তওবা-ইস্তিগফারের অপরিহার্যতা, পদ্ধতি, শর্তাবলী ও দুআ

নিন্মে উপরোক্ত বিষয়গুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হল:

💠 গুনাহ থেকে তওবা করা ফরয:

কোন মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তবে সে ব্যক্তিই উত্তম যে ভুল করার পর তওবা করে। তাই
দয়াময় আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের উপর তওবা করা ফরয করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,

وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعاً أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

“হে মুমিনগণ,তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তওবা কর। যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পার।”[ সূরা নূর: ৩১]

তিনি আরও বলেছেন, تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا
“তোমরা আল্লাহর নিকট আন্তরিকভাবে তওবা কর।”[ সূরা তাহরীম: ৮] সুতরাং প্রতিটি পাপের জন্য বান্দার তওবা করা অপরিহার্য।

💠 তওবা কারীদের প্রতি আল্লাহ অত্যন্ত আনন্দিত হন:

প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খাদেম আবু হামযা আনাস বিন মালিক রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

اللَّهُ أَفْرَحُ بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ مِنْ أَحَدِكُمْ سَقَطَ عَلَى بَعِيرِهِ ، وَقَدْ أَضَلَّهُ فِى أَرْضِ فَلاَةٍ

“কোনও লোক বিজন মরু প্রান্তরে উট হারিয়ে যাবার পর পুনরায় তা ফেরত পেলে যে পরিমাণ আনন্দে উদ্বেলিত হয় মহান আল্লাহ বান্দার তওবাতে তার চেয়েও বেশি আনন্দিত হন।”[সহীহ বুখারী,অনুচ্ছেদ: তওবা, হা/৫৮৩৪, শামেলা]

💠 মহান আল্লাহ ক্ষমাশীল; তিনি আমাদেরকে ক্ষমা করতে চান:

আল্লাহ তায়ালা দিনের অপরাধীকে ক্ষমা করার জন্য রাতে তাঁর হাত প্রসারিত করেন। আর রাতের অপরাধীকে ক্ষমার জন্য দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করেন। যেমন, ইমাম মুসলিম রহ. আবু মূসা আশয়ারী থেকে বর্ণনা করেছেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لِيَتُوبَ مُسِىءُ النَّهَارِ وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِىءُ اللَّيْلِ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا

“আল্লাহ দিনের অপরাধীকে ক্ষমার জন্য রাতে তাঁর হাত প্রসারিত করেন। আর রাতের অপরাধীকে ক্ষমার জন্য দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করেন। (তিনি এরূপ করতেই থাকেন) যে পর্যন্ত না সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হয় (তথা কিয়ামত পর্যন্ত)।[ সহীহ মুসলিম। অনুচ্ছেদ: গুনাহ থেকে তওবা করলে তা কবুল হওয়া যদিও বারবর গুনাহ সংঘটিত হয়, হা/৪৯৫৪, শামেলা]

💠 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের অনুসরণীয়:

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব বেশী তওবা-ইস্তেগফার করতেন। যেমন আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,

وَاللَّهِ إِنِّى لأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ فِى الْيَوْمِ أَكْثَرَ مِنْ سَبْعِينَ مَرَّةً

“আল্লাহর শপথ, আমি দিনে সত্তর বারের অধিক আল্লাহর নিকট তওবা-ইস্তেগফার করি।”[সহীহ বুখারী। অনুচ্ছেদ: দিনে-রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তওবা, হা/৫৮৩২, শামেলা]

সহীহ মুসলিমে আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ فَإِنِّي أَتُوبُ فِي الْيَوْمِ إِلَيْهِ مِائَةَ مَرَّةٍ

“হে মানব মণ্ডলী, তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর। কেননা, আমি দিনে একশ বার তওবা করি।” [সহীহ মুসলিম, অনুচ্ছেদ: অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার করা মুস্তাহাব, হা/৪৮৭১]

💠 তওবার শর্তাবলী:

জেনে রাখা দরকার যে, তওবার জন্য কতিপয় শর্ত রয়েছে। এ সকল শর্ত সাপেক্ষে কেবল তওবা কবুল হতে পারে; অন্যথায় নয়। গুনাহ যদি বান্দা ও আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়; অপর কোন মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট না হয় তবে তার জন্য তিনটি শর্ত। যথা:

