান করা জায়েজ। এ ব্যাপারে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল ও অন্যান্য আলেমদের স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
তারপর এ আলোচনার শেষ দিকে তিনি তাবিজ বৈধ হওয়ার ব্যাপারে ইবনে আব্বাস রা. এর একটি আসার পেশ করেন। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, “কোনও সন্তনসম্ভাবনা নারীর যদি সন্তান ভূমিষ্ট হতে কষ্ট হয় তাহলে যেন লিখে: (বিপদগ্রস্থের জন্য দুআ) “বিসিমিল্লাহ লা ইলাহা ইল্লাহুল হালীমুল কারীম…” এবং কাআন্নাহুম ওয়াউমা ইয়ারাওনাহা…” [সূরা নাজিয়াত: ৪৬] ।
আব্দুল্লাহ বিন আহমদ বলেন, আমার পিতা (আহমদ বি হাম্বল রাহ.) আসওয়াদ বিন আমের এর সূত্রে একই অর্থবোধক আসার উল্লেখ করেছেন। তিনিও বলেছেন, “একটি পরিচ্ছন্ন পাত্রে তা লিখে (পানি দ্বারা ধৌত করে) তা রোগীকে পান করাবে।” এখানে ওয়াকি রাহ. আরেকটু কথা বৃদ্ধি করেছেন। তা হল, “পান করানোর পাশাপাশি রোগীর নাভীর নিম্নাংশে তা ছিটিয়ে দিবে।”
আব্দুল্লাহ বলেন, আমি আমার পিতা (আহমদ বিন হাম্বল রাহ.) কে একটি বাটিতে বা পরিষ্কার জিনিসে লিখতে দেখেছি।” [মাজমুউল ফাতওয়া: ১৯/৬]

◍◍ বিশ্লেষণ:

● প্রথমত:

ইবনে তায়মিয়া উক্ত ফতোয়ায় মোটেই কুরআনের আয়াত ও দুআ লিখে শরীরে ঝুলানোর কথা বলেন নি। অর্থাৎ তিনি তাবিজ ব্যবহারের কথা বলেনন নি। বরং তিনি তা ধৌত করে পানি পান এবং গোসল করার (বা শরীরে পানি ছিটিয়ে দেওয়ার) কথা বলেছেন। এমনটি করা অনেক আলেমের মতে জায়েজ।

● ২য়ত:

ইবনে আব্বাস রা. এর উক্ত আসারটির ব্যাপারে কথা হল, কোনও কোন বর্ণনায় উক্ত দুআটি কাগজে লিখে তা পানিতে ধুয়ে পানি পান করার কথা আছে। আবার কোথাও বাহুতে ঝুলিয়ে দেওয়ার কথা আছে।

মনে রাখা জরুরি যে, এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কোন হাদিস নয় (মারফু নয়) বরং ইবনে আব্বাস রা. এর ব্যক্তিগত কর্ম (মাউকুফ)। তদুপরি তা মুহাদ্দিসগণের বিশ্লেষণে বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয় (জইফ বা দুর্বল)। এ বিষয়ে সনদ বিশ্লেষণ সহ বিস্তারিত দেখুন এখানে: (আরবি) (https://majles.alukah.net/t125862/

● ৩য়ত:

আহলে হাদিস বা সালাফিগণ বিশ্বাস করে, একজন ব্যক্তি যত বড় আলেম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির বা পণ্ডিত হোক না কেন তার কোন বক্তব্য বা ফতোয়া কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী বলে প্রমাণিত হলে তা অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

❑ আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. কি শিশুদের গলায় দুআ লিখে ঝুলাতেন?

যারা তাবিজকে বৈধ বলেন, তারা আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. এর নিম্নোক্ত হাদিস ও আসার (সাহাবির আমল) দ্বারা দলিল পেশ করেন:
عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُعَلِّمُهُمْ مِنَ الْفَزَعِ كَلِمَاتٍ: «أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ، مِنْ غَضَبِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ، وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ»
وَكَانَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ يُعَلِّمُهُنَّ مَنْ عَقَلَ مِنْ بَنِيهِ، وَمَنْ لَمْ يَعْقِلْ كَتَبَهُ فَأَعْلَقَهُ عَلَيْهِ
আমর ইবনে শুআইব তাঁর পিতা ও তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল বলেন, “তোমাদের কেউ যখন ঘুম অবস্থায় ঘাবড়িয়ে উঠে, সে যেন পাঠ করে
أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ، مِنْ غَضَبِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ، وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ
“আউযুবি বি কালিমাতিল্লাহিত্তাম্মাতি……..”
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর তাঁর উপযুক্ত সন্তানদের তা শিক্ষা দিতেন এবং ছোটদের গলায় তা লিখে লটকিয়ে দিতেন।” [সুনানে আবু দাউদ, হা/৩৮৯৫]

