তাগুত বলতে কী বুঝায়, তা কত প্রকার ও কী কী? যারা আল্লাহর বিধান ছাড়া মানব রচিত বিধান অনুযায়ী বিচার বা শাসন কার্য পরিচালনা করে তারা কি তাগুত?
❑ তাগুতের সংজ্ঞা বা পরিচয়:
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেছেন:
مَعْنَى الطَّاغُوتِ مَا تَجَاوَزَ بِهِ الْعَبْدُ حَدَّهُ مِنْ مَعْبُودٍ أَوْ مَتْبُوعٍ أَوْ مُطَاعٍ
“তাগুতের অর্থ হলো, বান্দা যা কিছুতে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে। চাই সে ব্যক্তির পূজা-অর্চনা করা হোক বা অনুসরণ করা হোক বা আনুগত্য করা হোক।”
❑ তাগুতের প্রকারভেদ:
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রাহ. আরও বলেছেন,
“وَالطَّوَاغِيتُ كَثِيرُونَ وَرُؤُوسُهُمْ خَمْسَةٌ: إِبْلِيسُ لَعَنَهُ اللهُ، وَمَنْ عُبِدَ وَهُوَ رَاضٍ، وَمَنْ دَعَا النَّاسَ إِلَى عِبَادَةِ نَفْسِهِ، وَمَنْ ادَّعَى شيئًا مِنْ عِلْمِ الْغَيْبِ، وَمَنْ حَكَمَ بِغَيْرِ مَا أَنْزَلَ اللهُ”
“তাগুত অনেক। আর তাদের প্রধান পাঁচটি:
১. অভিশপ্ত ইবলিস।
২. যে ব্যক্তির ইবাদত বা পূজা-অর্চনা করা হয় এবং সে তাতে সন্তুষ্ট থাকে।
৩. যে মানুষকে নিজের ইবাদতের দিকে ডাকে।
৪. যে গায়েব (অদৃশ্য) কোনও কিছু জানার দাবি করে।
৫. এবং যে আল্লাহ যা নাজিল করেছেন (আল্লাহর কিতাব ও রসুলের সুন্নাহ) তা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে (অর্থাৎ মানব রচিত আইন) দ্বারা বিচার ও শাসন কার্য পরিচালনা করে।”
❑ যে ব্যক্তি আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তার বিরুদ্ধাচরণ করে মানব রচিত আইন-কানুন দ্বারা বিচার ও শাসন কার্য পরিচালনা করে সেও তাগুত। এর কারণ কী?
এর কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা একটি শরিয়ত ও বিধানসমূহ নির্ধারণ করেছেন। তিনি ভালো জানেন কোনটি তাঁর বান্দাদের জন্য কল্যাণকর, কোনটি তাদেরকে অন্যায় বা ক্ষতিকর কাজ থেকে বিরত রাখে এবং কোনটি তাদের উপকার করে।
সুতরাং যখন কোনও ব্যক্তি আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তার বিরোধিতা করে এবং আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে বিচার বা শাসন কার্য পরিচালনা করে, তখন সে তাগুত।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
“وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ”
“যারা আল্লাহ যা নাজিল করেছেন সে অনুযায়ী বিচার করে না, তারাই ফাসেক।” [মায়িদা: ৪৭]
তিনি আরও বলেছেন:
“وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ”
“যারা আল্লাহ যা নাজিল করেছেন সে অনুযায়ী বিচার করে না, তারাই জালিম।” [মায়িদা: ৪৫]
এবং তিনি আরও বলেছেন:
“وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ”
“যারা আল্লাহ যা নাজিল করেছেন সে অনুযায়ী বিচার করে না, তারাই কাফের।” [মায়িদা: ৪৪]
❑ আল্লাহর আইন ছাড়া মানব রচিত আইন দ্বারা বিচার ও শাসন কার্য পরিচালনার বিধান:
আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে বিচার করা সর্বসম্মতিক্রমে কুফর। এটি আয়াত এবং অন্যান্য বহু প্রমাণ থেকে স্পষ্ট, যা শানকিতি (রহিমাহুল্লাহ) উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি বলেছেন:
«وبهذه النصوص السماوية التي ذكرنا يظهر غاية الظهور: أن الذين يتبعون القوانين الوضعية التي شرعها الشيطان على ألسنة أوليائه مخالفة لما شرعه الله جل وعلا على ألسنة رسله ﷺ، أنه لا يشك في كفرهم وشركهم إلا من طمس الله بصيرته، وأعماه عن نور الوحي مثلهم»
“আমরা যে সকল আসমানি দলিল উল্লেখ করেছি, তা থেকে চূড়ান্তভাবে স্পষ্ট হয় যে, যারা শয়তান কর্তৃক তার বন্ধুদের মুখে প্রণীত মানব-রচিত আইন অনুসরণ করে, যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসুলদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাধ্যমে প্রণীত বিধানের পরিপন্থী। তাদের কুফর ও শিরকের ব্যাপারে কেবল সেই ব্যক্তিই সন্দেহ করবে, যার অন্তর্দৃষ্টি আল্লাহ অন্ধ করে দিয়েছেন এবং যারা তাদের মতোই ওহীর আলো থেকে বঞ্চিত।” [দেখুন: শানকিতির তাফসিরে “আদওয়াউল বায়ান” (৩/২৫৯)] তবে এটি নিরঙ্কুশ কুফর নয় বরং এর বিধান ভিন্ন ভিন্ন হয় যেমনটি আলেমগণ উল্লেখ করেছেন।