 ১ম শর্ত: তৎক্ষণাৎ গুনাহ হতে বিরত থাকা।
 ২য় শর্ত: গুনাহের জন্য লজ্জিত হওয়া।
 ৩য় শর্ত: পুনরায় উক্ত গুনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করা।
উল্লেখিত তিনটি শর্ত পূরণ না হলে তওবা কবুল হবে না।
 আর অন্যায় যদি অন্য মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট হয় তবে তার জন্য চার টি শর্ত। উল্লেখিত তিনটি শর্তের সাথে চতুর্থ শর্ত হল, সম্ভব হলে যার অধিকার হরণ করা হয়েছে তার সাথে বিষয়টি সুরাহা করে নেয়া। যেমন, কারও অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করা হলে তা মালিকের নিকট ফিরিয়ে দিতে হবে। অগোচরে কারও সমালোচনা করা হলে তার সাথে বিষয়টি মিটমাট করে নেয়া। তবে যদি তা সম্ভব না হয় তবে উক্ত ব্যক্তির জন্য বেশি বেশি দোয়া করতে হবে এবং তার পক্ষ থেকে দান-সদকা করতে হবে।

💠 তাওবা-ইস্তেগফার এর জন্য দুআ:

হাদিসে বর্ণিত তাওবার কতিপয় দোয়া:

 দোয়া-১:

أَستَغْفِرُ اللهَ
উচ্চারণঃ আস্তাগফিরুল্লা-হ।
অনুবাদঃ আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
প্রতি ওয়াক্তের ফরয সালাতে সালাম ফিরানোর পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দোয়া ৩ বার পড়তেন। [মিশকাত-৯৬১]

 দোয়া-২:

أَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণঃ আস্তাগফিরুল্লা-হা ওয়া আতূবু ইলাইহি।
অনুবাদঃ আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি ও তাঁর দিকে ফিরে আসছি।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) প্রতিদিন ৭০ বারের অধিক তাওবা ও ইসতিগফার করতেন। [বুখারী-৬৩০৭]

 দোয়া-৩:
رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَتُبْ عَلَيَّ إِنَّكَ أنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ الغَفُوْرُ
উচ্চারণঃ রাব্বিগ্ ফিরলী, ওয়া তুব ‘আলাইয়্যা, ইন্নাকা আনতাত তাওয়া-বুর রাহীম। দ্বিতীয় বর্ণনয় “রাহীম”-এর বদলে: ‘গাফূর’।
অনুবাদঃ হে আমার প্রভু, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি মহান তাওবা কবুলকারী করুণাময়। দ্বিতীয় বর্ণনায়: তাওবা কবুলকারী ও ক্ষমাকারী।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মসজিদে বসে এক বৈঠকেই এই দোয়া ১০০ বার পড়েছেন। [আবূ দাঊদ-১৫১৬, ইবনু মাজাহ-৩৮১৪, তিরমিযী-৩৪৩৪, মিশকাত-২৩৫২]

 দোয়া-৪:

أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণঃ আস্‌তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা- ইলা-হা ইল্লা- হুওয়াল হাইয়্যুল কইয়্যূম ওয়া আতূবু ইলায়হি।
অনুবাদঃ আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, তিনি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন মা‘বূদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী এবং তাঁর কাছে তাওবাহ্ করি।

এই দোয়া পড়লে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন-যদিও সে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়নকারী হয়। [আবু দাউদ-১৫১৭, তিরমিযী-৩৫৭৭, মিশকাত-২৩৫৩]

 দোয়া-৫:

اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা আনতা রব্বী লা-ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্কতানী ওয়া আনা আ’বদুকা ওয়া আনা আ’লা আহ্দিকা ওয়া ও’য়াদিকা মাসতাত’তু আ’উযুবিকা মিন শার্রি মা ছা’নাতু আবূউলাকা বিনি’মাতিকা আ’লাইয়্যা ওয়া আবূউলাকা বিযানবী ফাগ্ফির্লী ফাইন্নাহু লা-ইয়াগফিরুয্যুনূবা ইল্লা আনতা

অনুবাদঃ হে আল্লাহ তুমিই আমার প্রতিপালক। তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমারই গোলাম। আমি যথাসাধ্য তোমার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের উপর আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি। তুমি আমার প্রতি তোমার যে নিয়ামত দিয়েছ তা স্বীকার করছি। আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। কারন তুমি ছাড়া কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারবে না।

এই দোয়া সকালে পড়ে রাতের আগে মারা গেলে অথবা রাতে পড়ে সকালের আগে মারা গেলে সে জান্নাতে যাবে। [বুখারী-৬৩০৬]

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।।