◍◍বিশ্লেষণ:

এখন আমরা দেখবো, এ বর্ণনাটি কতটুকু বিশুদ্ধ। মুহাদ্দিসগণের সনদ বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে যে, এখানে শিশুদের গলায় দুআ লিখে ঝুলিয়ে দেওয়ার কথাটুকু সহিহ নয়। বরং তা জইফ বা দুর্বল। কারণ তার বর্ণনা সূত্রে মুহাম্মদ বিন ইসহাক নামক বর্ণনা কারী আছেন। তিনি মুদাল্লিস রাবী। তৎসঙ্গে তিনি এখানে عن দ্বারা বর্ণনা করেছেন।

– হাদিসের এ অংশটিকে শাওকানি এ হাদিসটিকে জইফ বলেছেন। [সূত্র: ফাতহুল কাদির, ৩৫৮৮]

– অনুরূপভাবে শাইখ আলবানিও “আবদুল্লাহ ইবনে ‘আমর রা. এ বাক্যগুলো তার বালেগ সন্তানদের শিখাতেন এবং নাবালেগদের জন্য লিখে তা তার গলায় ঝুলিয়ে দিতেন”- এ অংশটুকুকে জইফ বলেছেন। কিন্তু হাদিসের বাকি অংশ সহিহ।” [সূত্র: সহিহুত তিরমিযী, হা/৩৫৮৮, সিলসিলা সহিহাহ ১/৫২৯, যইফুত তারগিব, হা/৯৯১]

الحديث الذي أشرت إليه رواه أبو داود (3893) ، الترمذي (3528) ، وأحمد في “المسند” (6696) وغيرهم من طريق محمد بن إسحاق عن عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ ، عَنْ أَبِيهِ ، عَنْ جَدِّهِ ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ : ( إِذَا فَزِعَ أَحَدُكُمْ فِي النَّوْمِ فَلْيَقُلْ : أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ غَضَبِهِ وَعِقَابِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ ، وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ فَإِنَّهَا لَنْ تَضُرَّهُ ). . فَكَانَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَمْرٍو ، يُلَقِّنُهَا مَنْ بَلَغَ مِنْ وَلَدِهِ ، وَمَنْ لَمْ يَبْلُغْ مِنْهُمْ كَتَبَهَا فِي صَكٍّ ثُمَّ عَلَّقَهَا فِي عُنُقِهِ ” .
وهذا الحديث في إسناده نظر ، إذ أنه من رواية محمد بن إسحاق ، وهو مدلس وقد عنعن.
وقد قال الترمذي : هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ .
وقال الشوكاني في “فتح القدير” (3588) : فِي إِسْنَادِهِ مُحَمَّدُ بْنُ إِسْحَاقَ ، وَفِيهِ مَقَالٌ مَعْرُوفٌ .
وقال الألباني : حسن دون قوله : ” فكان عبد الله بن عمرو يلقنها…”. صحيح الترمذي (3528) ، وينظر أيضا : “السلسلة الصحيحة” (1/529) ، التعليق على مسند أحمد ، ط الرسالة (11/296) ، ” النهج السديد ” ، للدوسري ، رقم (111)

মোটকথা, উক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হল যে, ইবনে তায়মিয়া রাহ. এর উক্ত ফতোয়ায় কোথাও তাবিজ ঝুলানোর কথা নেই। বরং কুরআনের আয়াত ও দুআ পড়ে তা রোগীকে পান করানো বা তা দ্বারা গোসল করা বা শরীরে ছিটিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
আর ইবনে আব্বাস রা. এর আসার এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. কর্তৃক শিশুদের গলাল দুআ লিখে ঝুলিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে যে অতিরিক্ত কথাটি আছে তা সনদের বিচারে মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে সহিহ নয়; জইফ। সুতরাং এগুলো দলিল হিসেবে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।