والمراد بالطاغوت في الآية: كل ما عدل عن كتاب الله تعالى وسنة نبيه ﷺ إلى التحاكم إليه من نظم وقوانين وضعية أو تقاليد وعادات متوارثة أو رؤساء قبائل ليفصل بينهم بذلك، أو بما يراه زعيم الجماعة أو الكاهن-ومن ذلك يتبين: أن النظم التي وضعت ليتحاكم إليها مضاهاة لتشريع الله داخلة في معنى الطاغوت
“আয়াতে তাগুত বলতে বোঝানো হয়েছে, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত হয়ে বিচার-ফায়সালার জন্য যেসব মানব-রচিত নিয়মকানুন, ঐতিহ্যগত প্রথা বা গোত্রপ্রধানদের কাছে যাওয়া হয়, যাতে তারা সে অনুযায়ী বা গোষ্ঠী প্রধান বা ভবিষ্যদ্বক্তার নিজস্ব মতানুযায়ী বিচার করে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, যেসব আইন আল্লাহর বিধানের অনুকরণে বিচার করার জন্য প্রণীত হয়েছে, সেগুলো তাগুতের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। [শাইখ ইবনে বাজের সভাপতিত্বে “ফাতাওয়ায়ে লাজনাহ দায়িমাহ” (১/৭৮৪)]
আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে বিচার করার বিষয়টি একটি একক রূপ নয়:


যথা:



«والصحيح أن الحكم بغير ما أنزل الله يتناول الكفرين، الأصغر والأكبر بحسب حال الحاكم، فإنه إن اعتقد وجوب الحكم بما أنزل الله في هذه الواقعة، وعدل عنه عصياناً، مع اعترافه بأنه مستحق للعقوبة، فهذا كفر أصغر، وإن اعتقد أنه غير واجب، وأنه مخير فيه، مع تيقنه أنه حكم الله، فهذا كفر أكبر، وإن جهله وأخطأه فهذا مخطئ، له حكم المخطئين
“সঠিক কথা হলো, আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে বিচার করা দুটি কুফরকেই (ছোট কুফর ও বড় কুফর) অন্তর্ভুক্ত করে, বিচারকের অবস্থা অনুসারে। যদি সে বিশ্বাস করে যে, এই বিশেষ ঘটনায় আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তা দিয়ে বিচার করা ওয়াজিব ছিল, কিন্তু সে অবাধ্যতা বশত তা থেকে সরে আসে এবং স্বীকার করে যে সে শাস্তির যোগ্য, তাহলে এটি কুফরে আসগর (ছোট কুফর)। আর যদি সে বিশ্বাস করে যে, এটি ওয়াজিব নয় এবং তার এ বিষয়ে ইখতিয়ার (পছন্দ) আছে, অথচ সে নিশ্চিত যে এটি আল্লাহর বিধান, তাহলে এটি কুফরে আকবর (বড় কুফর)। আর যদি সে এ বিষয়ে অজ্ঞ থাকে এবং ভুল করে তাহলে সে একজন ভুল কারী, তার ভুল কারীদের মতোই বিধান।” [মাদারিজুস সালিকিন” (১/৩৪৬)] [ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব (রহিমাহুল্লাহ) এর বিখ্যাত কিতাব ‘আল উসুলুস সালাসাহ’ (তিনটি মূলনীতি)-এর একটি ব্যাখ্যা গ্রন্থ ’তাক্বরিবুল উসুল ইলা সালাসাতিল উসুল’ কিতাব থেকে নেওয়া। ব্যাখ্যা কারক: ড. মনসুর বিন মুহাম্মদ আস-সাকুব] আল্লাহু আলাম। আল্লাহ সর্বোজ্ঞ।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
অনুবাদ ও গ্রন্থনা:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।